ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অহিংস পথে নবযাত্রা

শরিফুজ্জামান শরিফ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪
অহিংস পথে নবযাত্রা

কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে বিক্ষোভ শুরু হলে সিলেটের স্কুল শিক্ষিকা নূরজাহান মানতাসা ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন , “বুকের ভেতর আমি একরাশ ঘৃণা লালন করি- জ্বালিয়ে রেখেছি আগুন। সব সময় আমার বাচ্চাদের ভেতরে ঘৃণাটা ঢুকিয়ে দেই।

এটা আমি সারাজীবন করে যাব, আমার ভেতরের আগুন আমি নেভাতে  দেব না। ”

বোঝা যায় সেই  আগুন হল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আগুন। নূরজাহানের মতো কোটি কোটি মা নিজেদের তাগিদে  চল্লিশ বছর ধরে  সন্তানদের মনে এই আগুন জ্বালিয়ে চলেছেন। রাষ্ট্র যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে মানুষের মন থেকে  মুক্তিযুদ্ধের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছে তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম শাসক ও  সংগঠিত সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে  লড়েছেন তাদের পরাস্ত করতে, দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সেই সংগ্রাম অসমাপ্ত রেখে চেতনার মশাল জ্বালিয়ে রেখে  চলে গেলেন।

সেই সময়ে আমাদের দেশের সাধারণ মায়েরা নূরজাহানের মতো অসাধারণ কাজ করে শহীদ জননীর সেই চেতনার মশাল জ্বালিয়ে চলেছেন নিজ উদ্যোগে-নিজ পরিসরে। তার বহিঃপ্রকাশ ছিল এক বছর আগের  সারাদেশের  শাহবাগ গুলো।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বড় রাজাকারদের শাস্তির দাবিতে শাহবাগ এবং অন্যান্য শহরে যে গণজাগরণের সূচনা হয়েছিল তাকে অনেকেই নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ বলছেন। আমাদের দেশে নানা সময়ে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে, তবে এরশাদের পতনের পর ওই  ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত, নির্দলীয়, লাগাতার বিক্ষোভের ঘটনা এটাই-ই প্রথম। সেই  আন্দোলনের বৈশিষ্ট ছিল শুরুতে ওখানে সে ধরনের পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব ছিল না, আন্দোলনের প্রাণ শক্তি ছিল  তরুণরা,  আর তাদের  প্রায় সবাই ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সমাবেশগুলো ছিল সুশৃঙ্খল, নিজেদের উদ্যোগে তারা  এসেছেন - অন্যদের নিয়ে এসেছেন। আন্দোলন ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর অহিংস পন্থা ছিল ওই আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্য।  

অভিযোগ আছে, আমরা নাকি ইতিহাস সহজে ভুলে যাই। কিন্তু তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে, অভিযোগটা সত্য নয়। লক্ষ-লক্ষ তরুণের এই চাওয়া ছিল ন্যায্য- দৃঢ়-অথচ উত্তেজনাপূর্ণ ।

দেশে সু-শাসনের অভাব, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিস্তার দেখে যারা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, তাদের মনে তারুণ্যের জাগরণ আশা জাগিয়েছে। এই  আন্দোলন রাজনীতি- সমাজ জীবনে প্রভাব ফেলেছে। আগামীতেও এই আন্দোলনের বর্ণিল আলোয় বাংলাদেশ সঠিক পথ খুঁজে পাবে, পথ চলবে। জেগে ওঠা- বিজয়ী হওয়ার সেই আন্দোলনের ভিত্তি-ই ছিল তারুণ্য নির্ভর আর অহিংসতা।

তারা ওখানে সমবেত হয়েছিল ইতিহাসের দায় শোধ দিতে। চার দশক ধরে যে আগুন দেশের মানুষের বুকে জ্বলছিল সেই আগুনের শিখার প্রকাশ ছিল ওই আন্দোলন। এই প্রজন্ম গত বিশ বছরে এখানে কৌশলের নামে জামায়াতের সঙ্গে কিছু রাজনীতিবিদের  নীতিহীন আঁতাত দেখেছে, দেখেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শত্রুদের মন্ত্রী হতে, এদের প্রশ্রয়ে ধর্মের নামে সারাদেশে বোমা হামলা হতে, শুনেছে অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশকে সন্ত্রাস কবলিত আফগানিস্তান বানানোর আস্ফালন, দেখেছে পুলিশকে আক্রান্ত হতে বা কখনো রাষ্ট্রের নীরবতার মুখে রাস্তায় রাস্তায় তাদের পরিকল্পিত সন্ত্রাস, দেখেছে গুরুপাপ করেও লঘু দণ্ড নিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে চিহ্নিত ঘাতকের আদালত ত্যাগের দৃশ্য। আর সেই দুঃসহ স্মৃতি, ঘটনা,  মানুষকে বিক্ষুব্ধ করেছে।  

