ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৩
অস্ট্রেলিয়ায় ঝটিকা সফর

১.
যখন বয়স কম ছিল তখন দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর একটা শখ ছিল। এখন আর নেই।

পৃথিবীর নানা বিচিত্র দেশের চেয়ে নিজের এই সাদামাটা দেশটাকেই বেশি ভালো লাগে। তবে আমি কখনো বিষুবরেখা পার হইনি। তাই দক্ষিণ গোলার্ধে রাতের আকাশে নক্ষত্র দেখতে কেমন লাগে, সে বিষয়ে একটা সূক্ষ্ম কৌতূহল ছিল। আকাশের নক্ষত্রের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল একাত্তরে। বিনিদ্র রাতে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তখন মনে হতো তারাগুলো বুঝি গভীর মমতা নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে আরো নতুন নক্ষত্রের সাথে পরিচয় হয়। তাছাড়া রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি দক্ষিণ গোলার্ধে ভিন্ন সৌন্দর্য নিয়ে দেখা দেয়, সেটা দেখারও ইচ্ছে ছিল।

তাই যখন অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সাহিত্য সংসদ আমাকে মেলবোর্নে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তখন আর না করিনি। রাজি হয়ে গেলাম। আমি ভীতু প্রকৃতির মানুষ। একা ভ্রমণ করতে সাহস পাই না। যখন আমার স্ত্রী সাথে যেতে রাজি হলো, তখন আর আপত্তি না করে প্লেনে চড়ে বসলাম।

মেলবোর্নে পৌঁছানোর পর যখন একটি অত্যন্ত অভিজাত ট্রেনিং প্রাপ্ত বিশেষ কুকুর আমাদের সবকিছু শুঁকে আমাদের অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখার অনুমতি দিল, তখন আমরা বের হয়ে এলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদের প্রায় সব সদস্য চলে এসেছিল। তারা আমাদের সাথে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন যেন আমি খুব বড় একজন সাহিত্যিক এবং আমায় সন্দেহ করতে শুরু করলেন যে আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি কীনা!

বাংলা সাহিত্য সংসদ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটি সংগঠন। যারা বিদেশের মাটিতে থাকেন, তাদের দেশের জন্য ভিন্ন এক ধরনের মায়া থাকে। যারা কখনো দেশ ছেড়ে যাননি তারা আসলে কখনো দেশের জন্য এই বিচিত্র মায়াটি অনুভব করতে পারবেন না।

দেশের জন্য এই মমত্ববোধ থেকে বাংলা সাহিত্য সংসদ মেলবোর্নে নানা কিছুর আয়োজন করে থাকে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাহিত্যিকদের নিয়ে আসা। তাদের আয়োজনে সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ মজুমদারের মতো সাহিত্যিকরা এসেছেন এবং সেই একই আয়োজনে আমিও চলে এসেছি। নিজের সাহস দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম!

দেশে আমাকে নানা অনুষ্ঠানে যেতে হয়। শিক্ষকতা করি, কথা বলাই আমার কাজ। তাই বক্তব্য দিতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যিক হিসেবে শত শত মানুষের সামনে বক্তব্য দেওয়া! এটা আমার জন্য পুরোপুরি নতুন অভিজ্ঞতা। বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য বানিয়ে বানিয়ে গালগল্প লিখি। কিন্তু সেটা তো আর সাহিত্য নয়। কিন্তু সেটা কাকে বোঝাব!

শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় সাহিত্য সভাটি শেষ হয়েছিল। শিক্ষক হওয়ার কিছু বিশেষ সুবিধে আছে, সারা পৃথিবীতেই আমার ছাত্রছাত্রী। এখানেও তারা অনেকে, তারা সবাই দলবেঁধে চলে এলো। বক্তব্যের শেষে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল। আয়োজকরা সেটা নিয়ে একটু দুর্ভাবনায় ছিলেন। এটি নতুন শুরু হয়েছে। রাজাকার টাইপের মানুষরা দেশে সুবিধে করতে পারে না। বিদেশে সভা সমিতিতে এসে নাকী যা কিছু করে ফেলতে পারে। আমি আয়োজকদের অভয় দিলাম। রাজাকার টাইপের মানুষদের কীভাবে সামলাতে হয় সেটা নিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত লিখে গেছেন, ‘... যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাঁহার তখনি সে/পথ কুকুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে। ’

