ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এ যেন আরেকবার জেগে ওঠা

সারা মনামী হোসেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৩
এ যেন আরেকবার জেগে ওঠা

ঢাকা: আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি স্বভাবতই তাদের এ বিষয়টি নিয়ে জানার খুবই আগ্রহ থাকে। আমরা ইতিহাসের অংশ হওয়া কারো কাছ থেকে সেই ইতিহাস জানতে চাই, আবার কখনও ইতিহাসের পাতা উল্টাই।

প্রতিটি মুহূর্তে বিচিত্র অনুভূতি তখন খেলা করে যেতে থাকে।

ভালবাসা, গর্ব, ঘৃণা, সবকিছু একই সাথে মনের মধ্যে আঁকিবুঁকি কাটে। ওই মুহূর্তে আফসোস হয়- আহ! কেন ওই সময়ে আমাদের জন্ম হয়নি!

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কেটে গেছে ৪২ বছর। অথচ এখনও আমাদের মাথার ওপর কালো ছায়া। যা গত ৪২ বছরে বেড়েছে, বৈ কমেনি! না পারি খেতে, না পারি গিলতে এমন নিয়মের যান্ত্রিকতায় নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছিলাম।

ভেবেছিলাম কোন একদিন এই অপচ্ছায়া দূর হবে। মাথার ওপর রোদ্দুর ভরা আকাশ দেখা যাবে এই আশায় পার করেছি দিনের পর দিন। কিন্তু সেই দিন আসতেও লেগে গেল এতগুলো বছর!

সম্প্রতি বাংলাদেশ তার ইতিহাসে নতুন একটি ইতিহাস সংযোজন করেছে। আর তা হল দায় মুক্তির ইতিহাস। এ যেন বাঙালীর আরেকবার জেগে ওঠা। সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এমন দিনের জন্য এখন আমাদের অপেক্ষা।

বইয়ের পাতা কিংবা সম্মুখ সমর থেকে উঠে আসা ইতিহাসকে বুকের মধ্যে লালন করে তরুণ প্রজন্ম আজ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। কে বলেছে যুদ্ধ তারা দেখেনি! তারা অবশ্যই দেখেছে- তাদের কল্পনায়, তাদের চেতনায়। সেইসব নির্মম দুঃসহ দিনগুলোকে ধারণ করেছে আপন অস্তিত্বে। যার প্রতিফলন দেখেছি তাদের প্রতিবাদ ও আন্দোলনে।

কিন্তু তবুও বিভক্তি থেকেই যায়। আমাদের আপন আপন সুতোগুলোর কোন কোনটি ছিঁড়ে আমাদের গাঁথুনিটাকেই দুর্বল করে তোলে। যার পরিণামে আমরা চারপাশে দেখি বিদ্বেষের বিষ। আর সেই বিষে লাভবান হয় এইসব অপচ্ছায়ার অধিকারীরা।

এতগুলো বছর পাশাপাশি বাস করার পরও আজও আমরা একে অপরকে ধর্মের নামে ভাগ করে ফেলি। শুধু এমনই নয়, এখন আমরা একই ধর্মের মানুষরাও বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। কেন? কারণ একদল চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক আর আরেকদল চায় সেটি না হোক।

আর তাই ধর্মপ্রাণ বাঙালীর সবচেয়ে স্পর্শকাতর অনুভূতি নিয়ে খেলা শুরু হয় আবারও। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল, এমন ইস্যুগুলো বিশ্বাস এবং আলোচনা করার মত মানুষ আমাদের দেশে আছে! এবং মোটামুটি ভাল সংখ্যাতেই আছে।

তারা আমাদের আশেপাশে থাকা সাধারণ মানুষেরই একটি অংশ। শিক্ষিত হোক বা না হোক, তারা চোখ বুজে বিশ্বাস করতে চায় চাঁদের বুকে ‘মানুষ’ দেখা যায়! তাদের পৈচাশিকতার ইতিহাস এক নিমিষে ক্ষমা করে দেয় ধর্মের দোহাই দিয়ে! আর না হলে বিশ্বাসই করতে চায় না ‘অমুক’ এমন করতে পারে!

