ঢাকা, শুক্রবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

দশম সংসদ নির্বাচন, কী পেলাম কী হারালাম!

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৪
দশম সংসদ নির্বাচন, কী পেলাম কী হারালাম! ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ফাইল ফটো

ক্ষমতাসীন সরকার সংবিধান সমুন্নত রাখতে ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধীদলকে নির্বাচনে আনার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত একপাক্ষিক নির্বাচনের পথেই হেঁটেছেন।



আইন ও সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে-জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করেছে।

কাজেই, সরকারি ফর্মুলা অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো। অপ্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচনে নির্বাচিতদের সরকার গঠনে আর বাধা নেই, কেবল গেজেটের অপেক্ষা। শিগগিরই হয়তো সরকার গঠনও হয়ে যাবে। অতপর সাংবিধানিকভাবে আবার একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে ভাবনা। এই নির্বাচন হতে পারে পাঁচ বছর পর। আর রাজনৈতিক সমঝোতা হলে এর আগে যে কোনো দিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোনো দিনক্ষণ না দিয়ে বলেছেন ‍আগামী সংসদের ভাবনা আগামী এলেই ভাবা হবে। আপাতত গদিময়যাত্রা-ক্ষমতার দিন।  

কিন্তু বিধি বাম! বিষয়টি এখানেই ক্ষান্ত হলে ভালো হতো। কিন্তু এর পূর্বাপর ঘটনা ও ফলাফল বিবেচনায় না নিয়ে সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। সরকার ও বিরোধী দল একে অপরকে মাইনাস করার প্রক্রিয়া ও যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। ফলে সেই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই রচিত হতে হবে আমাদের গণতন্ত্র ও রাজনীতির ললাটলিখন।  

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় যে গণতন্ত্রের কথা বলা আছে তা কি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত গণতন্ত্র? যদি তাই হয় তবে ‘৭০এর নির্বাচনের পরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম? কেন সামরিক উর্দি পড়ে বঙ্গভবনের গদি দখল করে নির্বাচন দিয়ে বৈধতার তকমা অর্জন করার পরও এরশাদের বিরুদ্ধে ড. মিলন ও নুর হোসেন শহিদ হলেন? সংবিধানে যে মৌলিক মানবাধিকার ও রাজনৈতিক সাম্যের কথা বলা হয়েছে তার সুরতহাল কি এই?

গণতন্ত্র তো কেবল ভোটাভুটি নয়। ৫ জানুয়ারি যে ভোটাভুটি হয়ে গেলো তেমনটা তো নয়-ই। ’৯০ এর পর আমরা ভেবেছিলাম গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নুর হোসেনের লাশই বুঝি শেষ লাশ। কিন্তু হাল আমলে বিরোধী দলীয় নেতার গণতন্ত্রের নামে অভিযাত্রা তার আগে-পরে লাশের মিছিল তো আরো দীর্ঘ। এ মিছিলের শেষে কে আছে তা আজো আমাদের অজানা।

গতকালের লাশ আগের দিনের লাশের কথা ভুলিয়ে দেয়। তাই কেবল নির্বাচনের দিনের কথাই মনে আছে। সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষার এ নির্বাচনে ১৯ জন ‘মাত্র’ লাশ হয়েছে। গণতন্ত্রে উত্তোরণের পরে (‘৯০) এতো ব্যাপক নির্বাচনী সহিংসতা আমরা দেখিনি। ‘মাত্র’ শব্দটি ইচ্ছে করেই যুক্ত করা। টাকার অঙ্ক লেখার শেষে ‘মাত্র’ যোগ করার হেতু সম্ভবত কেউ জাল-জালিয়াতি করে যেনো অতিরিক্ত টাকা লিখতে না পারে। সরকারি দলের ‘সংবিধান’ আর বিরোধী দলের ‘গণতন্ত্র’ রক্ষার এ সফরে আর যেনো কোনো লাশ যোগ না হয়-তাই এ ‘মাত্র’ যোগ। কিন্তু সে আশায় নিরাশা। সোমবার রাতেও আমাদের লিখতে হয়েছে লাশের খবর।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকারের ‘গণতন্ত্র’ অর্জিত হলেও বিরোধী দলের ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা হয়নি। তাই তারা ক্ষমতার তখতে যাওয়ার জন্য গণতন্ত্রের অভিযাত্রা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। ‘যুবরাজের’ ভিডিও বার্তায় সে ঘোষণাই আমরা দেখি। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এরই মধ্যে এধরনের ভিডিও বার্তাকে ‘লাদেন স্টাইল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এরশাদের পতনের পর আর যাই হোক আমরা ক্ষমতা হন্তান্তরের একটি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া বের করতে পেরেছিলাম। কেবল তা-ই নয়, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য আমরা সংবিধানের বাইরে গিয়ে সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে এনে তাঁর অধীনে নির্বাচন পরিচালনাও দেখেছিলাম।

সেদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাছে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকারই বড় বিষয় ছিল। সেদিন গণতন্ত্রের জন্য সংবিধান পরিবর্তন হয়েছিল। আর আজ সংবিধানের জন্য গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হলো।

সেদিন দুই নেত্রীর শত্রু একজন (এরশাদ) হওয়াতে দুইজনই বন্ধু হয়েছিলেন। এক গদিতে বসে পুষ্পের হাসি হেসেছিলেন। এরশাদকে ‘বিশ্ববেহায়া’ বানিয়ে একজন হয়েছিলেন ‘জননেত্রী’ আর একজন হয়েছিলেন ‘দেশনেত্রী’।

