ঢাকা, শুক্রবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

রাজনীতির ময়নাতদন্ত: অ(ব)পরোধ নির্বা(চ)সন গণতন্ত্রের অ(ভি)পযাত্রা

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
রাজনীতির ময়নাতদন্ত: অ(ব)পরোধ নির্বা(চ)সন গণতন্ত্রের অ(ভি)পযাত্রা ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ছবি)

সরকার ৫ জানুয়ারি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার জন্য বদ্ধপরিকর। বর্তমান সরকার কিন্তু নবম জাতীয় সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার নয়।

এটি হচ্ছে একটি নির্বাচনকালীন সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই এ ঘোষণা দিয়েছেন। ২০ নভেম্বর থেকে দেশে একটি নির্বাচনকালীন সরকার বিদ্যমান।  

নবম সংসদের শেষ অধিবেশনে (যদি আর কোনো অধিবেশন না হয়) রাষ্ট্রপতির বরাত দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, রাষ্ট্রপতি তাঁকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার জন্য অনুমতি দিয়েছেন। যদিও নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের এ প্রক্রিয়াটি সাংবিধানিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগও করেননি আবার কোনো গেজেট নোটিফিকেশনও হয়নি।

প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য না হলে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করার প্রশ্ন আসেনা। কিন্তু আমরা সেরকম কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা লক্ষ্য করিনি।

পুরোনো আলোচনাটি এজন্যই যে আজকে বিরোধী দলের আন্দোলনের মূল বিষয়টি যদি হয়-প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, তবে সে প্র্রশ্নে সরকার শতভাগ কঠোর অবস্থানে। বিভিন্ন স্তরের দূতিয়ালির পরে স্বয়ং তারানকো ফিরে গেছেনে শূণ্য হাতে।

তারানকোর ব্যর্থতা অবশ্যম্ভাবি ছিল। কারণ, অতি সাধারণ একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া রক্ষার জন্যও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেননি। দলীয় রাষ্ট্রপতি থাকার পরও তিনি এ অনিশ্চয়তার পথে হাটতে চাননি। তাই, বিরোধীদলের ইচ্ছে পূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী গদি থেকে সরে যাবেন, সেটি অলীক স্বপ্ন।

পাশাপাশি ‘সর্বদলীয়’ বা ‘বহুদলীয়’ সরকারের সাংবিধানিকতাও আমাদের অজ্ঞাত।

এ প্রেক্ষাপটেই বিরোধীদলের অবরোধ কর্মসূচী। তবে বিরোধী জোটের মূল দাবী ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। অবশেষে মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী তাঁর ভাষণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ফর্মূলা দিয়েছেন তা হালে পানি পায়নি।

কারণ, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের নিয়ে যে সরকারের ফর্মূলা তিনি দিয়েছেন তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কারণ, উক্ত দুই সরকারর অনেকেই বেঁচে নেই, অনেকে বয়:বৃদ্ধ বা অপারগ আর অনেকে অনিচ্ছুক।

এই যখন হিসাব, তখন বিরোধী নেত্রী তাঁর ব্যর্থতা ঘোচাতে গিয়ে প্রয়োগ করলেন ব্রহ্মাস্ত্র। অবরোধ নামের এ ব্রহ্মাস্ত্রে কাজ হলো। সরকার নমনীয় হোক বা না হোক, দেশ কার্যত অচল হলো, প্রতিদিন নিহত হলেন সাধারণ নাগরিক, ক্ষতিগ্রস্ত হলো দেশের মানুষ ও অর্থনীতি। আর লাভবান হলো বৃক্ষ-ব্যবসায়ী ও ট্রেনের কন্ট্রাক্টররা।

বিরোধী জোটের এ অবরোধের পালে হাওয়া দিল জামায়াতও। কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করায় জামায়াতের কর্মসূচী তথা তাণ্ডব শক্তি যোগালো বিএনপির কর্মসূচীতে।

তবে, এতো কিছুর পরও বিরোধীজোটের থলে শূন্য। নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে বিরোধী জোটের অবরোধের ফলাফল ব্যর্থ প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।

এদিকে সরকার ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন করতে যাচ্ছে তাকে সাংবিধানিক ভ্রান্তি ছাড়া আর কোনো ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়না। নিয়ম রক্ষার এ নির্বাচনে ১৫৪ জন ইতিমধ্যেই বিজয়ী হয়েছেন। বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এ নির্বাচন কেবল নজীরবিহীনই নয়, গণতন্ত্রের অগস্থযাত্রাও বটে।

