বাংলানিউজে ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর ‘নোবেল ফর হুমায়ূন’ শিরোনামে এক আহ্বানমূলক নিবন্ধ লিখেছিলাম। লেখাটিতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়।
যদি একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর বন্ধুসংখ্যা ২০০ হয়, তাহলে খুব সহজেই অনুমান করতে পারি, আহ্বানটি লক্ষাধিক লোকের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে গিয়েছিল।
স্বল্পতম সময়ের মধ্যে যশোরের ছেলে আল আমীন কবীর ‘Nobel For Humayun’ নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুললেন। আমি তাঁকে চিনতাম না, জানতাম না। তিনি মেইল করে বিষয়টি জানালেন। তাঁর মতো এমন শতাধিক ব্যক্তি আমাকে ই-মেইল করেছেন। শুধু জানতে চেয়েছেন, করণীয় কী? ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে বাংলানিউজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। লেখাটিকে দুই দিনব্যাপী প্রধান সংবাদ শিরোনাম হিসেবে রেখেছিল। এমনকি প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতার খবরও দ্বিতীয়, তৃতীয় শিরোনাম হিসেবে রেখেছে।
যদিও সময়ের অভাবে লেখাটিতে অতটা তথ্য-উপাত্ত দিতে পারিনি।
কেন জানি মনে হয়েছিল, হুমায়ূন আহমেদ একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জন্য কোনো তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন নেই। ওই লেখার নিচে মন্তব্যের জায়গায় অনেকে পাঠকই মন্তব্য করেছেন। বিশেষ আগ্রহ নিয়ে সব মন্তব্যই পড়েছি। অনেকে তিরস্কার করেছেন, আবার অন্য পাঠকরা তাঁদের সমুচিত জবাবও দিয়েছেন।
রিফাত নামের একজন পাঠক বেশ ভালো মন্তব্য করেছিলেন, ‘সহজ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেও নোবেল পুরস্কার পাওয়া যায়। যেমনটি এ বছর সুইডিস কবি ট্রান্সট্রোমার পেয়েছেন। রিফাত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজের উদাহরণও দিয়েছেন। তিনি ছোটগল্পের জন্য বিশেষভাবে খ্যাতিমান। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পে রবীন্দ্রনাথের পর অন্যান্যের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের নাম করলে নিশ্চয়ই অত্যুক্তি হবে না। তিনি শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন। রিফাত সরাসরি জিজ্ঞেস করেছেন, ‘বুকে হাত দিয়ে বলুন....হুমায়ূন আহমেদের কোন গল্পটি খারাপ?’
আমার আহ্বান যাঁরা পছন্দ করেননি, তাঁদের প্রতি আমি বীতশ্রদ্ধ হই নি। তাঁদের যুক্তি, হুমায়ূন আহমেদ নাকি বড় মাপের কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। তাঁদের মতামতের পক্ষে দু-একটা যুক্তিও দিয়েছেন। এ ছাড়া তাঁদের মতে বাংলাদেশে শক্তিমান আরো লেখক আছেন। সেই সব লেখকের কথা ভাবা উচিত। হয়তো আছেন, হয়তো নেই। আমি সেই বিতর্কে যেতে চাই নি। আমার লেখায় প্রশ্ন রেখেছিলাম: আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কারো নাম কোনো দিন প্রস্তাব করা হয়েছিল কি না?