কিন্তু সেরকম কিছুই হলো না। সাহিত্যের চেয়ে দর্শক-শ্রোতার বেশি আগ্রহ ছিল শিক্ষা নিয়ে, দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে। এগুলো আমারও প্রিয় বিষয়। দেশ নিয়ে সবসময় স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্ন নিইয়ে দশজনকে বলতে আমার কোনো সমস্যা হয় না। (তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যখন একজন দর্শক আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কেন গোঁফ রাখি তখন আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছু বলার আগেই যখন আমার স্ত্রী হলভরা মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল, তখন আর আমার মুখ দেখানোর উপায় নেই। )

বাংলা সাহিত্য সংসদের আনুষ্ঠানিক সভাটি ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার, কিন্তু আমরা সংসদের সদস্যদের সাথে ঘরোয়া পরিবেশে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সময় কাটিয়েছি। প্রতি রাতেই কারো বাসায় সবাই একত্রিত হয়েছে এবং আমরা বাঙালিরা যে কাজগুলো খুব ভালো পারি- খাওয়া ও চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেগুলো করা হয়েছে! যে মানুষগুলোকে আগে কখনো তাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় চোখে পানি-এরকম বিচিত্র ঘটনা বাঙালি ছাড়া আর কোনো মানুষের জীবনে কখনো ঘটেছে কীনা আমার জানা নেই। মাঝে মাঝেই মনে হয়, ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম! নাহলে কত কিছু অজানাই থেকে যেত!
   
২.
মেলবোর্ন শহর পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য শহর। আমি সেখানে গিয়েছি ঢাকা শহর থেকে, যারা বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট দেন তারা ঢাকাকে সবচেয়ে বাসের অযোগ্য শহর হিসেবে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। (আসলে ঢাকা দুই নম্বর, এক নম্বর বাসের অযোগ্য শহর হচ্ছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কাস। সেখানে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মানুষ মারা হয়, যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত একটা শহর এরকম একটা শহরের সাথে প্রতিযোগিতা করা সোজা কথা নয়। আমার ধারণা যারা বাসের অযোগ্যতার সার্টিফিকেট দেন তারা মে মাসের ৫ তারিখ ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডব দেখার সুযোগ পেলে নির্ঘাত এই পুরস্কারটা দামেস্কাসকে না দিয়ে ঢাকা শহরকে দিয়ে দিতেন। )

যে কয়দিন মেলবোর্নে ছিলাম তখন বোঝার চেষ্টা করেছি এই শহরটি কেন সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরের পুরস্কার পেয়েছে। বাসযোগ্য শহর হতে হলে মানুষকে বাস করতে হবে। কিন্তু মজার ব্যাপার মেলবোর্নের রাস্তাঘাটে মানুষই চোখে পড়েনি! পুরো দেশেই মানুষ মাত্র দুই কোটি (এবং এটি শুধু দেশ নয়, মহাদেশও বটে। ) তাই চারিদিক ফাঁকা। শহরে উঁচু বিল্ডিং নেই। ছোট ছোট খেলনার মতো বাসা। বাসাগুলো ক্যালেন্ডারের ছবির মতো। বাসযোগ্য শহরের সার্টিফিকেট ঠিক কী কী কারণে পেয়েছে জানা নেই। তবে বৈচিত্র্যে এই শহরটি অভিনব। দক্ষিণ গোলার্ধ বলে এখানে সবকিছু উল্টো। তাই আমাদের আমাদের দেশে গ্রীষ্ম শেষ হয়ে শীত আসছে, আর সেখানে শীত শেষ হয়ে গ্রীষ্ম আসছে। তবে মনে হলো গ্রীষ্ম আসার কোনো তাড়াহুড়া নেই এখানে।

