ঢাকা, সোমবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ জুলাই ২০২৪, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

বঙ্গবন্ধু: জীবনের সেলুলয়েডে

ওয়ালিউর রশীদ তমাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২২ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৪
বঙ্গবন্ধু: জীবনের সেলুলয়েডে

সুসন্তান, দেশপ্রেমিক, উদারমনা মানুষ... এসব পরিচয় ছাপিয়ে তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি একজন অনন্যসাধারণ রাজনীতিক৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালি জাতির পিতা৷ বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা৷৷

১৭ মার্চ – বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন মনে করিয়ে দেয় যে, রাজনীতি মানে যতটা না রাজার নীতি তারও চেয়ে বেশি হচ্ছে মানুষের ও নিজের দেশের জন্য কিছু করার প্রেরণা! হুঙ্কার আর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার বাইরেও যে কিছু আছে দেশ আর মানুষের জন্য করার, তা জীবনের সেলুলয়েডে বন্দী করে গেছেন তিনি৷৷

জীবনের সেলুলয়েড: গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। ১৭ মার্চ, ১৯২০৷ বাবা শেখ লুত্‍ফর রহমান আর মা মোসাম্মত্‍ সায়েরা বেগম৷ পরিবারের প্রথম পুত্রসন্তান তিনি৷ ৪ বোন ও ২ ভাইয়ের মাঝে তৃতীয় এ সন্তানকে আদর করে ডাকা হতো ‘খোকা’৷ পরে ভালো নাম রাখা হয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’৷

হাতেখড়ি: স্কুল জীবনের শুরু ১৯২৭ সালে গমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

তখন তাঁর বয়স ৭ বছর৷ এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে৷

শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা ছিলেন মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার৷ ১০/১১ বছর বয়সে তিনি পুত্রকে নিজের কাছে মাদারীপুরে নিয়ে যান৷ সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় চতুর্থ শ্রেণিতে৷ তারপর গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে৷

অবশ্য ১৯৪২ সালে এ স্কুল থেকেই তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) আইএ ক্লাসে ভর্তি হন৷

এরপর ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন৷

সেই থেকে চশমা: মাদারীপুরে থাকার সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের বেরিবেরি রোগের কারণে চোখে ছানি পড়ে৷ শেখ লুত্‍ফর রহমান ছেলেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত চক্ষু চিকিত্‍সক ডা. টি আহমদের কাছে নিয়ে যান৷ সেখানে সফল অস্ত্রপচারের পর তিনি সুস্থ হলেও ডাক্তারের পরামর্শে তখন থেকেই চশমা পরতে শুরু করেন৷

প্রথম গ্রেফতার: নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন মিশন স্কুলে ছাত্রদের সভা হবে৷ কোনো কারণ ছাড়াই এসডিও ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সভা বন্ধ করে দেন৷ ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে সভা করে৷ শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে দু’একটা কথা বলতেই তাঁকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দু’ঘন্টা আটক করে রাখা হয়৷

ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকেই বাধ্য হয়ে তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়। এটাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের প্রথম গ্রেফতার হওয়া৷

বিয়ে: মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে৷

পরবর্তীকালে এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ২ কন্যাসন্তান জন্ম নেয়৷

প্রথম প্রতিবাদ: ১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে আসেন৷ পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়৷ অকপটে বলে যায়, ছাত্রাবাসের ছাদ চুঁইয়ে পড়া পানিতে বর্ষাকালে ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হবার ভোগান্তির কথা৷ তা মেরামতের দাবি জানায় সে৷ প্রধানমন্ত্রী তত্‍ক্ষণাত্‍ তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১,২০০ টাকা মঞ্জুর করেন এবং ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন৷

সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সত্‍সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন৷ পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে বাংলোতে এনে নানারকম আলাপ-আলোচনা করেন ও প্রীত হন ছেলেটির প্রতি৷ এই ছেলেটিই পরবর্তীকালের অগ্রপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান৷

তিনি সোহরাওয়ার্দীকে ‘রাজনৈতিক গুরু’ বলে স্বীকার করতেন৷ আর শেরেবাংলা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন৷

রাজনীতিতে পা: ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে(বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ)আইএ ক্লাসে ভর্তি হন৷ তখন থেকেই মুসলিম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি৷

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন৷ ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন৷ তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর৷ বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত৷ ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত করে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অসমাপ্ত শিক্ষা: ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে৷ ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ তারপরই তিনি আবার গ্রেফতার হয়ে যান৷ তাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাজীবন আর সমাপ্ত হয় নি৷ ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব৷

ভাষার জন্য অনশন: এ বছরের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে “পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ” গঠিত হলো৷ একজন রাজবন্দি হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন৷ কারাবন্দি থেকেই শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে৷ ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ অক্টোবরে আর্মানিটোলা থেকে এক বিশাল ভুখামিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক আর শেখ মুজিব৷

