ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একটি প্রতিবাদ প্রকাশের স্মৃতি

আমিনুল ইসলাম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩
একটি প্রতিবাদ প্রকাশের স্মৃতি

বাংলা নববর্ষের পরের দিন যেখানে সব জীর্ণতা মুছে ফেলে মনটা হালকা থাকার কথা, তা না হয়ে মন খুব ভারী হয়েছিলো। ভারাক্রান্ত মন নিয়েই পরীক্ষার ইনভিজিলেশনের কাজটা সারতে হয়েছিলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা যেহেতু করি, পড়ানোর পাশাপাশি খাতা দেখা, প্রশ্ন করাসহ পরীক্ষা নেওয়ার যাবতীয় কাজ তো করতেই হবে। কিন্তু সেই দিন কেন যেন কিছুতেই মন বসছিলো না।

খুব সকালবেলায় যখন ডিপার্টমেন্টে পৌঁছাই, তখনই কেমিস্ট্রির শিক্ষক মাহবুব ভাইকে বলে রেখেছিলাম, মোটা কাগজের উপর কয়েকটা লাইন লিখে দিতে। নিজের হাতের লেখা খারাপ হওয়াতে তাঁর দারস্থ হতে হলো। তাকেও বলেছিলাম আমার সাথে যোগ দেবার জন্য, কিন্তু রাজি হলেন না, কিছুটা হেসেই উড়িয়ে দিলেন। মন যেন আরও ভারী হয়ে গেলো। সেই ভারী মন নিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নিচ্ছিলাম আর বারবার ঘড়ি দেখছিলাম--- কখন সময় শেষ হবে আর আমি আমার ভেতরে সিন্দাবাদের ভূতের মতো জেঁকেবসা ভারী বস্তুটিকে নামাতে পারবো।
 
পরীক্ষার ডিউটি শেষ হবার পর আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করি নি। নিজের রুমে গিয়ে মোটা কাগজটি নিয়ে বেরিয়ে পরি কাওরান বাজারের উদ্দেশে। বৈশাখের তপ্ত দুপুর ছিল সময়টা, রিক্সা করে যাচ্ছিলাম, খুব খারাপ লাগছিলো রিক্সাচালকের জন্য। রাস্তার পিচ গরমে গ’লে গিয়ে এমন অবস্থা হয়েছিলো যে রিক্সা চালাতে তাঁর খুব সমস্যা হচ্ছিলো। যাক শেষ পর্যন্ত কাওরান বাজার পৌছাতে প্রায় পড়ন্ত বিকেল হয়ে গিয়েছিলো। অফিসটি খুঁজে পেতে অবশ্য সমস্যা হয়নি। একদম মূল রাস্তার পাশেই বিশাল দালানের অফিস, খুঁজে পেতে কারোরই সমস্যা হবার কথা না। তবে ভাবছিলাম কোথায় দাঁড়ানো যায়। শেষমেশ ঠিক করলাম, অফিসে ঢোকার যে বড় গেটটি আছে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে যাব।

সহকর্মী, মাহবুব ভাই তাঁর চমৎকার হাতের লেখায় মোটা কাগজটিতে যা লিখে দিয়েছিলেন সেটিকেই প্ল্যাকার্ড বানিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

নিশ্চয়ই মনে আছে প্রথম আলোয় প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্র ‘টিভি ক্যামেরার সামনের মেয়েটি’ শীর্ষক একটি আলোচিত, সমালোচিত ছোটগল্পের কথা। গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিলো বাংলা নববর্ষের সময় আর গল্পের ভেতরের বিষয় সবাই আমরা কমবেশি জানি। তবে যেটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, এটি এমন এক সময় প্রকাশিত হয় যখন পুরো দেশজুড়ে মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে, অন্যদিকে আরেকদল একে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

গল্পের লেখক হাসনাত আব্দুল হাই কি উদ্দেশে বা কি বোঝাতে গিয়ে ঐ ছোটগল্পের অবতারণা করেছেন সেটি তিনি এবং তার প্রকাশক ভালো বলতে পারবেন। তবে গল্পটিকে যদি আমি আমার ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি তাহলে যেটি দাঁড়ায় তা হচ্ছে কোনো একজন মেয়েকে যদি শেষ পর্যন্ত টিভি ক্যামেরার সামনে আসতেই হয়, তাহলে তাঁকে কোনো না কোনোভাবে পুরুষের সাহচর্যের মধ্যে দিয়েই আসতে হবে। এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও থাকতে পারে, তবে আমার কাছে এটিই মনে হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এটি বোঝাতে গিয়ে লেখক যে অলঙ্কার ও পাত্রপাত্রীর উদাহরণ টেনেছেন তা ঠিক ঐ সময়কার গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন আন্দোলনের সাথে যুক্ত দু একজনের সাথে মিলে যাচ্ছিলো।

