ঢাকা, শুক্রবার, ২০ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের তাড়াক, নাহয় সুরক্ষা দিক !!

মাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৭, ২০১৪
রাষ্ট্র সংখ্যালঘুদের তাড়াক, নাহয় সুরক্ষা দিক !! ছবি: বাংলানিউজ ফাইল ফটো

এবার কী বলবে সরকার? নির্বাচনের জন্য মানুষকে অপ্রস্তুত রেখেই একটি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। সমস্ত ভয়-ভীতি এবং জীবনের মায়া এক প্রকার ত্যাগ করেই ভোট দিতে গেছে যারা, তাদেরকে রক্ষার দায় পুরোটাই সরকারের।

কিন্তু কী দেখতে পাচ্ছি? চারদিকে ধংসের মহোৎসব চলছে। আর এদেশের সবচেয়ে দুর্বল মানুষ যারা(এদের আসলে মানুষ বলে অপমান করাটা অন্যায় হবে) তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এদেশের শক্তিশালী আরেকদল মানুষ (এদেরও মানুষ বলে সম্মান দেবার কোনো মানে নেই)। আজকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে যে খবর রাজধানীতে আসছে তাতে যে কোনো সুস্থ মানুষের মনে হতে পারে, এদেশ আসলে হায়নাদের দখলে চলে গেছে। ব্যক্তি পরিচয়ের সূত্র ধরে যারা ফোন করছেন তাদের ফোন ধরার সাহস বা শক্তি কোনোটাই অবশিষ্ট নেই। কী বলবো তাদের? রাষ্ট্র নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তারা আজ সমাজের শক্তিধর (?) অংশের কাছে হাত পাতছে নিরাপত্তার জন্য, অথচ ওরা জানে না, আমরাও যে চূড়ান্ত শক্তিহীন!

আশ্চর্য লাগে ভেবে যে, এই ভূখণ্ডে যারা দখলদার, তারাই এখন এখানকার আদি বাসিন্দাদের নির্মূল করতে উদ্যত। এক সময় না হয় ধর্ম প্রচারের জন্য, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাদের ওপর চড়াও হয়েছিল, কিন্তু তাতো অর্জিত হয়েছে, এদেশে তো সংখ্যাগুরুত্ব লাভ করা গেছে। এখন কেন? এখনও কেন? ৪৭-এর পর পরই তো ধর্মের সংখ্যাগুরুত্বে দেশ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা তো কেউ নেয়নি। কিন্তু ধর্মের সংখ্যাগুরুত্বের বেলুন তো ফেটে গিয়েছিলো বছর না ঘুরতেই। ভাষার সংখ্যাগুরুত্ব আরোপ করেছিল সধর্মী ভাইসকল। তারপর তো দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে সধর্মী বড় ভাইয়েরা ছোট ভাইদের খুবলে খেয়েছে। আর ধর্মেরই নামে এদেশ থেকে সংখ্যালঘু ধর্মবিশ্বাসীদের নির্মূল করেছে। ধর্মের নামে রক্তপাত ঘটিয়ে ঘটিয়ে এই ভূখন্ডকে হারিয়ে বড় ভাইয়েরা ফিরে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের জারজ সন্তানদের তো মনে হয়ে রেখে গেছে, নইলে এখন কারা দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে কমতে থাকা অবশিষ্ট ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন আর সম্পদ কেড়ে নেওয়ার জেহাদে নেমেছে? ৩৭% থেকে ৫%-এর কমে নামতে সময় নিয়েছে পাঁচ দশকের একটু বেশি, এখন বাকিটুকু যখন থাকবে না, তখন এই ধর্মের ষাঁড়েরা কী করবে? নিজের মাংস নিজে খাবে? প্রশ্ন করছি কি, এই খাওয়া তো শুরুই হয়ে গেছে। ২০০১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে প্রথমে হিন্দুদের আক্রমণ করেছে আর সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনে কম আসন পাওয়া আওয়ামী লীগারদের দিকে হাত বাড়িয়েছে। হত্যা, নির্যাতন, ভিটেমাটি ছাড়া করা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করা-- এর শিকার কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা হয়েছে ২০০১-এ? না, আওয়ামী-মুসলমানও হয়েছে। তার মানে হচ্ছে, ওদের টার্গেট সংখ্যালঘু কেবল, ওরা এদেশে ধর্মের ষাঁড়, সংখ্যাগুরু, এটাই প্রমাণ করা। প্রমাণতো পাওয়া যাচ্ছেই।