সত্যি বড় বিচিত্র মানুষের বাস এই ভূখণ্ডে! ধর্মের দোহাইয়ে ত্রিশ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা- বোনের সম্মানকে পা মাড়িয়ে চলে যেতে যাদের কোন দ্বিধা নেই। ‘অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে’ - উভয় যে সমান অপরাধী বিষয়টি তারা বেমালুম ভুলে গেছে। সুতরাং এই পাপের ভাগিদার তারাও।

এদিকে বিশ্ব রাজনীতিও একে ঘিরে ফায়দা নেয়ার তালে আছে। আমরা জানি ১৯৭১ এ বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী ছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের পরিকল্পনায় এই যুদ্ধের গতি পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

সেই যুক্তরাষ্ট্র যখন দেশের পর দেশ ধ্বংস করে তখন জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান চুপ থাকে। তখন তাদের টুঁ শব্দটি পাওয়া যায় না। অথচ কাদের মোল্লার মত যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে তাদের তাদের মানবাধিকার বিষয়টি কীভাবে চলে সেটাই প্রশ্ন।

৩০ লাখ মানুষের হত্যায় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না। ৮ জন বাংলাদেশির শিরচ্ছেদেও তা লঙ্ঘন হয় না। লঙ্ঘন হয় একজন যুদ্ধাপরাধীর বেলায়। কিছুদিন আগে বিশ্বজিৎ দাশ হত্যা মামলা রায়ে ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তখন কিন্তু জাতিসংঘ লাপাত্তা! মানবাধিকার বিষয়ক কোন উচ্চবাচ্চ্য নেই। এখান থেকে আদতেই একটা সরল সমীকরণে পৌঁছানো যায়- বাংলাদেশের স্বাধীনতা এদের কাছে আজও চক্ষুশূল!
পাকিস্তান এক্ষেত্রে যা ভূমিকা রাখছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ৪২ বছরের ঘৃণা আর ক্ষত তারা ভালই বইয়ে বেড়াচ্ছে। যার প্রতিফলণ এখনও আমরা দেখতে পাচ্ছি। সাধারণ পাকিস্তানিদের অনেকেই এখনও হয়ত জানে না তার দেশ ১৯৭১ এ কী বীভৎসতা ঘটিয়েছিল।

আর এতদিন কাদের মোল্লার ব্যাপারে যারা বলেছে- এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা নয়। তারা নিজেরাই নিজেদের জালে ফেঁসে গেছে। খোদ পাকিস্তান সরকার এ বিষয়ে যেসব বিবৃতি দিয়ে চলছে, ‘পাকিস্তান আন্দোলনের সিপাহী’ বলে ঘোষণা দিয়েছে, রাজনীতিবিদ ও এক কালের বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটার ইমরান খান যা বলেছেন, সেইসাথে নেতারা সংসদে বিল পাস করাচ্ছে তাতে এই কাদের মোল্লা আসলে কে ভালভাবেই বোঝা হয়ে গেছে।

পাশাপাশি পাকিস্তান জামায়তে ইসলামীর সঙ্গে যে এখানকার দলের সংযুক্তি আছে তা এখন ভালভাবেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। এবং তারা যে এখনও তাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এটাও বোঝা যাচ্ছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার হুমকি দিয়েছে। কারণ তারা নাকি বাংলাদেশের এই রায়ে ক্ষুব্ধ। অর্থাৎ কাদের মোল্লা যে তাদেরও প্রিয় পাত্র ছিল তাও বুঝিয়ে দিল। তার মানে কী এই যে, এইসব যুদ্ধাপরাধীদের সাথে তাদের যোগসাজস আছে? সুতরাং গণহত্যার সাথে জড়িত পাকিস্তানের বাদবাকি বাংলাদেশি দোসরদের বেলায়ও যে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।        

১৯৪৭ সালে শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাগ হওয়া পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চলের মধ্যে দুই হাজার মাইল ব্যবধান রেখে মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই বলে মুখে ফেনা তুলে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করা কি ধর্ম সমর্থন করে? নাকি দুইলাখ নারীর নির্যাতনকে সমর্থন করে?

