ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একুশের চেতনা: ভাষা নিয়ে ভাসাভাসা কথা ও আমাদের ভাষানীতি

-ড. মাহরুফ চৌধুরী- অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪
একুশের চেতনা: ভাষা নিয়ে ভাসাভাসা কথা ও আমাদের ভাষানীতি

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে আমাদের মাতামাতি সত্যিই চোখে পড়ার মতো। আর তখনই আমরা সবাই আবেগে বিগলিত হয়ে পড়ি এবং আমাদের ভাষাকেন্দ্রিক জাতিসত্তার পরিচয়ের কথা মাসব্যাপী নানা আচার আর উপাচারে স্মরণ করি।



গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিনিয়ত মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের গৌরবগাথা নিয়ে নানা কথার ফুলঝুড়ি দেখা যায়। কিন্তু, এসব কিছুই আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ঘিরে আবেগের ঘোরে ভাসা ভাসা কথাবার্তার বহির্প্রকাশ মাত্র। তাই শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই আমরা ভাষা নিয়ে ভাসা ভাসা কথা আর মায়াকান্নায় প্লাবিত হতে দেখি আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

অথচ যে ভাষাকে কেন্দ্র করে আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ লাভ, স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলাদেশের কোনো সরকারই এখন পর্যন্ত একটি ভাষানীতি জাতিকে উপহার দিতে পারেনি। আহা! আমাদের ভাষাপ্রেম যেন মাছের মায়ের পুত্র শোকের মতোই।
 
আমরা কখনোই ‘একুশের চেতনা’র তাৎপর্য নিয়ে ভাষার গুরুত্ব অনুধাবনের চেষ্টা করি না। আমরা সচেতনভাবে নয়, অবচেতনভাবেই প্রতিনিয়ত আমাদের মাতৃভাষার ব্যবহারের বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছি। আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তিভূমি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ক্ষতি সাধন করে চলেছি। জাতীয় ভাষা বাংলা আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয়ের ভিত্তিমূল।

বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি রচনায় মাতৃভাষা বাংলার অবদানের স্বীকৃতি রয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতিতে। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতিতে আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার অবস্থান কী অথবা জাতীয় পর্যায়ে আমাদের ভাষানীতি কী হবে, সে সম্পর্কে তেমন কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। একমাত্র আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটকে কার্যকর ও সমৃদ্ধ করার কথা ছাড়া।

প্রকৃতপক্ষে জাতীয় শিক্ষানীতিতে আমরা আমাদের জাতিসত্তা সংগঠনের মৌল উপাদান বাংলা ভাষাকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় যথাযথ স্থান দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
 
প্রতিবছর একুশে ফেব্রয়ারি এলেই আমাদের মাতৃভাষার জন্য কত না মায়াকান্না শোনা যায়! অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান কোথায়! বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে বাকি ৩৬৪ দিন আমরা কী করছি!

কয়েক বছর আগের কথা, কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারির দিন মধুর ক্যান্টিনে বসে আছি কয়েক জন বন্ধুসহ। হঠাৎ করে এক বন্ধু প্রস্তাব দিলো- আমরা তো সারাজীবন কতই না পরীক্ষা দিয়ে আসলাম। আসো তো, আজ আমরা সবাই মিলে আমাদের মাতৃভাষাপ্রীতির পরীক্ষা দেই। সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো।

একজন বললো, সেটা আবার কেমন? বন্ধুটি বলল, দেখা যাক, এখন থেকে এই আড্ডাতেই আমরা ইংরেজি বাক্য বা বাক্যাংশ ব্যবহার না করে কে কতক্ষণ কথা চালিয়ে যেতে পারি!

সে দিনের সেই পরীক্ষায় পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমরা সবাই ব্যর্থ হলাম। সে বন্ধুটি এটা বললো যে, দিনটা তো আর আটই ফাল্গুন হিসেবে পালিত হয় না। পালিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারি হিসেবে। তবে আমাদের আর কী দোষ? এখানেই তো আমাদের প্রথম সাংস্কৃতিক পরাজয়।

সে দিন এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা আর এগোয়নি। কিন্তু, সেদিনের সেই ঘটনা আমাকে ভাবিত করে তোলে এবং চারপাশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে আমি প্রতিদিনই আমাদের জাতিগত আত্মপরিচয়ের অবলুপ্তি প্রত্যক্ষ করছি।
 
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের বুদ্ধিজীবীরা আর তথাকথিত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে ভাসা ভাসা কথা বলেই তাদের দায়দায়িত্ব শেষ করেন। অপরদিকে, বায়ান্নোর ভাষাসৈনিকেরা টেলিভিশনের পর্দায় তাদের স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে দিয়েই শেষ করেন এ মাসটি। দুর্ভাগ্য আমাদের! বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার সৈনিক হয়েও তাদের জীবদ্দশায় বাংলা ভাষার যে হাল, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই কিংবা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারা তা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।

বাংলা ভাষার অস্তিত্বের জন্য হুমকি- ডিজুস ভাষা, বাংলিশ ভাষা আর বাংলাদেশি ইংলিশ ভাষার ব্যবহার যে আমাদের ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার পরিচয়কে ম্লান করে দিচ্ছে দিনকে দিন সেটা তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন।

তাদের যে জায়গায় বাংলা ভাষাকে ও আমাদের ভাষাগত জাতীয়তার পরিচয়কে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা, শুনেছি তাদের কেউ কেউ নাকি কনসালট্যান্সি নামক উপরিপাওনায় চোখ বুজে মুখ বন্ধ করে থাকেন। কারণ, তাদের পকেট গরম হলে জাতির কী হলো, বা না হলো, তাতে তাদের আর কিছু যায়-আসে না।
 