পাকিস্তান এক সময় ছিলো উপমহাদেশের একটি বহু ধর্মাবলম্বীদের এলাকা। সেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টানদের সংখ্যা কতো ছিল তা আজ ইতিহাসও বলতে পারবে না। ইতিহাস বলে, উত্তর থেকে তরবারি হাতে সেখানে প্রবেশ করেছিল ধর্ম। কচুকাটা করতে করতে এগিয়ে এসেছিল ধর্ম উত্তর থেকে দক্ষিণে। হ্যাঁ, সঙ্গে ভালো কিছু মানুষও যে আসেনি তা নয়, ধর্ম তাদের বিবেককে উদ্ধত করতে পারেনি। তারা এদেশের মানুষকে হয়তো ভালোবাসতেই চেয়েছিল। কিন্তু তরাবারিওয়ালাদের কাছে ভালোবাসা পরাজিত হয়েছে এখানে বারবারই। পাকিস্তান তাই উপমহাদেশের সর্ব-উত্তরের দেশ হওয়ায়, তরবারিওয়ালাদের প্রবেশদ্বার হওয়ায় সেখান থেকে মানবতা ক্রমশঃ দূরে সরেছে। ৪৭-এ সেদেশ থেকে লাশ বোঝাই ট্রেন এসেছে, পাল্টা এদিক থেকেও গেছে ঠিকই কিন্তু ইতিহাস বলে, শুরুটা ওদিক থেকেই ছিল। লাশের জবাবে লাশকে বৈধতা দিচ্ছি না, কিন্তু হিংসার জবাবে হিংসাই পাওয়া যায় সেটুকু বলতে চাইছি মাত্র। পাকিস্তান এখন প্রায় সংখ্যালঘু-শূন্য। কিন্তু থেমেছে কি তরবারিওয়ালাদের দানবসম তাণ্ডব? না, এখন সেখানে শিয়া-সুন্নী, কাদিয়ানি, আহমদীয়া - কতো শত বিভাজন, আর যারাই এদের মধ্যে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরুর আক্রমণের টার্গেট তারাই। আর পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের রেখে যাওয়া সন্তানেরা আজকের বাংলাদেশেও সেই একই পথে হাঁটছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসীদের শেষ করে তারা ধীরে এগুচ্ছে তাদের চিন্তায় কম-মুসলমানের দিকে।

লক্ষ্যণীয় যে, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বিগত দিনগুলিতে ঘটছে এই ভয়াবহ বর্বরতা। এখানে সেই ৪৭-এ যারা এদেশে এসেছিল তাদের সংখ্যাধিক্য।

অভিযোগ আসছে যে, সীমান্তবর্তী সংখ্যাগুরু ধর্মাবলম্বীরা নির্বিঘ্নে অপরাধ করে আশ্রয় নিচ্ছে গিয়ে সীমান্তের ওপারে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গে। সেখানে এক দিদি আছেন, ক্ষমতায়। ক্ষমতার প্রয়োজনে তিনি তার ২৫%-এর একটু বেশি ধর্মীয় ভোট-ব্যাংককে খুশি রাখতে যা যা প্রয়োজন তা করবেন বলে প্রকাশ্যেই নাকি “বচন” দিয়েছেন। তিনি অন্ধ তাই দেখতে পান না যে, এপাশের সংখ্যালঘুগণ কতো বিপদে পড়েছে তারই আশ্রিতদের দ্বারা। তিনি, মনে করছেন, তার ভোট ব্যাংক সুস্থ থাকলেই হলো, কিন্তু তিনি ভুলে গেছেন যে, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে!!!’ কে তাকে শোনাবে এই বাণী? তিনি এখন ক্ষমতামত্ত। অথচ ক্ষমতান্ধতা থেকে একটু উঁকি দিলেই তিনি দেখতে পেতেন, এদেশে তারই ভোটব্যাংকের দোসররা আসলে কী কাণ্ড ঘটাচ্ছে!!!
এর আগেও এই ভূখণ্ডে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করতে কোনো রকম অজুহাত লাগতো না, এখনও লাগে না। তবে ৭৫-এর পরে আমরা দেখেছি যে, এদেশে সংখ্যালঘু আক্রমণের মৌসুম শুরু হয় যে কোনো নির্বাচনের পরপরই। নির্বাচনে ভোট দেওয়া হলো কি হলো না তা দেখার প্রয়োজন নেই, তাদের ওপর চড়াও হওয়ার জন্য নির্বাচন যেনো একটা বৈধ টিকিট।

