ঢাকা, রবিবার, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৯ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

টকশোতে পৌষের হাওয়া!

তুষার আবদুল্লাহ, পরিচালক (বার্তা), সময় টেলিভিশন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
টকশোতে পৌষের হাওয়া! ছবি: প্রতীকী

টিভি টকশোতে নাকি পানি ঢেলে দেয়া হয়েছে? প্রশ্নটি টেলিফোনে, ফেইসবুকে এবং সরাসরি শুনতে হচ্ছে ইদানীং। প্রশ্নকর্তারা টকশো’র সম্মানিত দর্শক।

তাদের অনুযোগ, কিছুদিন আগেও টকশো’র যে উত্তাপ ছিল, সেই উষ্ণতা তারা পাচ্ছেন না। চুপসে গেছে টকশো। দর্শকদের পর্যবেক্ষণ-টকশোতে একধরণের আপসের আবহ লক্ষ্য করছেন তারা।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর টকশো’র একটা কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে। যেখানে অতিথিদের এনে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়। আওয়ামী-বিএনপি’র রাজনৈতিক নেতা বা ঐ দুইপন্থী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে আসা, এবং তাদের সংগে একজন মধ্যপন্থী বা আপাত নিরপেক্ষ কোনো অতিথিকে বসিয়ে এই ভারসাম্য রক্ষার নিরন্তর চেষ্টা করে আসছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো।

এক-দু্ইটি টেলিভিশন আগা-গোড়াই টকশোতে এক পাক্ষিক আবহ বজায় রেখে চলেছে। এটা টেলিভিশনগুলোর নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতির বিষয়। যারা টকশো’তে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকছেন, তারা গত কয়েক বছরে টকশো’র বক্তা হিসেবেও পেশাদারিত্ব দেখাতে শুরু করেছেন। যখন যে চ্যানেল যে নীতিতে কথা শুনতে চায়, তারা সেই সুরেই কথা বলেন। কেউ কেউ রাতের টকশো’তে হাজিরা দেয়াটাকে নিয়েছেন পার্টটাইম কাজ হিসেবে। পরিচিত কিছু মুখই রাতে চ্যানেল থেকে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়। কোনো কোনো মুখকে একরাতেই দেখা যায় একাধিক পর্দাতে।

একাধিক পর্দাতে যারা বিচরণ করে বেড়ান, তাদের বিষয়ে দর্শকদের একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। তাদের দলকানা এবং সুবিধাজনক অবস্থানটাও দর্শকদের কাছে স্পষ্ট। তাই অনুষ্ঠানের শুরুতে অতিথি প্যানেল দেখেই দর্শকরা বুঝতে পারেন কে কোন দিকে অবস্থান নিয়ে কি বক্তব্য রাখতে পারেন। সেই অনুসারেই দর্শক সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন ঐ চ্যানেলের ঐদিনকার টকশো তিনি দেখবেন কিনা। দর্শকরা নতুন মুখ খুঁজে বেড়ান চ্যানেল থেকে চ্যানেলে। নতুন মুখ সব সময় পেয়ে যান, তা বলা যাবে না। নতুন মুখ থেকে বঞ্চিত হলে স্থির হোন সেখানেই, যেখানে কোনো অতিথি দলকানা অবস্থান থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলেন।

টেলিভিশন চ্যানেলের পক্ষ থেকে নতুন মুখ, অতিথি’র বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করা হলেও সেই চেষ্টা যে খুব একটা ফলদায়ক হয় তা বলা যাবে না। কারণ সরকারি-বেসরকারি উভয় ঘাটকেই চ্যানেলগুলোকে তুষ্ট করে চলতে হয়। সরকার টকশো’কে পরোক্ষভাবে তার প্রচারণার অংশ হিসেবে নিয়েছে। বিরোধী দলও তাই, তারাও চায় তাদের আন্দোলন, দাবি-দাওয়ার ঝড় উঠুক টকশোতে।

এনিয়ে চ্যানেলগুলোকেও এক প্রকার দোটানায় পড়তে হয়। তারা শ্যাম নাকি কূল কাকে রক্ষা করবে? সরকার চায় তার পছন্দের বা বিশ্বস্ত মানুষগুলোকে দিয়ে তার কাজের বন্দনা হোক। তাই তাদের পক্ষ থেকে অতিথি’র ফর্দ থাকে। তারা এমনটা চান যে বিপক্ষের যাকে আনা হবে তিনি যেনো একটু দুর্বল হন। তাহলে সরকারের গুণগান প্রাধান্য পাবে। অন্যদিকে বিরোধীদলও চায় তাদের পছন্দের বা ছায়াতলে থাকা নাগরিক প্রতিনিধিরা এসে কথা বলুক।

