ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নগ্ন মডেল, একজন তসলিমা ও নারী স্বাধীনতা

ড. জিনিয়া জাহিদ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৪
নগ্ন মডেল, একজন তসলিমা ও নারী স্বাধীনতা

এক.
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ম্যাকস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পোশাকের জায়ান্ট ক্রেতা আমেরিকান অ্যাপারেলসের মডেল হয়েছেন। পোশাকের মডেল তিনি, অথচ গায়ে কোনো পোশাক নেই!  জানিনা কতখানি ফটো-শপের কারসাজি, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে মডেল হিসেবে তিনি অত্যন্ত আকর্ষণীয়।

আর আকর্ষণীয় ফিগারের এই নারীকে সম্পূর্ণ নগ্নবক্ষা করে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে আমেরিকান অ্যাপারেলস হয়ত তৃপ্ত, কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে, একজন বাঙালি নারী হয়ে আমরা কি গর্বিত হতে পারছি?
 
নগ্নবক্ষা নারী কিংবা সম্পূর্ণ নগ্ন নারী পাশ্চাত্যে এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মিডিয়াতে নতুন কিছু নয়। এই বিজ্ঞাপন নিয়েও হয়ত কেউ মাথা ঘামাত না যদি না বাংলাদেশে জন্ম নেয়া এই মডেল তার নগ্ন ছবির উপর সমগ্র বাংলাদেশির অতি গর্বের একটি বাক্য ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লিখে আবেদনময়ী হয়ে পোজ না দিতেন।
1_762
আমরা নারীরা শালীনতার সঙ্গে নিজেদের মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যখন একটু একটু করে গরীব এই দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি, তখন বাঙালি চেহারার এই নারী নিজেকে নগ্ন করে বাংলাদেশের তৈরি বলে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে কি বার্তা দিতে চাইছেন?

একসময় মানুষ গাছের ছাল-পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জাস্থান ঢেকে রাখত। পোশাকবিহীন সেই সময়ের মনুষ্যজাতিকে অসভ্য বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। বলাবাহুল্য, মানুষের পোশাক সভ্যতার পরিচয় বহন করে। পোশাকের মধ্য দিয়েই মানুষ তার সংস্কৃতি, জাতীয়তা, ধর্ম, ব্যক্তিত্ব ও রুচির পরিচয় দিয়ে থাকে। কাজেই মানুষের জন্য পোশাক অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কিন্তু নিজেদের সব চেয়ে সভ্যজাতি হিসেবে পরিচয় দানকারী দেশগুলো যখন নারীকে নগ্ন করে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে, তখন তাকে তারা অসভ্যতা না বলে আধুনিকতা হিসেবে প্রচার করে থাকে। আর এই আধুনিকতার নগ্ন স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে নারীরাই নিজেদের সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে!!

পাশ্চাত্যে এমনকি ভারতেও আজকাল মেয়েরা কোনো কিছু নিয়ে প্রতিবাদ করতে নগ্ন হয়ে যায়। ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যখন নারী নগ্ন হয়ে করে, তখন নারীর বুদ্ধির দৈন্যতা দেখে করুণা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। পুরুষের ভোগের বস্তু হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে যখন নারী মরিয়া হয়ে ওঠে তখন পেটের দায়ে শরীর বিক্রি করা যৌনকর্মীদের সঙ্গে এদের আর কোনো পার্থক্যই থাকে না।  

কিন্তু প্রশ্ন হলো- নারী স্বাধীনতা, পুরুষের সমান নারীর অধিকার এসবের জন্য মুখের ফেনা তুলে আমরা নারীরা কি এই স্বাধীনতা চাইছি?
 
দুই.
তসলিমা নাসরিন নাকি নারীদের পক্ষে কথা বলেন বলে দাবি করেন। সেই তসলিমা চাইতেন মেয়েরাও পুরুষদের মত নগ্নবক্ষ হয়ে ঘুরুক, রাস্তার পাশে প্রাকৃতিক কর্ম সারুক, যৌন ইচ্ছে জাগলে পুরুষকেও ধর্ষণ করুক!!
4_48
দেহ প্রদর্শন করে কোনো মেয়ে যদি বিজ্ঞাপন করতে চায়, তসলিমা নাসরিন তাতে আপত্তির কিছু দেখেননি। অথচ সানি লিওনের মত পর্নো তারকাকে নিয়ে যখন মুখর ভারতের পত্রপত্রিকা, তখন এই তসলিমাই তার এক টুইটার বার্তায় লিওনকে নারী সমাজের কলংক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তসলিমা নিজেও তার শরীর প্রদর্শনে পুরুষকে প্রলুব্ধ করেছিলেন বলে দাবি করেন। তাহলে পর্নো নায়িকা সানি লিওন ও লেখক তসলিমার মাঝে পার্থক্য কোথায়?
 
তসলিমা তার লেখায় সব নারীকেই যৌন অধিকার সচেতন হতে সোচ্চার হওয়ার পরামর্শ দেন। যার সঙ্গে ভালো লাগে, যেখানে ভালো লাগে সেখানেই যৌনকর্মে লিপ্ত হতেও তিনি নারীদের উত্সাহ দিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হল এর নামই কি নারী স্বাধীনতা? 
 
তিন.
শুরু করেছিলাম আমেরিকান অ্যাপারেলসের মডেল ম্যাকসের নগ্নবক্ষের বিজ্ঞাপন নিয়ে, শেষ করছি আরেকটি বিজ্ঞাপন দিয়ে। দেশের আরেকটি জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকায় ‘লাইফ স্টাইল’ বিভাগে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের ট্যাটু কালচারে উদ্বুদ্ধ করতে ট্যাটুর গুনগান করে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে টপলেস হয়ে সামিনা নাম্নী এক মডেল ট্যাটু অঙ্কিত তার উন্মুক্ত পিঠের ছবি দিয়েছেন। ওপর একটি ছবিতে টপলেস অবস্থায় তার পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন করছেন। সভ্যজাতির ধারক (!!) আমেরিকায় নগ্নবক্ষা নারীর প্রচারিত আমেরিকান অ্যাপারেলসের এই বিজ্ঞাপন আর দেশীয় অনলাইন পত্রিকায় নগ্নপৃষ্ঠে ট্যাটুর বিজ্ঞাপনে আদৌ কি খুব বেশি পার্থক্য আছে? দেশের ভেতরেই আজ মিডিয়াগুলোতে আমাদের তথাকথিত আধুনিক নারীরা তার শরীর নগ্নভাবে প্রদর্শন করে বেড়াচ্ছে!
toslima_bg 
নারী স্বাধীনতা, সমাধিকার কিংবা শিল্পের আড়ালে নারী যে ক্রমেই কর্পোরেট দুনিয়ার ভোগ্যপণ্য তথা বারবণিতায় পরিণত হচ্ছে এই সত্য যেমন নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিন উপলব্ধি করতে পারেন নি, তেমনি এইসব দেহসর্বস্ব স্বেচ্ছাচারী মডেলরাও যে উপলদ্ধি করছেন না তা তো বলাবাহুল্য। কারণ এই উপলদ্ধির জন্য যে ন্যুনতম মেধা দরকার, আফসোস সে সেটুকু মেধাও তাদের নেই!!

নগ্নতা আর যৌনতাই যদি হয় নারী স্বাধীনতা ও সমাধিকারের মাপকাঠি, তাহলে আমাদের নারীদের পুনরায় ভেবে দেখতে হবে আসলেই আমরা কেমন স্বাধীনতা চাই।

 

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।