আমাদের দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষা শেখার নামে চলছে তুঘলকি কাণ্ড! চেতন বা অবচেতনভাবে আমরা অনেকেই এর অংশীদার। মনে পড়ে, আশির দশকে পশ্চিম বাংলার একজন সাহিত্যিক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিদর্শনে এসে আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ শুধু বাংলা ভাষাকে জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেনি, এর বিকাশ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেছে।

তিনি ঢাকার সঙ্গে কলকাতার তুলনা করে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ঢাকায় যেখানে সব সাইন বোর্ড, সড়কের নাম ফলক, বিলবোর্ড সবই বাংলাই লেখা, সেখানে কলকাতায় অধিকাংশই ইংরেজি কিংবা হিন্দিতে লেখা। তারা এখন আইন করে বাংলার প্রচলনে সাফল্যের দিকে।

যাই হোক, দু’দশকের ব্যবধানে এখন যদি তিনি ঢাকায় বেড়াতে আসেন, তবে কী তিনি আশ্চর্যান্বিত হবেন না! ঢাকা শহরের অধিকাংশ সাইন বোর্ডই এখন ইংরেজিতে লেখা কিংবা বাংলা হরফে ইংরেজিতে অথবা বাংলা নাম রোমান হরফে লেখা।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ডগুলোর দিকে তাকালেই অতি সহজ বোঝা যাবে যে, আমরা কতটুকু গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়েছি! গুলশান ও বারিধারার ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য হয়ত ইংরেজি সাইন বোর্ড বিশেষ গুরুত্ব বহনকারী। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজনটা কোথায়!

ভাবতে কষ্ট হয়, এটা সেই বাংলাদেশ, যার জন্ম হয়েছে একটা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এটা কি আমাদের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ কিংবা বায়ান্নোর ভাষা সৈনিকদের নজরে আসে না?

এটা কি তাদের একটুও ভাবায় না? উপনিবেশিক শাসন আমলে যেখানে আমাদের ভাষা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো পরিবর্তন করতে পারেনি, সেটা এখন অবলীলায় পরিবর্তিত হয়ে চলেছে স্বাধীন বাংলাদেশে।
 
ভাষা আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও আমরা যে ইংরেজি শেখার প্রতি অতি উৎসাহী হয়ে আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল চালিকা শক্তি আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে উপেক্ষা করছি, সেটার পরিণাম যে, ভালো হবে না, সেটা বোঝা কী যায় না আমাদের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দেখলে!

অধিকাংশ চ্যানেলের নাম হয় ইংরেজি, না হয় রোমান বর্ণমালায় লেখা বাংলা নাম। আর সেগুলোর প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলোর নামও তদ্রুপ। তারপরও কি আমরা বলবো, বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বিকাশ হচ্ছে?

আমরা ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী নই। আমাদের অভিমত হলো, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার নামে কোনো অবস্থাতেই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা শেখানোকে উপেক্ষা করা চলবে না।

আমরা সবাই জানি যে, ফরাসী ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষায় ফ্রান্সকে আইন পর্যন্ত প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। ইসরাইলের ইহুদিরা যেভাবে একটা মৃত ভাষা হিব্রুকে তাদের জাতীয় পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পুনর্জীবিত করে তুলেছে; তারই বিপরীত প্রক্রিয়ায় আমরা আমাদের জীবন্ত মাতৃভাষা বাংলাকে ঠেলে দিচ্ছি মৃত্যুর দিকে। কেন এই আত্মহনন!
 
যে ভাষা আমাদের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি, সেটাকে উপেক্ষা করতে শেখার মধ্য দিয়েই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এদেশে প্রথম বীজ বুনেছে সামাজিক প্রকৌশলের। আমাদের নতুন প্রজন্ম এখন মেতে উঠেছে বিশ্বায়নের মাতাল হাওয়ায়; যে হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অনুকূলে।

আসুন, সবাই মিলে নব প্রজন্মের এ উন্মাদনাকে সামাল দেই। নতুবা একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া আর খালি পায়ে প্রভাতফেরী করা আমাদের ভণ্ডামিরই নামান্তর হবে।

প্রকৃতপক্ষে, ভাষানীতির প্রশ্নে আমাদের অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারস্থ হতে হবে। কারণ, তার প্রজ্ঞাপ্রসূত উচ্চারণ- ‘যদি অরণ্যে-রোদনও হয়, তবু বলিতে হইবে যে, ইংরাজি ফলাইয়া কোনো ফল নাই, স্বভাষায় শিক্ষার মূলভিত্তি স্থাপন করিয়াই দেশের স্থায়ী উন্নতি; ইংরাজের কাছে আদর কুড়াইয়া কোনো ফল নাই, আপনাদের মনুষ্যত্বকে সচেতন করিয়া তোলাতেই যথার্থ গৌরব; অন্যের নিকট হইতে ফাঁকি দিয়া আদায় করিয়া কিছু পাওয়া যায় না, প্রাণপণ নিষ্ঠার সহিত ত্যাগ স্বীকারেই প্রকৃত কার্যসিদ্ধি’ (রাজা প্রজা, ১৯০৮, পৃ.-১৬)।
 
একটি স্বাধীন দেশে বাংলা ভাষাকেই যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি, ইংরেজি আর হিন্দি ভাষার আধিপত্য থেকে, তবে মাতৃভাষা দিবসে ভাষা শহীদের সম্মান করা আর স্বাধীনতা দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিরিশ লাখ মানুষের আত্মদানকে স্মরণ করে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ বলার মধ্য দিয়ে তাদের আত্মত্যাগকে আমরা মহিমান্বিত করে তুলতে ব্যর্থ হবো। আর এ ব্যর্থতার দায়ভার আমাদের সবার!

ড. মাহরুফ চৌধুরী-

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।