হাজার হাজার তরুণ- নারী- শিশু বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। পাঠকের মনে আছে- এই আন্দোলনকে যারা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করেছে তারা এই তারুণ্যের উত্থানকে দমন করতে চেয়েছে শক্তি দিয়ে- মিথ্যাচার দিয়ে। কেউ কেউ এই  এদের  ফ্যাসিবাদি বলেছে। অথচ দেখা গেছে অহিংসার পথে থাকা তরুণরাই ফ্যাসিবাদি আক্রমণের শিকার হয়েছে বার বার। তরুণদের উপর হামলা করে- বোমা মেরে- হত্যা করে- মিথ্যাচার করে- বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।   বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে এর আগের  কোন আন্দোলনকে এতো মিথ্যাচার- বিভ্রান্তি মোকাবেলা করতে হয়নি। যারা এই জাগরণে ভীত হয়েছে  তারা তরুণদের উপর বোমা- গ্রেনেড নিয়ে হামলা করেছে। তাদের হত্যা করেছে- বাড়িতে গিয়ে, রাতের আঁধারে- ওদের হামলায় আহতদের হাসপাতালের বিছানায় গিয়েও হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে।

এতো বেশি সংখ্যক তরুণ যে আন্দোলনে শামিল হয়েছে সেখানে একটা ঢিল না ছোড়ার ইতিহাস এই প্রথম। শাহবাগের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যেখানে ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া গণহত্যার এ দেশীয় প্রধান পরিকল্পনাকারী গোলাম আজম অবস্থান করছিলেন। কয়েকশ’ গজ দূরে ছিল জামায়াত বা ছাত্রশিবির এর অনেকগুলো স্থাপনা-  তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

সমাবেশ স্থল থেকে এই তরুণদের আন্দোলনের প্রধান সমালোচক আমার দেশ পত্রিকার অফিসের দূরত্ব খুব বেশি ছিল না। যে পত্রিকা ও তার সম্পাদকের বিরুদ্ধেও ওখান থেকে শ্লোগান উঠেছিল। কিন্তু হাজার হাজার শুদ্ধ তরুণের সমাবেশ থেকে ওই সব প্রতিষ্ঠানে একটা ঢিল ছোড়া হয়েনি। পিজি হাসপাতালের অনেক চিকি‍ৎসক, নার্স, কর্মচারী, কর্মকর্তা এসে তরুণদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। আবার তারাই হয়তো ফিরে গিয়ে গোলাম আজমকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। প্রথমটা করছেন তাদের চেতনা থেকে, পরেরটা করছেন তাদের দায়িত্ব থেকে। দায়িত্ব পালন আর চেতনার এই অভূতপূর্ব সম্মিলনের উদাহরণ কে কোথায় দেখেছে? একদিকে হায়েনা অন্যদিকে নিরস্ত্র তরুণদের উত্তাল জাগরণ- ওটাই ছিল দু‘টো পক্ষের মধ্যে পার্থক্য।

এক বছর আগে ঘটে যাওয়া এই জাগরণ নিয়ে সমাজ বিশ্লেষক- রাজনীতিবিদদের ভাবনার প্রয়োজন আছে। তাদের খুঁজতে হবে এই প্রজন্ম এভাবে রাস্তায় নেমে এলো কেন? একই সঙ্গে তাদেরকে তারুণ্যের এই চাওয়া পূর্ণ করতে- তাকে এগিয়ে নিতেও অঙ্গীকার করতে হবে।

আসছে  ৫ ফেব্রুয়ারি আমরা বলব এক বছর পার হয়ে গেল- পরের বছর দুই বছর এভাবে সময়ের ব্যবধানে সংখ্যা বাড়তে থাকবে। নানা ঘটনা বহুল এই বিক্ষোভ গৌরবের ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেবে। তবে অনেকে একমত হবেন  তারুণ্যের এই জাগরণ রাজনীতির মধ্যে একটা সীমারেখা টেনে দিয়েছে। দু’টো পক্ষে আমাদের বিভক্ত করেছে। একটা হ্যাঁ- বাংলাদেশ এরপক্ষ অন্যটি না– বাংলাদেশ পক্ষ। নূরজাহানরা তাদের সন্তানদের ভেতরে যে আগুন জ্বালিয়ে চলেছেন সে আগুনের স্ফুলিং না বাংলাদেশের শক্তিকে পুড়িয়ে দেবে, আলোকিত করবে আগামীর বাংলাদেশকে, হ্যাঁ বাংলাদেশকে।   মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটা শোষণমুক্ত, আলোকিত বাংলাদেশ গড়তে এরাই জ্বালিয়ে যাবে দ্রোহের আগুন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। শাহবাগের চেতনার বর্ণিল আলোয় পথ চলবে আমাদের প্রিয় দেশ- সোনার বাংলাদেশ।

শরিফুজ্জামান শরিফ: সাবেক ছাত্রনেতা

বাংলাদেশ সময়: ২২৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।