উত্তাল সেই সময়টাতে এই ধরনের নারীবিদ্বেষী ও প্রবল প্রতিক্রিয়াশীল একটি লেখা আমাকে নাড়া দিয়েছিলো। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না জাতীয় একটি দৈনিকে এতো কুরুচিপূর্ণ লেখা কি করে ছাপা হয়? মেনে নিতে পারছিলাম না বলেই শেষ পর্যন্ত একাই ‘প্রথম আলো’ কার্যালয়ের সামনে গিয়ে লেখাটির প্রতিবাদ হিসেবে “প্রথম আলোর কুরুচিপূর্ণ লেখার প্রতিবাদ করছি” প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ি।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখলাম অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন ‘ভাই, কোন লেখার জন্য প্রতিবাদ করছেন?’ আবার অনেকে বলেছেন ‘ভাই, লেখাটির একটি কপি সাথে করে নিয়ে এলেই তো পারতেন’; এ জাতীয় বিভিন্ন কথা বলছিলেন তারা। দেখতে দেখতে বেশ লোক জড়ো হয়ে যাচ্ছিলো। এরই মধ্যে প্রথম আলোয় কাজ করেন এমন অনেকেই এসে আমার খোঁজ খবর নিয়ে গিয়েছেন। আমি কি করি, কোথায় বাসা এই জাতীয় প্রশ্ন। দেখতে দেখতে অনেক মানুষ জড়ো হলেন। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এরা সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে আমাকে দেখছিলেন। আমি এদের অনেককেই অনুরোধ করেছি আমার সাথে দাঁড়িয়ে যেতে, কিন্তু কেউ এলেন না। সবাই যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটক দেখছেন এমন একটা ভাব। এদের মধ্যে অবশ্য ঐ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার প্রতিবাদের বিষয়টি বেশকিছু গণমাধ্যমকর্মীর নজরে আসে। আর এর ফলে দু’একটা টেলিভিশনে আমার প্রতিবাদের বিষয়টি সহ সরাসরি সাক্ষাৎকারও প্রচার করা হয়। কে জানে এর জন্য বিব্রত হয়ে কিনা জানি না, এর পরপরই প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ আমার সাথে কথা বলতে চাইলো। তাদের একজন একজন আমাকে এসে বললেন, সম্পাদক সাহেব আমার সাথে সরাসরি কথা বলতে চান। আমি অবশ্য বলেছিলাম, কথা বলার ইচ্ছা থাকলে নিচে এসে কথা বললেই তো হয়, কিন্তু তাদের বেশ ক’জন কর্মকর্তা আমাকে বারবার বলছিলেন আপনি অনেকক্ষণ ধরে এই রোদে দাঁড়িয়ে আছেন, আপনি বরং উপরে আসুন। আপনার দাবির কথা না হয় উপর মহলকে সরাসরি জানিয়ে যান।

 যেহেতু আমি একা ছিলাম তাই শেষ পর্যন্ত আমি এদের কর্তাব্যক্তির সাথে কথা বলার জন্য ভেতরে যেতে একরকম বাধ্যই হলাম। তবে আমি বলে গিয়েছিলাম আমার দাবি যদি মানা না হয়, আমি নিচে এসে আবার দাঁড়িয়ে যাব। এই সময়টুকুতেও প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ তাদের লেখা সরিয়ে নেয়নি বা কোনো ক্ষমাও চায় নি।

উপরে যাবার পর দুজন কর্তাব্যক্তির সাথে কথা হলো, আমি আমার দাবির কথা বললাম। দাবি তেমন কিছুই না, এই লেখা প্রকাশ করার জন্য প্রকাশক হিসেবে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে এবং লেখাটি তাদের সকল রকম আর্কাইভ থেকে মুছে ফেলতে হবে। সাথে এ-ও বলে দিলাম, তাদের অনলাইন ভার্সনে কাজটি করতে ৫ মিনিটের বেশি লাগার কথা না। তাই এটি যতক্ষণ করা না হচ্ছে আমি যাচ্ছি না। তাঁরা অবশ্য বললেন, এটি করতে তো একটু সময় লাগবে, সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপার আছে, আরও কতো কি! আমি বললাম ঠিক আছে, আমি তাহলে এই সময়টুকু নিচে আমার প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর তাঁরা বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে দেখি কি করা যায়। এর দশ মিনিটের মাথায় তাঁরা লেখাটি সরিয়ে ফেলেন এবং ক্ষমাও চান। আর এই সরিয়ে ফেলা ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি নিজ চোখে ইন্টারনেটে দেখে তারপরই আমি ঘরে ফিরেছি।

