খবরে কাগজে দুটো শিরোনাম দেখে বার বার ঔপনিবেশিক আমলের কথা মনে হচ্ছিলো। শিরোনাম দুটো অনেকটা এরকম- বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে কর্মরত বিদেশিরা দেশীয়দের চেয়ে ৩০গুণ বেশি বেতনে চাকরি করে।
অন্যদিকে, প্রায় বেশিরভাগ খবরের কাগজে দেখলাম নিউইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশ নিয়ে কোনো এক সম্পাদকীয় ছাপিয়েছে, সেটি পত্রিকাগুলোর শিরোনামও হয়েছে। এই দুটো খবর আপাতদৃষ্টে একদমই ভিন্ন মনে হলেও আসলে এর মধ্যে বেশ যোগসূত্র রয়েছে। লেখার পরের অংশে সেটি ব্যাখ্যা করা যাবে।
পলাশীর যুদ্ধের সেই বিশ্বাস ঘাতকদের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? হঠাৎ করে শত বছর আগের ইতিহাসে ফেরত যাওয়াতে অবাক হচ্ছেন, তাই তো? ওই যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমেই কিন্তু আমাদের শত বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থাকে মেনে নিতে হয়েছিলো। আর কে জানে হয়তো এই জন্যই আমাদের মধ্যে এক ধরনের ঔপনিবেশিক মানসিকতা গড়ে উঠেছে। এই যেমন ধরুন আপনি কিছু একটা কিনতে গেলেন, দোকানি হয়তো বলে বসবে এটা বিদেশি তাই দাম একটু বেশি। আর আপনিও বিদেশি জিনিস ভালো ভেবে চড়া দামে কিনে নিয়ে আশপাশের সবাইকে হয়তো আচ্ছামতো বলে বেড়াবেন, কাল না একটা বিদেশি জিনিস কিনলাম।
কিংবা ধরুন আপনি একটি নতুন কোম্পানি খুলবেন, তো আপনার একজন এক্সপার্ট দরকার। আপনার যদি সামর্থ্য থাকে আপনি প্রথমেই ভাববেন দেশের বাইরে থেকে ভিনদেশি একজন এক্সপার্ট আনতে হবে। হয়তো ওই বিষয়ে দেশেই অনেক ভালো ভালো এক্সপার্ট রয়েছে, তারপরও আপনি ওই বিদেশি এক্সপার্টের পিছনেই অর্থ ব্যয় করবেন। এছাড়া জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই কিন্তু আমরা এ ধরনের বিদেশ প্রীতি দেখিয়ে থাকি। আমারতো মনে হয় আমরা অনেকেই এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর এই চিন্তা-ভাবনা আমরা আসলে পেয়েছি ওই ঔপনিবেশিক শাসন আমল থেকেই, যখন কিনা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ কর্ম থেকে শুরু করে উপরের সারির সব কিছুই সাদা চামড়ার কিছু বিদেশি শাসকগোষ্ঠী করে থাকতো। আর এসব দেখে আমাদের মধ্যেও এই ধারণা চলে এসেছে, যা এখনো দূর হয়নি।
এবার আসা যাক আমাদের মিডিয়া বা গণমাধ্যমগুলোতে। একটা সময় ছিল যখন দেশের বেশির ভাগ মানুষকে হয়তো ভারতীয় আকাশবাণী কিংবা পরবর্তী একটা সময়ে বিবিসি বাংলা রেডিওর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। এর মূল কারণ হয়তো ছিল দেশে সংবাদমাধ্যমগুলো সে অর্থে স্বাধীনতা ভোগ করতো না। এছাড়া ছোটখাটো আরও কিছু সমস্যা তো ছিলই। কিন্তু গত দশ বছরে আমাদের গণমাধ্যমগুলোতে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো বেশ ভালোই স্বাধীনতা ভোগ করছে। আর বেসরকারি ক্ষেত্রে তো রীতিমতো বিপ্লবই হয়ে গেছে। কে কার আগে সংবাদ প্রচার করতে পারবে, কে কতো ভালোভাবে সেটিকে তুলে ধরতে পারবে, এরকম একটা প্রতিযোগিতা যেন লেগেই আছে। আর সুস্থ প্রতিযোগিতা হলে যা হয়, সেটিই হয়েছে । দেশের মানুষ এখন দেশীয় সংবাদ মাধ্যমেই চোখ রাখে বেশি। এর মধ্যেও একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়, আর সেটি হচ্ছে ওই যে বললাম, ঔপনিবেশিক মানসিকতা।
যদিও দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে আমরা চোখ রাখছি বেশি, কিন্তু একই সঙ্গে দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো এবং দেশের মানুষ জন দেশের কোনো খবর যদি বিদেশের কোনো খবরের কাগজে প্রকাশ প্রায় তাহলে সেটিকে অনেক বড় করে দেখে। এই যেমন ধরুন, নিউইয়র্ক টাইমস কিংবা সানডে টাইমস পত্রিকা যদি বাংলাদেশ নিয়ে কিছু লেখে, তাহলে দেশীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতে সেটা ফলাও করে প্রচার করা হবে। আর মানুষও সেই খবরগুলো বিশেষ গুরুত্ত্বের সঙ্গেই নেয়। আর এনিয়ে বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। অর্থাৎ, এখানেও কিছুটা ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রকাশ কিন্তু দেখতে পাওয়া যায়।