প্রচুর শীত, রাতে লেপ মুড়ি দিয়ে হিটার জ্বালিয়ে ঘুমাতে হয়। মেলবোর্ন শহরে একই দিনে কখনো প্রচণ্ড গরম, কখনো কনকনে শীত, কখনো বৃষ্টি, কখনো উথাল-পাথাল হাওয়া। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় নাকী এখানকার মানুষ চারটি ভিন্ন আবহাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বাসের অযোগ্য (প্রায়) শহর থেকে সবচেয়ে বাসযোগ্য শহরে পা দেওয়া নিঃসন্দেহে একটা চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। তবে বলে রাখি ঢাকায় ফিরে আসার পর প্লেন থেকে নেমেই আগুনের ভাপের মতো একটা দুঃসহ গরমের ঝাপটা অনুভব করেছি। হরতালের মাঝে বাসায় ফিরে এসেছি, এসে দেখি পানি নেই। এর মাঝে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। অন্ধকারে মশাদের সে কী আনন্দ! আমাদের ঘিরে তাদের মহোৎসব! কিন্তু মজার ব্যাপার হলো আমার এতটুকু বিরক্তি অনুভব হলো না। বরং মনে হলো, আহা, ঢাকার মতো এরকম ভালোবাসার শহর কয়টি আছে পৃথিবীতে?

৩.
আমেরিকা গেলে মানুষ যেরকম নায়াগ্রা ফলস না দেখে ফিরে আসে না, ঠিক সেরকম অস্ট্রেলিয়া গেলে মানুষ ক্যাঙারু না দেখে ফিরে আসে না। যখন অস্টেলিয়ায় ছিলাম তখন আমাদের ক্যাঙারু দেখার শখ পূরণ করিয়ে দিয়েছিল জীন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী (আবেদ চৌধুরী আর তার স্ত্রী টিউলিপ আমাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বন্ধু। আমরা আমেরিকাতে এক ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির জন্যে কাজ করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া এসে তার সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাওয়া তো যে কোনো হিসেবেই অপরাধ!) ক্যানবেরা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যেতে যেতে দেখলাম পথের দুই পাশে ক্যাঙারু। রাতের অন্ধকারে গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা পড়েছে। জীবিত না হোক তবুও তো ক্যাঙারু-আমি এতেই সন্তুষ্ট ছিলাম।

কিন্তু আবেদ চৌধুরী আমাদের জীবিত ক্যাঙারু না দেখিয়ে ছাড়বে না। তাই পরদিন কয়েক ঘণ্টা ড্রাইভ করে আমাদের নিয়ে এক জায়গায় হাজির হলো। সেখানে পথের দুই পাশে অসংখ্য ক্যাঙারু। আমাদের দেশের এমপিরা যখন তাদের এলাকায় যান তখন স্কুলের হেডমাস্টাররা যেভাবে ছাত্রছাত্রীদের ধরে এনে রাস্তার দু’পাশে রোদের মাঝে দাঁড় করিয়ে রাখেন ক্যাঙারুরা ঠিক সেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা যেরকম বিস্ময় নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়েছিলাম মনে হলো তারাও সেই রকম বিস্ময় নিয়ে আমাদের দিক তাকিয়ে আছে। ক্যাঙারুর চলাফেরা খুব মজার। তাদের মতো লেজে ভর দিয়ে জোড়া পায়ে লাফিয়ে আর কোনো প্রাণী ছুটতে পারে ন। তার থেকেও মজার হচ্ছে ক্যাঙারু মায়ের পেটের থলেতে ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার বসে থাকা। বাচ্চাগুলোকে দেখে মনে হয় পৃথিবীতে বুঝি এর থেকে আরামের কোনো জায়গা নেই।

ক্যানবেরা অস্ট্রেলিয়া রাজধানী। সবগুলো দেশের এজেন্সি কিংবা হাইকমিশন এখানে। এগুলোর পাশে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তার পাশে অপূর্ব একটা বিল্ডিং। চাঁদতারা আঁকা লাল পতাকা দেখে বুঝতে পারলাম এটা তুরস্কের হাইকমিশন। টিউলিপ আমাদের বলল, এই জমিটুকু বাংলাদেশকে দেওয়া হয়েছিল এবং শেখ হাসিনা এখানে বাংলাদেশ হাইকমিশন তৈরি করার জন্য ভিত্তি প্রস্তরও বসিয়ে গিয়েছিলেন। পরেরবার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের আমলে বসানো ভিত্তিপ্রস্তরে যেন বিল্ডিং তোলার অপমান সহ্য করতে না হয়, সে জন্য জমিটুকু হাত ছাড়া হতে দিয়েছে। তথ্যটি বিচিত্র হলেও অবিশ্বাস্য নয়। দেশের তথ্য পাচার হয়ে বাইরে যেন চলে না যেতে পারে সেজন্য এই সরকার একবার বিনি পয়সায় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়ায় সুযোগটি হাত ছাড়া করে পুরো দেশের মানুষকে ইন্টারনেট থেকে বঞ্চিত করেছিল।