টকশো যেদিন যেদিকে হেলে পড়ে, রুষ্ট হয় তার বিপরীত পক্ষ। বিরোধীদলকে হয়তো চ্যানেলটির উপর গোস্যা করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু সরকারে যে রাজনৈতিক দলটি থাকে, তার অনেক ডালপালা থাকে। সেই ডালপালা ঝাপটানীতে দলটি চ্যানেল গুলোকে নমনীয় করার কৌশল আরোপ করার সুযোগ রাখে। কখনো কখনো সরাসরি নমনীয় করার অস্ত্র গুলোও ব্যবহার করতে থাকে।

সরকারের সংগে লড়াই করার অবস্থানে এদেশের কোন টেলিভিশন চ্যানেলেরই নেই। তাই তারা সরকারের দেয়া ফর্দ মেনে

চলার চেষ্টা করে মনোযোগী ছাত্রের মতো। এর মাঝেও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় কোন কোন চ্যানেল ফাঁকফোঁকর বের করে সরকারকে ফাঁকি দেয়ার।

এই মূহুর্তে টকশো নিয়ে গণমাধ্যমে তাই চলছে।

টকশোতে নিজের সমালোচনা শুনতে তৈরি নয় সরকার। তাদের কোনো ভুল হতেই পারে না। সরকারের সকল পদক্ষেপই শুদ্ধ। তাই সেই শুদ্ধতার কথা যারা বলবেন না, তাদের মেনে নিতে পারেননা তারা। কেবল বিরোধিতার খাতিরে নয়, সরকারের ভুল শুধরে দেয়ার জন্য কোনো সুপারিশ করলেও তা শুনতে নারাজ সরকার। তাই তাদের পক্ষ থেকে পরামর্শ(নিদের্শনা)থাকে বিশেষ বিশেষ কাউকে নিয়মিত টকশো’র অতিথি করার।

অন্যদিকে বিরোধীদলও মনে করে তাদের দাবি-আবদার এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনের সকল কৌশলই সঠিক। তাদের সহিংস কাজও হালাল। তাই এই কর্মকাণ্ড যারা সমর্থণ করবেন, তাদেরকেই টকশোতে দেখতে চান তারা। পরোক্ষ সুপারিশ থাকে সেই মতের মানুষগুলোকেই টকশোতে নিয়ে আসতে।

আগেই বলেছি তাদেরকে পাশ কাটানো যায়। সরকারকে যায় না। তাই উভয়পক্ষকে তুষ্ট করার যে ভারসাম্য তা রক্ষা করতে এরই মধ্যে চ্যানেলগুলো টকশো’র মুখগুলো বদলে ফেলতে শুরু করেছে। বদলে ফেলতে গিয়ে কোনো কোনো চ্যানেল নতুন মুখের দিকে ঝুঁকছে। তবে বেশিরভাগই তাদেরকেই বেছে নিচ্ছে যারা সমালোচনায় মুথর হবেন না। বিশেষ করে সরকারমনস্ক অতিথি আনার দিকেই ঝুঁকছে সবাই। কোনো কোনো চ্যানেলে উপস্থাপকও বদলে গেছে।

টকশো’র এই বদলে যাওয়া রূপটা দর্শকের চোখ এড়াতে পারে নি। কারণ টকশো’র উত্তাপ তাদের কণ্ঠে পৌঁছাচ্ছে না। দর্শকদের যাদের সংগে টেলিফোন, ফেইফবুক বা সরাসরি মুখোমুখি হই- তারাও ধরে নিয়েছেন রাজনীতির যে সংকটকাল চলছে, তা অতিবাহিত হওয়া পর্যন্ত টকশো’তে পৌষের হাওয়া বয়ে যাবেই। তবে দর্শকরা বলছেন, সরকার এবং বিরোধীদল যদি গণতন্ত্রমনস্ক হয় তাহলে টকশো’কে তারা আয়না হিসেবে দেখতে পারেন। সেই দেখার মানসিকতা তৈরি হলে প্রকৃত অর্থেই টকশো’তে ফাগুনের দিন ফিরে আসবে।

বাংলাদেশ সময় ১৫২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।