এর পরদিন, প্রথম আলো পত্রিকায় প্রথম পাতার ডান দিকে খুব ছোট করে ‘প্রতিবাদ’ শিরোনামে লেখা ছাপা হয় যেখানে খুব ছোট করে লেখা হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজবিজ্ঞান শিক্ষক প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে ঐ লেখাটির প্রতিবাদ করেছেন।

পাঠক, এতক্ষণ পড়ে নিশ্চয়ই আপনারা ভেবে নিয়েছেন আমি নিজেকে জাহির করার জন্য মোটামুটি ষোলকলা পূর্ণ করে ফেলেছি। আসলে এই পুরো বিষয়টি বিস্তারিত লেখার কারণ হচ্ছে, এই যে প্রতিবাদটি আমি ব্যক্তিগতভাবে করেছিলাম এর আগপিছে আর কেউ ছিল না। যা ছিল তা হচ্ছে আমার নিজের আদর্শ ও চেতনা। আমার কোনো সহকর্মী থেকে শুরু করে, রাস্তার মানুষগুলো যারা আমাকে দেখছিল, তারা কেউ কিন্তু আমার সাথে যোগ দেয় নি। আড়াল থেকে দেখছিল কিন্তু সাথে যোগ দিতে হয়তো সঙ্কচ বোধ করছিল, হয়তো ভয় কাজ করছিল কিংবা অন্য কিছু। এদের মধ্যে হয়তো অনেকেরই লেখাটি পছন্দ হয় নি। কিন্তু ঐ প্রতিবাদটুকু করার মতো অবস্থায় তারা পৌছুতে পারে নি।

এই প্রসঙ্গে মার্ক্সের সমাজ পরিবর্তনের তত্ত্বটি মনে পড়ে গেলো। মার্ক্স বলেছেন, আমরা যদি ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখা যাবে সমাজ আসলে সর্বদাই পরিবর্তনশীল। আর এই পরিবর্তনটি সমাজের একটি স্থায়ী রূপ। তবে সমাজ কিভাবে পরিবর্তিত হবে সেটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, দুটি শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দের মধ্য দিয়েই সমাজের পরিবর্তন হয়। আর এই দ্বন্দ্বও সমাজের একটি পার্মানেন্ট ফিচার। খেয়াল করলে দেখতে পাবেন সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তিনি দুটি শ্রেণির কথা বলেছেন। এবং এ-ও বলেছেন, যখন নির্যাতিত শ্রেণির মধ্যে শ্রেণি-সচেতনা আসবে এবং তারা বুঝতে শিখবে যে, তারা নির্যাতিত তখন তারা সকলে একই সুতোয় আবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করবে আর এর মধ্য দিয়েই পরিবর্তন আসবে।

অর্থাৎ তিনি কোনো একক ব্যক্তির কথা বলেন নি। আর আমার জানা মতে, মার্ক্সের এই তত্ত্বটি বহুল গ্রহণযোগ্য একটি তত্ত্ব এবং এটির কাছাকাছি বাস্তব উদাহরণও আমাদের কাছে রয়েছে। যেটি আমারা দেখেছি সাবেক সোভিয়ত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

যাই হোক, আবার মূল বিষয়ে ফিরে আসি। প্রথম আলোর ঐ লেখার প্রতিবাদ হয়তো বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে হয়েছে, যেটি হয়তো সেই অর্থে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের কানে পৌছায় নি। যেটি হয়তো আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো তাদের কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে প্রতিবাদ করে। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, একা হয়তো একটি হিমালয় পর্বত জয় করা সম্ভব কিন্তু একটি দেশ, জাতি বা সমাজ পরিবর্তন আসলে একা করা বর্তমান সময়ে অনেক কঠিন বলেই মনে হয়।

তাই, আমরা যারা আদর্শের কথা বলি, চেতনার কথা বলি, সত্যের কথা বলি, তাদের মধ্যে দরকার শ্রেণি-সচেতনতা। আর এই শ্রেণি- সচেতনাই পারবে সকলকে একটি সুতোয় আবদ্ধ করতে। আর এটি যদি সম্ভব হয় তাহলে যে কোনো কিছুই জয় করা সম্ভব। দাবি যদি হয় সত্যের পক্ষে, সঠিক আদর্শের পক্ষে তাহলে বিজয় অবশ্যই হবে। আর এর উদাহরণ তো ঐ একক প্রতিবাদের মধ্যেই বর্তমান।

আমিনুল ইসলাম: সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; ই-মেইল- [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।