ক্যানবেরার অসংখ্য এজেন্সি এবং হাইকমিশনের মাঝে সবচেয়ে চমকপ্রদ এজেন্সিটি একটা তাবুর মাঝে। তাদের পুরানো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে সেই দেশের আদিবাসীরা তাদের নিজেদের অধিকার আদায় করার জন্য বিশাল একটা পতাকা উড়িয়ে তাবুর মাঝে নিজেদের এজেন্সি বসিয়ে রেখেছে। সরকার তাদের খাটায়নি। বছরের পর বছর সেভাবেই রয়ে গেছে।

আমি তাদের দেখে আমি নিজের দেশের আদিবাসীদের কথা স্মরণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। সেনাবাহিনী যে জাতিসংঘের লোভনীয় চাকরি নিরবিচ্ছিন্নভাবে উপভোগ করতে পারে, সেজন্য এই দেশের আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে যে,দেশে আদিবাসী বলে কিছু নেই। এর চেয়ে মমত্বহীন কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।

অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাও মমত্বহীনতার স্বাদ অনেকদিন থেকে পেয়ে আসছে। সাদা চামড়ার মানুষরা প্রথম যখন এই দেশ দখল করেছে তখন তারা ফূর্তি করার জন্য মানুষ যেভাবে পাখি শিকারে যায় তারা সেভাবে আদিবাসী শিকারে যেত। কেউ কোন আদিবাসীর মাথা কেটে আনতে পারলে তাকে পুরস্কার দেয়া হতো। মাত্র কিছুদিন আগেও আদিবাসী মায়ের বুক খালি করে আদিবাসী সন্তানদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। অতীতের এই নিষ্ঠুরতার জন্য অষ্ট্রেলিয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে পার্লামেন্টে আদিবাসীদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এতদিন যা হবার তা তো হয়ে গেছে। অস্ট্রেলিয়ার এই বিশাল ভুখণ্ডে সত্যিকার আদিবাসীদের কোন চিহ্ন বলতে গেলে নেই। সারা পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতার উদাহরণ এত বেশি যে মনে হয় এটাই বুঝি নিয়ম। সবকিছু কেড়ে নিয়ে কোন এক সময় ক্ষমা চেয়ে নিজেদের পিঠে নিজেরাই নৈতিকতার একটা সিল মেরে দেয়।

৪.
আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী অস্ট্রেলিয়ায় থাকে। আমরা মেলবোর্ন এসেছি শুনে অনেকেই দেখা করতে এসেছে। এক সময় তারা কমবয়সী ছাত্র বা ছাত্রী ছিল। এখন তারা বড় হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বামী আছে, স্ত্রী আছে, ফুটফুটে ছেলে মেয়ে আছে। দেখে বড় ভালো লাগে। শুধুমাত্র আমাদের সাথে দেখা করার জন্য শত শত কিলোমিটার ড্রাইভ করে এসেছে। কেউ কেউ এসেছে প্লেনে উড়ে। তাদের নিয়ে হাজারো রকমের স্মৃতিচারণ করতে করতে রাত পার হয়ে যাবার অবস্থা।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘটনাগুলোর অনেক কিছুই ছিল মোটামুটি ভয়ংকর। এখন হঠাৎ করে সেগুলোই মনে হয় মজার। শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খায় সেরকম অবস্থা। আমরা যখন গিয়েছি তখন সবেমাত্র ইলেকশন শেষ হয়েছে। সেই দেশে সবাইকে ভোট দিতে হয়। ভোট না দিলে সত্তর ডলার জরিমানা। একজন বলল ইলেকশনের খবর পেয়ে তার মা খুব ব্যস্ত হয়ে দেশ থেকে তাকে ফোন করে বলেছেন, বাবা ইলেকশনের দিন খবরদার ঘর থেকে বের হবি না। কখন কোথায় বিপদ হয়। শুনে আমরা সবাই হেসেছি। কিন্তু তার মধ্যেও বুকের মাঝে কোথায় জানি একটা ব্যথার খোঁচা অনুভব করেছি। আমাদের সবার মাঝে কী একটা ভয়ানক অনিশ্চয়তা, কী হয় সেটা ভেবে কী একটা অসহায় আতংক।