আর আজ এরশাদকে বগলদাবা করতে পেরে এক পক্ষ খুশি তো আরেক পক্ষ না পেরে নাখোশ। যদিও এরশাদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তিনি আগেও গলফ খেলতেন এখনও গলফই খেলেন। কিন্তু আমাদের নেত্রীরা কখনো খেলেন ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে আবার কখনো ‘সংবিধান’ নিয়ে। যখন যার জন্য যেটা সুবিধাজনক।

’৯০-এর পরে এরশাদ রাজনীতির বড় ফ্যাক্টর ছিলেন না। ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহারের প্রয়োজন না থাকলেও আওয়ামী লীগ তার দলকে (জাপা)ক্ষমতার অংশীদার করেছেন। কারণ, সরকার গঠন করার জন্য যে আসন প্রয়োজন তা আওয়ামী লীগ একাই অর্জন করেছে। কিন্তু তারপরও পূর্ব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়ে ক্ষমতার অংশীদার করেছে। জোটবদ্ধ রাজনীতিতে ভোটহীন কতিপয় বামেরা যদি গদির ভাগ পায় তবে ত্রিশোর্ধ আসন পেয়ে এরশাদ কেন গদির ভাগ পাবেন না। গদির হক তো তারই বেশি!   

এবারের নির্বাচনে গদি-ভাগাভাগির হিসাব আমাদের এখনো অজানা। তবে সংসদের আসন ভাগাভাগির খবর স্পষ্ট। এবার আরো একধাপ এগিয়ে জাতীয় পার্টিকে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। কাজেই দশম সংসদ নির্বাচনে ২৩ বছর আগের পতিত স্বৈরাচারকে রাজনীতিতে বিরোধী দলের মর্যাদা দিয়ে পুন:প্রতিষ্ঠিত করা হলো।

মন্ত্রীত্ব দেওয়ার চেয়ে বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া আরো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কয়েকটি মন্ত্রীত্ব দেওয়া মানে পিঠ চাপড়ে দেওয়া আর বিরোধী দলের আসনে বসানো মানে মাথায় তুলে রাখা। সাংবিধানিক সুবিধার মধ্যে নিয়ে আসা।

দুই দশকের গণতন্ত্রে আমরা আর যাই হোক- সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের একটি ধারাবাহিকতা দেখেছি। দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বিষয়টি সেটেলড ছিল। ১৫ ফেব্রুয়ারির কলঙ্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত সংসদের মাধ্যমে একটি বিল পাস করে নীল-নকশার নির্বাচনের দরজা আমরা সিলগালা করে দিয়েছিলাম।

এর পর তিন-তিনটি জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত পক্ষের ‘পুকুর চুরি’ বা ‘সুক্ষ কারচুপি’র অভিযোগ হালে পানি পায়নি। জনগণ তথা আর্ন্তজাতিক মহলে সে নির্বাচন প্রশংসিত হয়েছে। কেবল তা-ই নয়, আমাদের নির্বাচনকালীন (সংবিধানে যা ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সরকারের মডেলকে অনেক রাষ্ট্র গ্রহণ করে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সক্ষম হয়েছে, গণতন্ত্র বহাল রাখতে পেরেছে। আবার কেউ কেউ গণতন্ত্রে ফিরেও এসেছে।

কিন্তু আমরা ১/১১-এর অজুহাতে আবার সেই পিছনের পথেই হাঁটলাম।

একথা সত্য যে তত্ত্বাধায়ক সরকার কখনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না। নির্বাচিত ও নিবার্চনকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনই গণতান্ত্রিক মডেল। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক বিলুপ্ত করে আমরা যে গণতান্ত্রিক মডেলে প্রত্যাবর্তন করলাম তার অধীনে কি আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন পেলাম? দশম সংসদ নির্বাচন কি কোনো বিবেচনাতেই সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হলো? ‘অংশগ্রহণমূলক’-এর প্রশ্ন না হয় না-ই তুললাম। কেন্দ্র দখল, জালভোটের আরেক নতুন নজির কি আমরা সৃষ্টি করলাম না? ২০১৩-১৪ সালে এসে জালভোট, কেন্দ্র দখল, ভোট কাস্ট বেশি দেখানো যে কতটা লজ্জাজনক তা কি আমাদের অজানা? আর বিরোধীদল কি এ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতার নতুন মাত্রা যোগ করেনি?

সুষ্টু নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য কমিশন কি যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিল? গণমাধ্যমে দেখেছি, অনেক ভোট কেন্দ্রে ভোটাররা গিয়েছেন কিন্তু ভোট দিতে পারেননি। অনেকের আইডি কার্ড, ভোটার তালিকা ও ক্রমিক নম্বরের সাথে কোনো মিল ছিল না। সিইসি হয়তো ভেবেছিলেন কেবল ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার পাঠালেই নির্বাচনের সব কাজ সমাধা হয়ে গেলো।

কাজেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের যদি কোনো নেতিবাচক দিক থাকে তা যতোটা সরকারের তার চেয়ে ঢেড় বেশি সিইসি’র। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের জন্য জনগণ যদি তাকে ভবিষ্যতে সিইসি না বলে ছি!ইসি বলে, তা কি তিনি ঠেকাতে পারবেন?

তবে এরপরেও আশা-বিরোধী দলের ভাষায়-গণতন্ত্র অর্জিত হোক। সরকারি দলের ভাষায়-সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক। আর আমাদের ভাষায়-আমরা মুক্তি চাই অপরাজনীতির এই জতুগৃহ থেকে।

বাংলাদেশ সময় ১১৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৭, ২০১৪
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।