 আগেই বলেছি এ ঘটনা এদেশে নতুন নয়, অথচ যাদের জন্য সংখ্যালঘুদের ওপর এই নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে, তাদের পক্ষ থেকে আগে থেকেই কোনো ব্যবস্থা কোথাও নেওয়া হয় বলে জানা যায় না। এবারও যে হয়নি তার প্রমাণ যশোরের অভয়নগর, নোয়াখালী, দিনাজপুরসহ সারা দেশে। এতো কঠিন অবস্থার ভেতর দিয়ে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হলে এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পকেটে থাকা সামান্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা কেন দেয়া সম্ভব হলো না? আজকে এই প্রশ্ন তুলতে হবে, সবকিছুতে ছাড় দেওয়া যায়, সবকিছুই মেনে নেওয়া যায় কিন্তু এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিলে তার পরবর্তী আঘাতের জন্য নিজেকেই দায়ী করতে হবে।

আমরা জানি, এদেশের সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরুর মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো ব্যবধান নেই। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় পরিবর্তন ঘটা মাত্রই এই ব্যবধান নগ্ন হয়ে ওঠে। তার মানে আমরা এটাও জানি যে, কারা এই ঘটনা ঘটায় এবং কেন ঘটায়। আবারও পাকিস্তানের প্রেতাত্মাদের কথা তুলতে হয়, তাদের ছানাপোনারা আজ রাষ্ট্র ক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি কখনও কখনও, আর তখনই তাদের ধর্মের তরবারি বেরিয়ে আসে ঝুলি থেকে। আমাদের একথা বোঝাতে হবে না, কিন্তু তার স্থায়ী সমাধানটাতো তাদেরই করতে হবে যারা এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের পক্ষে দাবি করে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের সমর্থন আদায় করে থাকেন, তাই না? কিন্তু কী দেখছি? বিগত পাঁচ বছরে যতোগুলো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার একটারও কি চূড়ান্ত বিচার হয়েছে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কি হয়েছে কোনো পাকিস্তানি প্রেতাত্মার? বরং কোথাও কোথাও পৃষ্ঠপোষকতার খবর এসেছে, থানায় মামলা না নেওয়ার অভিযোগ শুনেছি, আর দেখেছি নির্যাতনকারীদের কোনো কোনো মন্ত্রী আশে-পাশেই রেখেছেন।

এবার জবাব দিন যে, আপনাদের এই দাবির প্রতি আর কতো এবং কেন সাধারণ মানুষ “লয়াল” থাকবে? কীসের আশায়? কীসের ভরসায়? তার চেয়ে ভালো না, রাষ্ট্রই এখন ঠিক করুক, তারা অবশিষ্ট ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এদেশে রাখবে কি না? যদি রাখে তাহলে তাদেরকে কী হিসেবে রাখবে? মানুষ হিসেবে নাকি মনুষ্যতর হিসেবে? আর যদি রাখতে না চায় তাহলে সেটাও বলুক, অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে সেদেশ থেকে নিয়ে আসুক কিছু এদেশের সংখ্যাগুরুর ধর্মবিশ্বাসীদের, আর বিনিময়ে ফেরত পাঠাক এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমান অংশ। সেটাও না পারলে, রাষ্ট্র বলে দিক, এই ক্রমশ নিশ্চিহ্ন হওয়াদের কোনো দায়িত্বই তারা নিতে পারবে না, তাহলে তারা নিজ উদ্যোগেই হয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, না হয় যার যার ভাগ্য নিয়ে যে যেখানে পারে টিকে থাকার চেষ্টাটা অন্তত করুক। কিন্তু যদি রাষ্ট্র তা না মনে করে, তাহলে অবিলম্বে এদেশ থেকে পাকিস্তানপন্থি রাজনীতি, রাজনীতিক, সুশীল আর তাদের অর্থের যোগানদারদের শায়েস্তা করুক। এখন পথ দু’টো-- হয় এটা, নয় ওটা। সিদ্ধান্ত এখন রাষ্ট্রের নতুন সরকারেরই।

ঢাকা॥ ৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার॥ ২০১৪॥
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।