যদি করা হয়, তাঁরা কোন কোন লেখক? যদি না করা হয়, তাহলে করা হয়নি কেন? প্রিয় লেখক সৈকত হাবীব তাঁর মন্তব্যে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্য। সৈকত হাবীবকে লিখেছিলাম, স্বাগতম সৈকত ভাই। ইস্যু ইজ অন দ্য টেবিল, লেটস স্টার্ট টু থিংক অ্যাবাউট ইট। আপনার সঙ্গে আছি। আমি শুধু বলতে চেয়েছিলাম, ‘স্বদেশীদের চেষ্টায় এবং অবশ্যই নিজগুণে ভারতের লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর নাম একবার নোবেল কমিটির সংক্ষিপ্ত তালিকায় এসেছিল। সেটাও কম মর্যাদাপূর্ণ নয়। সত্যজিৎ রায়ের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। জীবনের শেষ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী কয়েকজন বাঙালির প্রচেষ্টায় তাঁর হাতে অস্কার পুরস্কার ধরা দিয়েছিল। তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন, সম্মানিত হয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্র তথা পুরো ভারতবাসী। ’
আমার বিশ্বাস ছিল, প্রবীণরা যদি কালের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তরুণ প্রজন্ম ব্যর্থ হবে না। যদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের তরুণরা আরব্য রজনীর অচলায়তন ভাঙতে পারে, তাহলে বাংলাদেশের তরুণরাও পারবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় বিশ লাখ এবং প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। বয়সে তারা অধিকাংশই তরুণ। বিপুল সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্ম। তাই আহ্বান করছিলাম, একটি জাতীয় গৌরবের সম্ভাবনা, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। যদি বাংলাদেশের লাখো তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আজকাল ফেসবুক ও টুইটারের জনপ্রিয় ইস্যু সারা বিশ্বের সংবাদ শিরোনাম হয়। তরুণরা যদি ‘নোবেল ফর হুমায়ূন’ নামে একটা ফেসবুক কিংবা টুইটার অ্যাকাউন্ট খুলে আন্দোলন শুরু করে, তাহলে লাখো মানুষের সমর্থন পেতে দেরি হবে না। তাই ডাক দিয়েছিলাম, আসুন, নিজ দেশের মানুষকে সম্মানিত করি, নিজেরাও সম্মানিত হই। যোগাযোগ, প্রমোশন এবং লবিং অনেক ধরনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে। পাকিস্তানের মালালার মতো এক কিশোরীর ঘটনা তার বড় প্রমাণ।
দুই দিন পর ২০১১ সালের ২২ অক্টোবর বাংলানিউজে এ ‘নোবেল ফর হুমায়ূন, অতঃপর’ শিরোনামে আরো একটি নিবন্ধ লিখলাম। ওই লেখাটিতে হুমায়ূন বিরোধীদের লেখাজোখার প্রতিত্তোরে লিখলাম, ‘একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে রবীন্দ্রনাথের লেখার অংশবিশেষ তুলে দিয়ে বলা হতো ‘শুদ্ধ করিয়া লিখো’। যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন, তখন তাঁদের মুখে কুলুপ এঁটেছিল। সেই কুলুপ খুলতে আজ পর্যন্ত কেউ সাহস পায়নি। আমাদের দেশেও নিন্দামগ্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী (যাঁরা জীবনব্যাপী অন্যের নিন্দা-মন্দে জাতিকে বিভক্ত-বিচ্ছিন্ন করিতে শশব্যস্ত) কুবুদ্ধিজীবীর কোনো অভাব নেই। তাঁরা অন্যের প্রাপ্য কেড়ে নিতে, অন্যের বাড়া ভাতে ছাই দিতে উন্মুখ। তাঁরা ‘সিটি অব মোসাহেব’, ‘কিংডম অব চাটুকার’-এর রাজকবি, বুদ্ধিজীবী। মানুষের নিন্দা করিয়া কাউকে আনন্দ করিতে দেখিলে বিস্মিত হই না। মানুষ তো মানুষ হত্যা করিয়াও উল্লাস করে। আমি তাদের দলে নই। ’