‘থিঙ্কিং ফ্রম দ্যা বিলো’ বলে একটা কনসেপ্ট আছে। এর অর্থ হচ্ছে নিচ থেকে চিন্তা করতে হবে। আরও ভালোভাবে যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে ব্যাপারটি আর কিছুই না, আপনি যাদের নিয়ে কথা বলছেন বা যে বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, তাদের কথা বা মতামতকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। আর তাহলেই আপনি প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বা নিশ্চিতভাবেই একটা বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে পারবেন। এখন যে মানুষটি আমাদের ভাষায় কথা বলে না, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে সেই অর্থে ধারণা নেই। শুধু দেখে, শুনে বা পড়ে যদি একটা মতামত দেয় সেটি কেনো আমরা বিশ্বাস করতে যাবো? যেখানে পশ্চিমা দেশগুলো আজকাল এই ‘থিঙ্কিং ফ্রম দ্যা বিলো’ কনসেপ্টে ভর করে নিজেদের দেশের সমস্যাগুলো সমাধান করছে, সেখানে আমরা এর বিপরীতে অবস্থান করে সমস্যাকে কাছে টেনে নিচ্ছি।
বুধবার নিউইয়র্ক টাইমস একটি সম্পাদকীয় ছাপিয়েছে। এতে বলা হয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। এর কারণ হিসেবে মানবাধিকার কর্মীদের উপর হয়রানি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে তাদের এই মাথা ব্যথার কারণ কি? কিংবা তাদের যদি মাথাব্যথা হয়ও সেটি আমরা কেন এত ফলাও করে প্রচার করছি কিংবা আমাদেরই বা এত মাথা ব্যাথা কেন?
এবারে আসা যাক বাংলাদেশ বিমানের বিদেশি কর্মীদের বেতন নিয়ে। খবরে বলা হচ্ছে বিদেশি কর্মকর্তারা বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের প্রায় ৩০ গুণ বেশি বেতন পায়। অর্থাৎ বাংলাদেশিরা পুরো মাসে যে বেতন পায় তারা সেটি এক দিনে পেয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে এর দায়তো আমাদের। নিজেরা মিলেমিশে বিমানকে লাটে তোলার কারণেই তো তাদের ডেকে আনা হয়েছে। নিজেরা পারলেতো আর ওদের ডাকা লাগতো না।
আবার অনেককে বলতে শুনেছি আমাদের দেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে অনেক সময় লোকজন দেশি বস বা অফিসার পছন্দ করে না। কারণ, সেই টিপিক্যাল মানসিকতা। দেশি বসরা ভালো হয়না, একজন আরেকজনের পিছে লেগে থাকে।
কীভাবে অন্যদের ছোট করা যায় এসব কারণে অনেক সময় কোম্পানিগুলো বিদেশি কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। তবে বিষয়টিকে যদি আরও বড় আঙ্গিকে দেখা যায় তাহলে পুরো দেশ বা দেশ যারা চালাচ্ছে কিংবা বিরোধীদলে যারা থাকছে তারাও তো সেই গতানুগতিক রাজনীতি করে যাচ্ছে। একদল আরেক দলের পিছে লেগে আছে। তাই বলে কি আমরা এখন বিদেশি শাসকদের ভাড়া করে নিয়ে আসবো? এটি তো নিশ্চয়ই আমরা কেউই চাইবো না।
আসলে সমস্যা হচ্ছে নিজেদের বিচক্ষণতা এবং রাজনৈতিক অসাড়তা। যার কারণে আমাদের দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দলগুলোকে যেমন বিদেশি দেশগুলোর কাছে ধর্না দিতে হয়, ঠিক তেমনি বিদেশি পত্র-পত্রিকাগুলোও আমাদের নিয়ে ইচ্ছেমতো লেখা প্রকাশ করতে পারে। আর সেই লেখা নিয়ে আমরাও মাতামাতি শুরু করি। নিজেরা যখন নিজেদের সম্মান করতে শিখবো তখন নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস তৈরি হবে। আর তখন আমাদের আর কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না। আর এটি যদি সম্ভব হয় তাহলে বিদেশী কর্মকর্তাদের যেমন বেশি বেতনে রাখতে হবে না, ঠিক তেমনি বিদেশি পত্রিকা কিছু একটা লিখলেই সেটি দেশি পত্রিকার শিরোনামও হবে না।
লেখক: আমিনুল ইসলাম
শিক্ষক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৩
এএ/জিসিপি