আসিফ নজরুল বিয়ে করেছেন। বিয়ে তিনি আগেও করেছিলেন।
এ খবর গণমাধমে প্রকাশ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুক আসিফ-শীলার বিয়ে নিয়ে সরব। অশালীন, অশোভন মন্তব্যের ছড়াছড়ি। রীতিমত তোলপাড় বলা যায়।
‘তবে কি আসিফ নজরুলের শ্বাশুড়ি হচ্ছেন শাওন’, ‘মেয়ের বয়সী মেয়েকে বিয়ে করলেন আসিফ নজরুল’। সাধারণ জনমানুষের চেয়ে, মিডিয়ার সঙ্গে যোগ আছে, সংশ্লিষ্ট যারা, তারাই কুমন্তব্য করেছেন বেশি, ফেসবুক পোস্ট, লাইক দিয়েছেন।
আফিস নজরুলের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয় সে অনেক বছর আগের কথা। দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন পুলিশ সার্জেন্ট আহাদ। তার স্ত্রী রোকেয়া প্রাচীর সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। সম্পর্ক, সখ্য গড়ে ওঠে। অতঃপর বিয়ে করেন তারা।
বেশ কয়েক বছর দাম্পত্য, বৈবাহিক জীবনের পর তারা একত্রবাসের সিদ্ধান্ত বাদ দেন। ইতি টানতে চান দাম্পত্য সম্পর্কের। বৈবাহিক জীবনের সম্পর্কও ছিন্ন করেন। শীলা আহমেদেরও স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়। দু’জনই সিঙ্গেল। দুজন ‘সিঙ্গেল পারসন’ যদি নতুন সম্পর্কে জড়াতে চান, একত্রে বাস করতে চান, বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন, নতুন সংসার করেন তাহলে আপত্তি থাকবে কেন?
আমরা মুখে প্রগতিশীলতার কথা বলি, উদারতার কথা বলি, ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলি। কিন্তু আধুনিকতার ‘আ’ কি কিংবা প্রগতিশীলতার ‘প্র’ টির লেশমাত্রও ধারণ করি না। আর উদারতা, সে তো নেই-ই। এসব ধার করা শব্দ বলতে আমরা ভালোবাসি।
কিন্তু ধারণ করার ন্যূনতম যোগ্যতা ও ক্ষমতা রাখি না। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক লোক তাদের জীবনের নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা তা নিতেই পারেন। এতে সামাজিক ও আইনগত কোনো বাধা নেই। বিধি নিষেধ নেই। দু’জনের কারো বয়সই ১৮ বছরের নিচে তো নয়।
তা ছাড়া দু’জনই বিয়ের আগে ডিভোর্স নিয়েছেন। আসিফ নজরুলের সাবেক স্ত্রী, রোকেয়া প্রাচী তো কোনো আপত্তি করেননি। কারণ তিনি শিক্ষিতা, প্রগতিশীল, অগ্রসর মানুষ। তিনি জানেন, এখন তিনি আর কারো স্ত্রী নন। অন্যের বিষয়ে তিনি কথা বলবেন কেন?
এই সভ্যতা, শালীনতার বোধ তার আছে। শীলার স্বামীও তাই-ই। ডিভোর্সের পর শীলা আর তার স্ত্রী নয়। ফলে সেই ভদ্রলোকও কোনো অশোভন মন্তব্যে যাননি। শীলা এখন আফিসকে বিয়ে করল, কি আমিনকে বিয়ে করল তা নিয়ে তার মাথা ব্যাথা নেই। দেখার বিষয়ও নয়। কিন্তু অসভ্য আমরাই, আমাদের মাথা ব্যথা, বায়ু চড়া আসিফ শীলার বিয়ে নিয়ে।
আমরা কিছু ভুল ধারণার মধ্যে বসবাস করি। সভ্যতা-অসভ্যতার সীমারেখা আমরা জানি না, জানলেও তা মানি না। অনধিকার চর্চা আমাদের অশ্লীল আনন্দ দেয়। অন্যের দাম্পত্যে, বৈবাহিক জীবনে অনাকাঙ্খিত অনুপ্রবেশ আমাদের পুলকিত করে। এ আনন্দ বিকৃত আনন্দ।
অন্যের অন্তর্বাসের মাপ জানতে চাওয়া যেমন অশ্লীল, অন্যের বেডরুমে ঢুকে যাওয়াটা যেমন অসভ্যরকমের অন্যায়, তেমনি অন্যের দাম্পত্য জীবন নিয়ে মন্তব্য, কৌতুহলও যারপরনাই কুরুচিপূর্ণ। যার যার জীবন তার। সেই জীবনের সিদ্ধান্তও তার-ই।
কে, কেন কি কারণে, কোন পরিস্থিতিতে তার জীবনের কোন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, নিয়েছেন, সেটা শুধু তিনিই জানেন। বাইরে থেকে দেখা যায়, ভেতরটা বোঝা যায় না। মানুষের জীবন বড় বিচিত্র ও অসহায়।