‘৭০এর দশক থেকে পরবর্তী চার দশকে (২০১১) সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় ৩৫টির মতো সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ পদ্ধতির এ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা যে দল থেকে নির্বাচিত হন, সে দলই সরকার গঠন করে। এখানে ভোটের সংখ্যার চেয়ে প্রার্থীদের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করেই ফলাফল নির্ধারণ করা হয়।

আমাদের দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব না থাকায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন যদি কোনো দল পেয়ে যায় তবে যেকোনো সাংবিধানিক পরিবর্তন তারা ঘটাতে পারে। দু:খজনভাবে আমাদের দেশে ছয়বার এরকম দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ তৈরি হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় আর কোনো দেশে এতো বেশি সংখ্যকবার দুই-তৃতীয়াংশের সংসদ তৈরি হয়নি। ফলে, সাংবিধানিক পরিবর্তনের চাবিটি যদি একক কোনো দল বা সরকারের হাতে থাকে সেক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিপত্তি ঘটাই স্বাভাবিক।

এটি শুধু আমাদের দেশেই নয়; পৃথিবীর তাবৎ দেশে এরকমই হয়ে থাকে। দায় কেবল শেখ হাসিনার নেত্রীত্বাধীন আওয়ামী লীগের নয়।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় ৯৮ শতাংশ আসনে জয়ী হয়েছিল। সেবার দ্বিতীয় ও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সাংবিধানিক পরিবর্তন আনা হয়েছিল তা থেকে উত্তোরণের জন্য দেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দুই দশক। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে তা কিছুটা লাঘব হয়। কিন্তু কার্যকরী সংসদীয় গণতন্ত্র এখনো সুদুরপরাহত।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি যদিও সেরকম গুরুতর কোনো সাংবিধানিক পরিবর্তন করেনি; কিন্তু ১৯৭৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত সংসদ বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিয়েছে। জাতির জনকের হত্যার বৈধতা দিয়েছিল সে সংসদ।

সাংবিধানিক অজুহাতে যে নির্বাচন করার জন্য বর্তমান সরকার বদ্ধ পরিকর তার সূত্রপাতও এ দেশে নতুন না। খালেদা জিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন করেছিল আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তারই ধারাবাহিকতা।

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নির্বাচনে ওই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনেরই কুফল।

কাজেই সরকার যে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, অতীতের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা যে তাদের পিছু ধাওয়া করছে সেটি যেনো তারা ভুলে না যান। তাদের সামনে যেমন ৫ জানুয়ারি, পেছনের তেমনি ১৫ ফেব্রুয়ারি।

নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই সরকার গঠন করার যে আভাস বর্তমান সরকার পেয়েছে (১৫৪ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে) তা ১৯৭৩ সালেও (যে নির্বাচনে আওয়ামীগ প্রায় ৯৭ শতাংশ আসনে জয়ী হয়) সরকার পায়নি। ’৭৩ এর নির্বাচনে মাত্র ১১ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতি হয়েছিলেন।

গণতান্ত্রিক সরকার বা দলগুলো যাকে স্বৈরাচার ক্ষেতাব দিয়েছে সেই এরশাদের আমলে ’৮৮ এর নির্বাচনে মাত্র ১৮ জন প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যোগ দেয়নি। তারপরও মাত্র ১৮ জনের কলঙ্ক এরশাদের ললাটে আজো।

আর এবার প্রধান বিরোধী দল (ভারপ্রাপ্ত)-অর্থাৎ জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচন করার পরও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ১৫৪ জন। এবার ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ৪৯ জনকেও পেছনে ফেলে দিল দশম সংসদের ১৫৪ জন।

উল্লেখ্য, দশম সংসদে আওয়ামী লীগ বা মহাজোট সরকারের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। কারণ, ১৫৪ জন বিজয়ী হয়েছেন নির্বাচনী ইশতেহার দেয়ার আগেই। সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা দলটি ইতিমধ্যে অর্জন করেছে। কাজেই ইশতেহার দেয়া আর না দেয়া সমান কথা। আজ (শনিবার) যে ইশতেহার দেয়া হলো তা বাকি ১৪৬ জনের জন্য কার্যকর ও ১৫৪ জনের জন্য ভূতাপেক্ষ কার্যকর।

কাজেই, সামগ্রীকভাবে এ নির্বাচন নিয়ম রক্ষার সাংবিধানিক ভ্রান্তি বিলাস।

বিরোধীজোটের ব্যর্থ অবরোধের পরে তাদের ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’র সাফল্য নিয়ে সংশয় আছে দলের ভেতরেই। আর আমরা যারা দলের বাইরে তারা গণতন্ত্রের সব ধরনের অপযাত্রারই বিপক্ষে-তা সে নির্বাচনের নামেই হোক আর সহিংসতার নামে। গণতন্ত্রের নির্বাসন আমরা চাই না।

বাংলাদেশ সময়: ১৬০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।