ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংখ্যালঘু-সংখ্যাতত্ত্বের খতিয়ান: একটি প্রস্তাব

ড. মঞ্জুরে খোদা টরিক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
সংখ্যালঘু-সংখ্যাতত্ত্বের খতিয়ান: একটি প্রস্তাব ছবি:বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ফাইল ফটো

সংখ্যালঘু শব্দ নিয়ে দেখলাম অনেকের আপত্তি। এই আপত্তির পেছনে যে যুক্তি ও বিবেচনা তাতে আমিও সহমত পোষণ করি।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে অন্য কোন নামে ডাকলে কি এই মানসিকতা ও কারণের কোন পরিবর্তন বা তারতম্য কি ঘটবে? তাতে কি তাদের উপর হামলা-নির্যাতন কমবে? তাদের সন্মান, মর্যাদা ও নিরাপত্তা কি বাড়বে?

গোলাপের নাম পরিবর্তন করে যদি ধূতরা ফুল রাখা হয় তাতে কি তার সৌন্দর্য, গন্ধ ও গুণের কোন পরিবর্তন ঘটবে? সম্বোধনের রুচি ও সংস্কৃতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সে জন্য চাই নাগরিকদের সেই মানের শিক্ষা ও মনস্তত্ত্বের পাঠ যা আসে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্র থেকে। আর সাম্প্রদায়িকতার উপাদান সবখানে রেখে তার পুষ্টির যোগান বন্ধ না করে এর চর্চা ও গুণগত পরিবর্তণ শুধু কঠিনই না, অসম্ভব...।    

১৯৫১ সালে এই ভূখণ্ডে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ২৩ ভাগ, ১৯৬১ সালে তা ছিল ১৯, ১৯৭৪এ ১৪, ১৯৮১তে ১৩, ১৯৯১এ ১১, ২০০১এ ১০ এবং বর্তমান সময়ে ৭ ভাগের নীচে অবস্থান করছে। এ হচ্ছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ক্রমহ্রাসমান ধারার সংখ্যাতত্ত্ব। এবার দেখা যাক এই সময়ে তাদের সম্পদের মালিকানা গেছে কাদের দখলে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাত তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন- প্রতিবছর প্রায় ২ লক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর তাদের রেখে যাওয়া ভিটে-মাটি-সম্পদের মালিক হচ্ছেন এ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা।

তার হিসেবে তাদের রেখে যাওয়া জমির মালিকানার শীর্ষে আছে আওয়ামী লীগের নেতারা, তাদের দখলে ৪৪.৩ ভাগ, বিএনপি নেতাদের দখলে ৩১.৭৫ ভাগ, জাতীয় পার্টির নেতারদের দখলে ৮ ভাগ আর জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের দখলে আছে ৫ ভাগ সম্পত্তি। সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের প্রধান কারণ কেবল রাজনৈতিক নয়, এর আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক। উল্লেখিত তথ্য ও পরিসংখ্যান এই বাস্তবতার স্বাক্ষ্য দেয়। এই রাজনৈতিক অসাধুরা কেবল সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এবং পরিস্থিতি সৃষ্টি করে- যার ধারাবাহিকতা ও দূরভিসন্ধির চালে জয়যুক্ত হয় তাদের কুৎসিত আকাঙ্খা। অসহায় ও অরক্ষিত এই আদি জনগোষ্ঠী কেবল জীবন ও বেঁচে থাকার তাগিদে হয় দেশান্তর, আর সেই দুষ্টচক্রে তাদের ভিটা-সম্পদ চলে যায় অন্তরালে থাকা রাজনীতির সেই খলনায়কদের হাতে।    

গত বছর সাঈদীর ফাঁসির রায়ের পর দেশের প্রায় ৫১ টি জেলায় ১৪৬ টি মন্দির, ২৬২টি বাড়ি-ঘর, ২১৯টি দোকানে অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে, ৫০০টি পরিবার নিঃস্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত, ৫ জন নিহত এবং ৬৫ জন আহত হয়েছে। নতুন বছরের শুরুতেই নির্বাচনের পর আবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো বিভিন্ন জেলায়। আবারও সেই গতানুগতিক প্রতিবাদ, প্রতিশ্রুতি ও সমবেদনা। ২০০১ সালে অভিন্ন ঘটনায় ২৭টি মামলা হলেও আজ পর্যন্ত তার একটিরও বিচার হয়নি। সমগ্র ঘটনার একটি শ্বেতপত্র আজ অবধি প্রকাশ হয়নি, দেখলাম না একটি মামলার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও!

সত্যিই যদি এই সমস্যার দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান করতে হয় তাহলে “সম্পদ লোভাতুর ও গ্রাসকারী মানুষের খতিয়ান ও রাজনৈতিক পরিচয়” বের করা জরুরি, এজন্য প্রয়োজন গণতদন্ত ও বিশেষ বিচার। তা কি আজ সহজে করা সম্ভব?