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে যাঁরা ভালো কিছু খুঁজে পান না, তাঁদের জন্য উদ্ধৃত করছিলাম সৈয়দ শামসুল হকের লেখা নিবন্ধ ‘হৃৎকমলের টানে’। হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প ‘চোখ’ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘বস্তুত হুমায়ূন তাঁর প্রতিভাবান কলমে এমন এক পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন, যা আমাদের ভাবিয়ে তোলে এবং বাধ্য করে নতুন করে সংজ্ঞা নির্ণয় করতে যে কাকে বলে নৃশংসতা, আর কাকেই বা বলে বিচার এবং কীই-বা আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে আমরা সকলেই কী ভীষণ ও ভয়াবহ রকম উদাসীন জীবন ও মানবিকতা সম্পর্কে। কোনো রকম মন্তব্য না করে, মিথ্যা আবেগে আপ্লুত না হয়ে, হুমায়ূন আহমেদ এই যে গল্পটি লিখেছেন, এই একটি গল্পেই তীব্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এ কোন দেশ ও কালে আমরা বাস করছি। আমি মনে করি, সাম্প্রতিককালের বহু ছোটগল্পের ভেতরে এটি একটি প্রধান রচনা এবং বারবার পঠিত হওয়ার মতো লেখা। ’
আমার আহবানের ভাষা ছিল নিন্মরূপ, ‘প্রিয় পাঠক, আপনাকে, হ্যাঁ, আপনাকেই আহ্বান জানাচ্ছি। আপনি হতে পারেন একজন সচেতন পাঠক, প্রিন্ট অথবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার একজন সাংবাদিক। হতে পারেন অধ্যাপক কিংবা সুশীল সমাজের কেউ। আপনি যে-ই হন, আপনাকেই আমাদের প্রয়োজন। কোনো বড় কাজ একা করা যায় না। আপনার সহযোগিতা প্রয়োজন। খুবই প্রয়োজন। এগিয়ে আসুন। পরামর্শ দিন। অংশগ্রহণ করুন। আপনার পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুকেও বলুন। যে যেখানে পারেন লিখুন, হোক সেটা দেয়ালে, মুঠোফোনের মেসেজে, ফেসবুকে, ব্লগে কিংবা পত্র-পত্রিকায়। ফেসবুক অ্যাকাউন্ট অথবা অন্য যেকোনো নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করুন। গড়ে তুলুন একটা সামাজিক আন্দোলন। জেনে যাক দেশ, নড়ে উঠুক পৃথিবী....আরেকবার। আরেকবার....। ’
দ্বিতীয় লেখাটি প্রকাশের পর হুমায়ূন আহমেদের পরিবারের একাধিক সদস্য আমার সঙ্গে ফেসবুকে, ট্যুইটারে এবং ইমেইলে যোগাযোগ করেন। তারা হুমায়ূন আহমেদ রচিত যেসব বই তখন পর্যন্ত ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছিল সেসব বইয়ের তালিকা পাঠালেন এবং শীঘ্রই বইগুলো পাঠানোর আশ্বাস দিলেন। আমি প্রতিদিন উজ্জীবিত থেকে আরো উজ্জীবিত হচ্ছি। ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেটে নোবেল বিজয়ী জীবিত কবি লেখকদের ইমেইল, ফোন নাম্বার, ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট সংগ্রহ করলাম। প্রথম ধাপেই তুর্কী লেখক ওড়ান পামুক, সুইডিস কবি ট্রান্সট্রোমার এবং রোমানিয়ান কবি ও লেখিকা হারতা ম্যূলারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বিশ্বখ্যাত কবি লেখকরা হুমায়ূন আহমেদের লেখা পড়তে চাইলেন। ঠিক তখনই ঘটনা ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে গেল। শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ এ বিষয়ে এক জাতীয় দৈনিকে লিখলেন, ‘Nobel For Humayun’ ক্যাম্পেইনটির পক্ষে বিপক্ষে নানা রকম লেখালেখির কারণেই হোক আর প্রচারবিমুখতার কারনেই হোক, শ্রদ্ধেয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার নিবন্ধে পরিষ্কারভাবে ‘Nobel For Humayun’ ক্যাম্পেইনে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে আমরা ক্যাম্পেইনটি স্থগিত করে দিতে বাধ্য হই।
পাদটিকা: হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুবরণ করার পর এমন অনেক কবি লেখককে মিডিয়াতে হুমায়ূন সাহিত্যের প্রশংসা করতে দেখেছি, যারা সারা জীবন হুমায়ূন আহমেদের লেখার ভয়াবহ সমালোচনা করেছেন। যখনই সেই সব কবি লেখকদের কোনো টেলিভিশনে কথা বলতে দেখেছি কালবিলম্ব না করে চ্যানেল পরিবর্তন করে ফেলেছি। ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। মিডিয়াগুলি অনেক কিছু ছাপাবে, অনেক কিছু দেখাবে। মিডিয়ার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, ওই সব হিপোক্রেট কবি লেখকদের দয়া করে আনবেন না। হুমায়ূন আহমেদের পাঠকরা তাদেরকে ভালো করেই চিনে। চ্যানেল পরিবর্তন করতে বাধ্য করবেন না, প্লিজ।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া, ইমেইলঃ [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৩
জেডএম/জিসিপি