ফলে অন্যের জীবন নিয়ে মন্তব্য না করাই ভালো। কারো জীবন, জীবন চর্চা যদি আমার জীবনকে বাধাগ্রস্ত, ক্ষতিগ্রস্ত করে, যদি অপরাধ সংগঠিত হয় যা অন্যের ক্ষতিসাধন করে- শুধু তখনই তা নিয়ে আমি বা আপনি মন্তব্য করতে পারি, তা নয় তো নয়।
কারো জীবনে একবার বিয়ে হওয়া মানে সে সারা জীবনের জন্য বিবাহিত নয়। দাম্পত্য থাকলে, বৈবাহিক জীবনের মধ্যে থাকলে, তবেই তাকে বিবাহিত বলা যায়। বিয়ের পরও কেউ সিঙ্গেল হতে পারে, সেপারেটেড হতে পারে, ডিভোর্সড হতে পারে, সম্পর্কের নানান মাত্রা থাকতে পারে।
মনে রাখতে হবে, বিয়ে শুধু প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক নয়, আইনি সম্পর্কও বটে। আইনি জটিলতা মিটে গেলে কেউই কারো স্বামী বা স্ত্রী নন। বিয়ে অনেকটা অফিসিয়াল সম্পর্ক, সে কারণেই বিয়েতে কাগজপত্র প্রয়োজন হয়। সই, সাক্ষর, সাক্ষী লাগে। ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কা আছে বলেই, প্রয়োজন হয় কাগজপত্রের। ফলে বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া অন্যায় নয়, অস্বাভাবিক নয়। বরং বিয়ের পর সম্পর্কের নানা টানাপড়েন দেখা গেলে তা ভেঙে যাওয়া ভালো ও স্বাভাবিক।
আমাদের সমাজে এক ধরনের ডিভোর্স ভীতি ও আপত্তি আছে। এখানে অনেক সময়ই মানুষের মধ্যে মুক্ত স্বাধীনসত্ত্বা ও আত্মসম্মানবোধ কাজ করে না। সামাজিক, আর্থিক ফ্যাক্টরের জন্য দায়ী। ‘মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া’-দাম্পত্য টিকিয়ে রাখবার সবচেয়ে বড় মন্ত্র বলে শেখানো হয়। অথচ কখনো কখনো একত্রবাস ‘দুঃসহবাস’ও হতে বাধ্য।
শুধু যৌনতা নয়, আধুনিক, প্রগতিশীল মানুষের কাছে চিন্তা, বিশ্বাস, আদর্শের ঐক্য, পারস্পরিক সম্মানবোধ দাম্পত্যের সবচেয়ে বড় শর্ত। উদার, উন্নত, আধুনিক রাষ্ট্র ও দেশগুলোতে ডির্ভোসের হার অনেক বেশি। পূবের দিকে এ হার অনেক কম। ভারতে ডিভোর্সের হার ১.১।
আমাদের দেশেও এ হার আশঙ্কাজনক কম। মনে রাখতে হবে যেকোনো ভাবে, যেকোনো সম্পর্ক থাকবার চেয়ে, রাখবার চেয়ে, না থাকা, না রাখাই ভালো।
আসিফ নজরুলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চিন্তা ও আদর্শ নিয়ে অনেকের আপত্তি আছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও তার রাজনৈতিক আদর্শ, যুক্তির সঙ্গে একমত পোষণ করি না। কখনো কখনো তার যুক্তি ও ব্যাখ্যা বিএনপি নয়, জামায়াতকেও সমর্থন করে যা ব্যক্তিগতভাবে আমি একেবারেই মেনে নিতে পারি না। মেনে নেইও না। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের মোকাবেলা তো হবে রাজনৈতিক যুক্তি এবং কৌশল দিয়ে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়ে। এটাই তো সুস্থ, উদার, গণতান্ত্রিক চর্চা।
আমরা আসলে এক ধরনের যৌন আবেদনের মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠি, বড় হই। ফলে তা আমাদের অন্যের দাম্পত্য, যৌনজীবন, যৌথজীবন জানতে, সেখানে অতর্কিত অনুপ্রবেশে ভেতরে ভেতরে উদ্দীপ্ত করে।
কেন অমুকের সন্তান হচ্ছে না, কেন অমুক এখনো বিয়ে করেনি, কেন অমুকের ডিভোর্স হলো, কেন অমুক তার চেয়ে কম বয়সী বা বেশি বয়সী মেয়েকে কিংবা ছেলেকে বিয়ে করল এসব জানতে, অন্যকে জানাতে আমাদের যারপরনাই আগ্রহ।
এ আগ্রহ অসভ্য, এ আগ্রহ বিকৃত, এ আগ্রহ অন্যায়।
জব্বার হোসেন: সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৩০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