ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ আষাঢ় ১৪৩১, ০২ জুলাই ২০২৪, ২৪ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

ধর্ষণের জন্য নারী কখনই দায়ী নয়

ড. জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৪
ধর্ষণের জন্য নারী কখনই দায়ী নয়

সম্প্রতি ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের বিশিষ্ট নারী নেত্রী আশা মির্জা দাবি করছেন, মূলত নারীর পোশাক, দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণই ধর্ষণকে উস্কে দেয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই কোনো নারীরই উচিত নয় এমন কোনো পোশাক পরা বা এমন কোনো আচরণ করা অথবা এমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করা যাতে পুরুষরা ধর্ষণে উন্মত্ত হয়।

 

 

ভেবে অবাক হয়েছি, একজন নারী তার উপর একজন নারী নেত্রী(!) হয়ে তিনি কিভাবে পরোক্ষভাবে ধর্ষণের পক্ষেই সাফাই দেবার একটি মোক্ষম প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে দিলেন!

 

ভাবখানা এমন, চুরি করব না তো কি, সে কেন আলমিরাতে তালা দিয়ে যায়নি? অর্থ্যাত যে আলমিরাতে তালা দেয়নি, চুরির দায় অনেকাংশেই তার। আসলেই কি তাই? নৈতিকতা বলে কি মানুষের মাঝে কিছু থাকতে নেই?

 

তবে আমি নিশ্চিত যে, আমাদের সমাজে পুরুষদের মধ্যেও অনেকেই আছেন যারা আশা মির্জার কথাগুলোকে অন্ধভাবে সমর্থন করবেন। তাদের উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এই লেখা।  

 

ধর্ষণের জন্য কখনই নারীর পোশাক-আশাক, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি কোনভাবেই দায়ী নয়। তাই যদি হত তাহলে একাত্তরে আমাদের মা-বোনেরা কি এমন পোশাক পরেছিলেন ও আচরণ দেখিয়েছিলেন যে, পাকিবাহিনী তাদের নির্মমভাবে ধর্ষণ করেছিল? কেউ কি পাকিদের ধর্ষণের জন্য উন্মত্ত করেছিলেন সে সময়?

 

প্রাসঙ্গিক জন্যই  ডা. এম এ হাসান লিখিত “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থ থেকে সেসময়ের নারী নির্যাতনের কিছু উদ্বৃতি দিচ্ছি।  

 

“২৬ মার্চ ১৯৭১, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ধরে আনা হয়। মেয়েরা আসা মাত্রই সৈনিকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি মহিলা এবং বালিকার পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে ধর্ষণে লিপ্ত হতে থাকে। …পাকসেনারা ধর্ষণ করেই থেকে থাকেনি, সেই মেয়েদের বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দেয়, মাংস তুলে নেয়। মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বুক, পিঠ ও কোমরের অংশ তাদের কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকে প্রতিদিন। যেসব মেয়ে প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করত তাদের স্তন ছিড়ে ফেলা হত, যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। বহু অল্পবয়স্ক বালিকা উপর্যুপরি ধর্ষণে নিহত হন। এর পরে লাশগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দেওয়া হত। ” 

 

পাকিবাহিনী বলুন আর যে কোনো ধর্ষণকারীই বলুন- এরা আসলে মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। এদেরকে পশু বললেও পশুজাতির অবমাননা করা হয়। তাই এদের শুধুই ঘৃণ্য ধর্ষণকারী নামে গণ্য করা হোক।  

 

এখন বলুন একাত্তরের নারী ধর্ষণে নারী সমানভাবে দায়ী হয় কিভাবে?

 

যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়, যখন সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে তাদের স্ত্রী-কন্যাদের উপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়, তখনও কি আশা মির্জা ও তার সমর্থকরা বলবেন যে নারী নিজেই তার ধর্ষণের জন্য দায়ী?

 

ইয়াসমিনের মত মেয়েরা যখন বাসায় পৌছানোর জন্য পুলিশের সাহায্য নেয়, তখন ইয়াসমিনের কোন আচরণের কারণে তাকে ধর্ষিতা হতে হয়েছিল? 

 

মাথায় হিজাব পরেও কি রক্ষা পেয়েছিল দক্ষিণখানের নোয়াপাড়া আমতলার ব্র্যাক চালিত একটি ক্লিনিকের খণ্ডকালীন চিকিত্সক ডাঃ সাজিয়া?  

 

কারো কাছে কি কোনো যুক্তি আছে কেন ২ বছরের শিশুকে ধর্ষিতা হতে হয়?

 

উপরের সবগুলো ঘটনায় নারী কিভাবে ধর্ষণের জন্য সমানভাবে দায়ী কেউ কি বলতে পারে? 

 

আসলে ধর্ষণের জন্য নারী নয়, ধর্ষনকারীর বিকৃত মানসিকতাই এককভাবে দায়ী। ধর্ষণকারী কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ নয়। ধর্ষণকারী নারীর পোশাক, বয়স, আচরণ কোনো কিছুই আমলে নেয় না। বিকৃত কাম চরিতার্থে নারীরা এদের শিকার হয়।  

 

ধর্ষণকারীর পক্ষে তাই কোনো সাফাই নয়। এদের দরকার উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সেইসঙ্গে যথাযথ চিকিত্সা।

 

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

 

বাংলাদেশ সময়: ১২১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।