ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মাকে কখনো গান গাইতে শুনিনি

ফওজিয়া খোন্দকার ইভা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৩

" আমার মাকে কখনো গান গাইতে শুনিনি " লিখেছিলেন শামসুর রাহমান । আমিও আমার মাকে কখনও গান গাইতে শুনিনি।

শুনিনি দরাজ গলায় আবৃত্তি করতে, অথবা বন্ধুদের সাথে গল্পে মেতে উঠতে । একান্ত নিজের জন্য একটু সময় দেবার মতো সময় ও তাঁর ছিল না। সবটা সময় জুড়েই জড়িয়ে ছিল তার সন্তান ও সংসার। সব সন্তানের কাছেই তার মা হয়তো শ্রেষ্ঠ মা। কিন্তু আমার মা যে এক অন্যন্য মা ছিলেন তা প্রতি মূহূতে পল অনুপল অনুভব করি । আমার মা সুরাইয়া খোন্দকার জন্মেছিলেন ১৯৩৪ সালে। লেখাপড়া শেষ করতে না পারার কষ্ট তাকে ভীষণভাবেই পীড়া দিতো। সে কারণেই সেই কিশোর বেলা থেকেই মার কাছে নিজের পায়ে দাড়াবার, সাহসী হবার শিক্ষা পেয়েছি। মানুষকে ভালবাসার যে মন্ত্র তা মাই শিখিয়েছেন। সব বয়সের, সব শ্রেনীর, সব লিঙ্গের মানুষের প্রতি যে মমত্ব বোধ তা মায়ের কাছ থেকে অর্জন করেছি । হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে নয়, মায়ের জীবন দেখেই মানুষকে ভালবাসতে শিখেছি। শিখেছি " সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর নাই "। আজ যখন তিনি জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক দূরে তখন তাঁর অনুপস্থিতি অনুভব করি সর্বক্ষণ। হৃদয়ের এ পাড় থেকে ওপাড় জুড়েই তাঁর স্মৃতি। কারো কাছে ঋজু বা নত হওয়া নয় বরং যোগ্যতা ও কাজ দিয়ে নিজকে তৈরী করার বিষয়টি ও মা -বাবার কাছেই শেখা। যে কারণে কাউকে তোষামোদ করতে পারিনা। অপ্রয়োজনে কারো সম্পর্কে বাড়িয়ে বলতে পারিনা। বেশীর ভাগ বাঙ্গালী নারীকে যে রমণীয় ( খুব নেতিবাচক শব্দ) হতে পরিবার শেখায়, আমাদের মা কখনই আমাদের সেরকম রমণীয় হতে বলেননি। বরং ছবি আঁকা, সাইকেল চালানো, ব্যাডমিন্টন খেলা, রেডিওতে অনুষ্ঠান করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। উপার্জন করবো, নিজের একটা আলাদা পরিচয় হবে এই ভাবনার শুরু মায়ের ভাবনা থেকেই। সেই ছোটবেলা থেকেই একজন ইতিবাচক মানুষ হবার দিক্ষা পেয়েছি মায়ের কাছে। মা নিয়মিত নামাজ পড়তেন। মাথায় একটা ঘোমটা ও থাকতো। অথচ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনে মা/ বাবা আমাদের বাধ্য করেনি , চাপও দেননি । স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে শিখিয়েছেন । মাকে দেখেছি সময় পেলেই বই হাতে। সংবাদ পত্রের এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত না পড়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি হতো না। মা টিভি দেখে খুব সময় কাটাতেন না । বরং অনেক বেশী সময় দিতেন বই পড়ার পেছনে। আর সব মায়েদের মতো আমাদের লেখাপড়ার শুরুটা তাঁর কাছেই।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে জন্ম ও বড় হবার কারণে আমাদের সকল বোন ও ভাইয়ের বন্ধুদের আড্ডার জায়গা ছিল আমাদের বাড়ী । ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প ও আড্ডা চলছে আর তার সাথে চা, মুড়ি, নাস্তার যোগান মা কি করে দিতেন তা আজও অবাক করে । সবার জন্যে রান্না করতে ও খাওয়াতে ভীষণ ভালবাসতেন । আজ যখন আমিও মা, কিশোর বয়স ও যৌবন পেরিয়ে নিজের দিকে তাকাই তখন বুঝি আমার মধ্যে নারী অধিকারের সচেতনর বীজটি আমি তাঁর কাছ থেকেই প্রথম অর্জন করি। আমার সেই মা আমার কাছে একজন বড় নারীবাদী। কেননা নারীবাদ আমাদের র্মযাদাবান, অধিকার সচেতন ও স্বধীন মানুষ হবার কথা শেখায় । মেয়ে বা নারী হিসেবে নিজের অধিকারের বিষয়ে জানা ও বোঝার গুরু কিন্তু মা । আমার মায়ের নারীবাদ সম্পর্কে ভাল ধারনা না থাকলেও সে কাজটি তিনি নিরবে করে গেছেন। আজ ১৫ অক্টোবর মায়ের মৃত্যু দিবসে আমার সমস্ত ভালবাসা তোমার জন্য ! তোমার জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলী মা ! লেখক: জেন্ডার বিশেষজ্ঞ

বাংলাদেশ সময় ০৯৩৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৩
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।