বাংলায় একটা কথা আছে- ‘যার নুন খাই, তার গুণ গাই’। এখানে গুণ গাওয়া তো দূরের কথা, যে দেশ আমাদের জন্মভূমি। যেদেশের আলো হাওয়ায় আমাদের বেড়ে ওঠা সেই দেশের সাথে বেঈমানিকে তারা ধর্মীয় তত্ত্বে ফেলে দিয়েছে।

যুদ্ধের সময়- টিক্কা খান বলেছিল, এ দেশের নারীরা গণিমতের মাল। সুতরাং এদের সাথে যা খুশি তাই করা যাবে। মুসলিম ভ্রাতিত্ত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে নিরীহ কয়েক লাখ মানুষ হত্যা জায়েজ! দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে এইসব তত্ত্ব তাদের শিষ্যরা নতুন করে পালিশ করে তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পাকিস্তান নামক দেশটির কথা বলার কোন অধিকার নেই।

কিন্তু তারপরও তারা এটি করেছে। কোন অধিকারে? যে জঘন্য কাজ তারা ১৯৭১ এ করেছিল এর পরিপ্রেক্ষিতে তার গায়ে যদি কেউ খোঁচাও দেয়, তা নিয়ে কথা বলার বা নাক গলানোর কোন অধিকার তারা রাখেনা।

নিজেদের পরাজয়ের লজ্জা ও কুকর্ম যদি ঢেকে রাখার ইচ্ছা থাকে তবে চুপ থাকাটাই তাদের জন্য শ্রেয় হবে।
বাংলাদেশ তার প্রতি হওয়া অন্যায়কে কোনদিন ক্ষমা করবে না।

আজ এমন একটি সময়ে আমরা আছি যেখানে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করছে। ইতিহাসকে জানার চেষ্টা করছে। সত্য আর মিথ্যার প্রভেদ যাচাই করছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। আজকালকার বাচ্চারাও বলতে শিখেছে- ‘রাজাকাদের বিচার চাই’। এখন থেকেই তারা যদি এই অনুভূতিকে লালন করতে শেখে তাহলে এর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে!

স্বাধীনতার ৪২ বছর পর পুরো বাংলাদেশ যেন জেগে উঠেছে একসাথে। ছোট- বড় কেউ বাদ নেই। সবাই শুধু ছুটছে আর ছুটছে। প্রত্যেকের হৃদয়ে লাল-সবুজের জন্য যে ভালবাসা তা যেন বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসছে। সে এক অদ্ভুত শিহরণ! অদ্ভুত অনুভূতি! এ যেন আরেকবার জেগে ওঠা।

আরেকবার নতুন করে ভালবাসতে শেখা। সেই ভালবাসারই ঐক্যবদ্ধ রূপের আগুনে গড়ে উঠতে চলেছে আরেক বাংলাদেশ। যার স্বপ্ন আমরা দেখছি এতদিন ধরে!

দেশের মাটিতে এখনও আরও অনেক বেঈমান জেগে আছে। যাদেরকে তাদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়ার সময় এসেছে। ৪২ বছর ধরে তারা আমাদের স্বাধীনতাকে খুবলে খেয়েছে। এত সহজেই কি তাদের পার পেতে দেয়া যায়? যায় না। আর যায়না বলেই আমরা আশা করি ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা বোনের সম্মান একদিন আমরা নিশ্চয়ই রাখতে পারব। আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়বে সেই দীপশিখা।    

* সারা মনামী হোসেন, সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১,২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।