ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

গিয়াস কামাল চৌধুরী: এক মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণ

অধ্যক্ষ আলী আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১৩
গিয়াস কামাল চৌধুরী: এক মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণ

সাংবাদিক জগতের কিংবদন্তি, সদা তৎপর কর্মযোগী এক আলোকিত মানুষ সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী। সম্প্রতি রাজধানীর একটি ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

 

সাংবাদিকতার অঙ্গনে, দেশ ও জাতির নানা সংগ্রামে, সংকট উত্তরণে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তার অংশগ্রহণ অনুপ্রাণিত করতো তার অনুজদের। তিনি চলে গেছেন কিন্তু পেছনে রেখে গেছেন কর্মময় জীবনের আলোকবর্তিকা। যা একজন আদর্শ কর্মী হিসেবে তার অনুসারীদের পথ দেখাবে।

মৃত্যু জীবনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। মৃত্যুর কারণ যাই হোক- মৃত্যু মৃত্যুই। তার পদচারণায় আর কখনো মুখরিত হবে না জাতীয় প্রেসক্লাব অঙ্গন। শোনা যাবে না তার কণ্ঠ। কোনো সভা সমিতি, সেমিনার, সমাবেশ ও মিছিলের অগ্রভাগে আর দেখা মিলবে না তার।

সংবাদপত্র সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে গিয়াস কামাল  ছিলেন অগ্রসেনা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলনেও তিনি অকুতোভয় নেতা। একনায়কত্ব, স্বৈরাচার, আগ্রাসন ও ঘৃণ্য আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনেও কঠোর ও আপোষহীন ভূমিকা রেখেছেন তিনি।

সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জগতের বাইরেও সব শ্রেণি পেশার মানুষ তার কাছে সমান মর্যাদায় সমাদৃত হতো। এজন্য গিয়াস কামাল চৌধুরীর মৃত্যুতে ব্যাথিত ও শোকাহত সর্বস্তরের মানুষ।

সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী ১৯৩৯ সালের ২১ জুলাই ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। দীর্ঘকাল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন গিয়াস কামাল।

ঢাকা টাইমস পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা জীবন শুরু করেন তিনি। এরপর তিনি তৎকালীন মর্নিং নিউজ এ কাজ করেছেন। পরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগদান করেন। বাসসে যোগদানের পর বাসস’র কার্যক্রম দেশে ও বিদেশে সম্প্রসারিত হয়।

এছাড়া ভয়েস অব আমেরিকার ঢাকা সংবাদদাতা হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার বলিষ্ঠ ভূমিকায় প্রকম্পিত ছিল স্বৈরশাসকের ‘তখত-ই তাউস’।

ছাত্রজীবন থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন তৎপর। পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতি, পূর্ববাংলার স্বায়ত্ব শাসন, মৌলিক অধিকার, সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আদায়ে তিনি যেমন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিক দলন ও সংবাদপত্র প্রকাশের বিরুদ্ধে সরকারের দমন নীতির বিরুদ্ধের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।

চোখে না দেখা গেলেও  ভয়েস অব আমেরিকায় তার কণ্ঠে আন্দোলিত হতো এদেশের শহর-বন্দর, হাট-ঘাট, প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ। ‘গিয়াস কামাল চৌধুরী, ভয়েজ অব আমেরিকা, ঢাকা’ বাক্য সারা দেশের মানুষের খবরের তৃষ্ণা মেটাতো।

সাংবাদিক হিসেবে যেমন নিষ্ঠাবান ছিলেন গিয়াস কামাল চৌধুরী, তেমনি দায়িত্ব পালন করেছেন দেশ ও জাতির জন্য। ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে তিনি সারাজীবন মানবতা ও মনুষ্যত্বের জয়গান গেয়েছেন।

সাংবাদিকতার পেশার দায়িত্ব পালন ছাড়াও তিনি এর প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাবের কয়েকবার নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি বাসস পরিচালনা বোর্ডের নির্বাহী সদস্য ও সার্ক সাংবাদিক ফোরাম এবং বিদেশে সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন।

সেবামূলক কাজের জন্য তিনি জীবনে বহু সম্মাননা সূচক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদক প্রাপ্ত হন।

গিয়াস কামাল ছিলেন একটা জ্ঞান ভাণ্ডার । জ্ঞানের যেকোনো শাখায় তার ছিল অবাধ পদচারণা। সংবাদিকদের সম্পর্কে তিনি বলতেন, একজন সত্যিকার সাংবাদিকের কোনো বন্ধু নেই (A real journalist has got no friend)।

সাংবাদিকতা একটা মহান পেশা। বিপদগ্রস্ত মানুষ যখন আদালতেও বিচার পায় না তখনই তারা শেষ অবলম্বন হিসেবে প্রেসক্লাবের দারস্থ হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় সাংবাদিক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় তিনি এমন কথাই বলতেন। তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের শিক্ষক-মহাগুরু।

রাজনৈতিক মতাদর্শে তিনি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর শিষ্য। তিনি শের-এ বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তাদের এ দেশের মানুষের প্রকৃত নেতা মানতেন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতি ও সত্যাদর্শবাদকে তিনি বিশ্বাস করতেন।

তার মৃত্যুতে শুধু সাংবাদিকতার অঙ্গনেই শূন্যতার সৃষ্টি হয়নি, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতাও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামেও এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি হলো। গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল দূর্নীতি, আগ্রাসন মুক্ত সত্যিকার স্বাধীন বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ হবে কৃষকের, শ্রমিকের, কামারের, কুমোরের, মুটে আর মজুরের এক কথায় সব মানুষের। এই অতৃপ্ত কামনা নিয়েই তিনি চলে গেলেন সব দায়িত্ব তার অনুসারীদের উপর রেখে।

মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ১ পুত্র, ২ কন্যা এবং অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।

গিয়াস কামাল চৌধুরীর মৃত্যুতে সমগ্র জাতি এক মহান ও সাহসী দেশকর্মীকে হারালো। তিনি বেঁচে থাকবেন তার কর্ম ও আদর্শের মাঝে।

লেখক: অধ্যক্ষ আলী আহমেদ
শিক্ষাবিদ ও খুলনা থেকে প্রকাশিত দৈনিক অনির্বাণ সম্পাদক।
ইমেইল- [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১৩
এসএটি/জিসিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।