একটা দিক হচ্ছে ফৌজদারি অপরাধ, যেটা দৃশ্যমান, কিন্তু আরেকটি যে সুদূরপ্রসারী কারণে ফৌজদারি অপরাধ সঙ্ঘটিত হচ্ছে তার উদঘাটন করা। তা করা না গেলে এই ধারাবাহিক হামলা বন্ধ করার আহ্বান-অঙ্গীকার হবে এই প্রশ্নের খণ্ডিত বক্তব্য ও বিষয়।

কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকায় দেখলাম, হিন্দু পরিবারগুলোর উপর হামলার মামলাগুলো দ্রুত বিচার আদালতে প্রেরণের জন্য মন্ত্রনালয় থেকে একটি চিঠি/দরখাস্ত বিচার বিভাগে পাঠিয়েছে। এতে সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা কিছুটা প্রকাশ পায়। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, সরকারের কি ধারণা এই ঘৃণীত অধ্যায়ের এখানেই শেষ..?

বাংলাদেশের বর্তমান দল ও রাজনীতির যে অসুস্থ কাঠামো যার কোন গুণগত পরিবর্তন তো হয়নি বরং উল্টোমুখী, তাতে এই ঘটনার ধারাবাহিক আশঙ্কার কারণ, শতভাগ আছে বলা যায়। বর্তমান ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভোটের রাজনীতির বিদ্যমান ধারা জয়-পরাজয়ের সঙ্গে “ধর্মের তথাকথিত সংখ্যালঘুদের” উপর বিপদের পূর্বাভাস আজ অনিবার্য অংশে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রিক সহিংসতার নজির দেখলেই এই বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। এ অবস্থার সহজেই পরিবর্তন হবে এমন আশা করাটা বোকামি। তার জন্য যা করা দরকার- আমাদের রাজনীতি, শিক্ষা, প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতি, নীতি ও নৈতিকতা এখনও প্রস্তত নয়। সেই জন্যই এটা যেহেতু আমাদের ধারাবাহিকতার অংশ তাকে নিয়ন্ত্রণ ও আইনের অধীনে রাখতে বারবার আবেদন-নিবেদন না পাঠিয়ে বিদ্যমান আইন ও কাঠামোর পরিবর্তন করাটা জরুরি। যদিও তা করাটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

সেই বিবেচনা থেকেই এই মতামত রাখছি, নারী নির্যাতন বিশেষ আইনের আদলে “সংখ্যালঘু নির্যাতন বিশেষ আইন এবং একটি স্থায়ী ও দ্রুত বিচার আদালত/ট্রাইবুনাল” গঠন করা হোক। যেখানে অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার জন্য প্রধানত আলামতই হবে যথেষ্ট। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ফৌজদারি মামলা আইনের কিছু বাধ্যবাধকতা, পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া, বিচারিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক ও স্বাক্ষীর নিরাপত্তা ইত্যাদি কারণে দুষ্কৃতিকারীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ দমনে যেমন পুলিশের একটি বিশেষ শাখা আছে অনুরূপ ‘ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের” নিরাপত্তার জন্যও তৈরি করা হোক।  

যা ঘটছে বাস্তব পরিস্থিতি আসলে তার চেয়ে ভয়াবহ। আমরা যা দেখছি তা হচ্ছে বরফের সেই অংশ যা আমাদের নজরে পড়ে, কিন্তু তার বহুগুণ পানির নীচে থাকে, যা দৃশ্যমান নয়। রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার বিভিন্ন উপাদান বিদ্যমান যা নানাভাবে হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছে। আর তা যদি অব্যাহত থাকে তাতে কোন ভাবেই বলা যায় না এই বিপদ দিনদিন কমবে।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জিয়াউর রহমান, এইচ. এম এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা- কোন সরকারের সময়েই এদের ক্রমবর্ধমান বিলুপ্তি ঠেকানো যায় নি, তার প্রমাণ উল্লেখিত তথ্য। সব সরকারের আমলেই তা অব্যাহত ছিল এবং আছে। সুতরাং কোন সরকারই এর দায় এড়াতে পারে না। আর এই অবস্থার উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে দেশের অন্যান্য ধর্ম-জাতি-গোষ্ঠীর স্বার্থে “একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি এবং তার আলোকে নতুন আইন প্রণয়ন বা বিদ্যমান আইনের সংশোধন করা”। একই সঙ্গে তা প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা তৈরি করা যাতে করে তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয় এবং বছরের পর বছর আর ‘নিজ ভূমে পরবাসের গ্লানি’ বহন করতে না হয়।

ড. মঞ্জুরে খোদা টরিকঃ লেখক, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, জাপান

বাংলাদেশ সময়: ০৯০১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৪
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।