খুব অল্প সময়ের জন্য অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। তাই আমরা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের খুব বেশি সময় দিতে পারিনি। কিন্তু তার মাঝেই তারা সবাইকে নিয়ে দল বেঁধে সমুদ্র উপকূলে, বনে জঙ্গলে বেড়াতে নিয়ে চলে গেল। যত ধরনের বেড়ানো আছে তার মাঝে সবচেয়ে মজার বেড়ানো হচ্ছে যখন নিজেদের কিছু করতে হয় না। অন্যেরা সবকিছু করে দেয়। যারা সবকিছু করে দেয় তারা যদি ছাত্রছাত্রী হয় তাহলে তো কোন কথা নেই। মজার ব্যপার হচ্ছে. দেশে ফিরে আসার পর দেখি আমরা কখন কোথায় কি করেছি তার সবকিছু সবাই জানে। ফেসবুকের কল্যাণে কিছু ঘটার সাথে সাথেই সে ঘটনার কথা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। এরকম একটা কিছু যে হতে পারে আমরা কি অল্প কিছুদিন আগেও সেটা জানতাম? ভবিষ্যতে আরও কিছু কী ঘটতে পারে সেটা এখন আমরা কল্পনাও করতে পারছি না।

যারা এই লেখাটি পড়েছে তারা নিশ্চয়ই আবিষ্কার করে ফেলেছে আসলে এখানে অস্ট্রেলিয়ার কোনো কথা নেই। এখানে সবকথা অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাঙালিদের কথা। আসলে কেউ যদি কয়েকদিনের জন্য কোনো দেশে যাই, তাহলে সে দেশকে সত্যিকার অর্থে অনুভব করার কোনো সুযোগ থাকে না। একটা দেশকে অনুভব করতে হলে সে দেশে দীর্ঘদিন থাকতে হয়। তখন সে দেশের বাহ্যিক চকচকে দৃশ্যের পেছনের গ্লানিগুলো চোখে পড়ে, ব্যর্থতাগুলো দেখা যায়।

যারা সে দেশে থাকেন তাদের কাছে একটা তথ্য পেয়েছি যেটা আমাকে অবাক করেছে। স্কুলের লেখাপড়া নিয়ে অভিভাবকদের মাঝে এক ধরনের হতাশা। হতাশার মূল কারণ সেখানে যথেষ্ট ভালো শিক্ষক নেই। শিক্ষকের বিশেষ অভাব বিজ্ঞান, গণিত এসব বিষয়ে। সমস্যার সমাধান হবে সেরকম আশাও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রছাত্রী নেই। প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই এই বিষয়গুলোই তুলে দেওয়া হচ্ছে! শুনে মনে হয় হুবহু আমাদের দেশের কাহিনী।

এত সম্পদ নিয়েও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ হিমশিম খাচ্ছে। তাহলে আমরা কেন অভিযোগ করছি? শিক্ষার পেছনে জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ খরচ করে আমরা তো খুব খারাপ করিনি! আরেকটু বেশি হলে না জানি কী হতো! অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যা দুই কোটি। আর আমাদের দেশে স্কুলেই পড়ে তিন কোটি বাচ্চা কাচ্চা। সরকার যদি লেখাপড়ার গুরুত্বটা বুঝে সেনাবাহিনীর বাজেট না বাড়িয়ে শিক্ষার বাজেট বাড়াতো তাহলে এই দেশে কী বিপ্লব ঘটে যেতে পারতো কেউ কী কখনো কল্পনা করে দেখেছে?

৫.
শুরুতে বলেছিলাম বিষুব রেখা অতিক্রম করার একটা উদ্দেশ্য ছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে পৃথিবীর উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটি দেখা। সেটা দেখে এসেছি- কী চমৎকার সেই নক্ষত্র। মনে হচ্ছে গভীর মমতা নিয়ে সেটি আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে!

মুহম্মদ জাফর ইকবাল: অধ্যাপক, লেখক, কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০১৩
এমএনএনকে/এসই/কেএইচ/পিসি/এএ/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।