১৯৫২ সাল৷ তিনি তখনও জেলে৷ ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ তখন উত্তপ্ত৷ ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ঘোষণা করা হলো ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে৷ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করলে গভীর রাতে কিছু ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন৷ শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন৷

২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন৷ কারাগারে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ মাওলানা ভাসানী স্বীয় ক্ষমতাবলে শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলিম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন৷ ১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী বেইজিং নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব৷ ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন৷

আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন: হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু, তাঁর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন৷ দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন৷ মুজিব ছিলেন দক্ষ সংগঠক৷ তিনি ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং অগ্রসর হতে সক্ষম হন৷ সোহরাওয়াদী তখনও রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজের পক্ষে ছিলেন৷ কিন্তু ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিব এনডিএফ ত্যাগের ঘোষণা দেন৷

২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়৷ সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷

৬ দফা: ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন৷ এই প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ৷

সেইসব উত্তাল দিন: ১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ এবছর প্রথম তিন মাসে শেখ মুজিব ৮ বার গ্রেফতার হন৷

এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে৷ ৬ দফা প্রকাশ হওয়ায় বাঙালিদের হৃদয়ে আশার নতুন আলো দেখা দেয়৷ ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়৷ এর পূর্বের ২০ মাসও শেখ মুজিব জেলে আটক ছিলেন৷

১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়৷ সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ মামলার অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন৷একই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন৷

এ সময় ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে৷ পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, কারফিউ, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারায় দেশ অস্থির হয়ে ওঠে৷ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ৷ অবশেষে সরকার ‘প্যারোলে’ মুক্তি নিয়ে শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন৷ অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন৷ মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা৷

‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ: ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়৷ সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন৷

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন৷ এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে৷

১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন৷ পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যে দাবি ভূট্টো করেছিলেন বঙ্গবন্ধু তীব্র সমালোনা করে তা প্রত্যাখ্যান করেন৷ ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত্‍ প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন৷ কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়৷ দেশজুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন৷

৭ মার্চ: আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ৷ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে৷ সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়৷ এই সেই দিন, যেদিন তিনি এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন৷ তাতে ছিল দিক নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা৷

গ্রেফতার: এরই মাঝে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসে আলোচনার জন্য, যা ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে৷ কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে হঠাত্‍ ইয়াহিয়া গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান৷ এদিকে ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করে৷ গণহত্যা চালায়৷ ২৫ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চিফ মারফত খবর পান ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হতে যাচ্ছে৷ সাথে সাথে তিনি দলীয় হাই কমান্ড ও অন্য নেতাদের আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন৷ নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে৷ ২৫ মার্চ রাতের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়৷ প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়৷

মুক্তির সংগ্রাম: বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড গোপনে ভারতে চলে যায়৷ সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়৷ ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথতলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে৷ প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে৷ অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর ৩০ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে৷ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়৷ যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষা৷

ঐ মহামানব আসে: স্বাধীন দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ মার্চ তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন৷ এদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শিরোনাম ছিল “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে৷” দৈনিক পূর্বদেশ- “ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়৷” আবারও রেসকোর্স ময়দানে এসে দাঁড়ান তিনি৷ লাখো মানুষ আনন্দাশ্রু ভেজা চোখে তাদের জাতির জনককে বরণ করে নেয়৷

অস্তিত্বের লড়াই: এবার তিনি হাত দেন দেশগঠনে৷ মন্ত্রীপরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন৷ ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে৷ তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ কিন্তু তাঁকে অত্যন্ত প্রতিকূলতা এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মাঝে কাজ করতে হয়৷

তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি অসংখ্য সমস্যা-সঙ্কুল, সাড়ে ৭ কোটি জনমানুষ অধ্যুষিত দেশের সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে৷ আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খাদ্য উত্‍পাদন বাড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগান এবং আরো নানামুখি সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে৷ স্বাধীনতার পরবর্তী সময়৷ বিপুল অস্ত্র তখনও দেশের সাধারণ মানুষের হাতে রয়ে গেছে৷ তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশজুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য রক্ষী বাহিনী গঠন করেন৷ এ পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়৷ এরই সাথে তাঁর সরকারের মাঝে অবস্থানকারী কতিপয় ক্ষমতালোভী, চাটুকার, স্বার্থলোভীর নির্লজ্জ কর্মতত্‍পরতায়, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে৷ দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়৷ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর দুঃসময়ের অনেক প্রকৃত সাথীর দূরত্ব বেড়ে যায়৷

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন৷ কিন্তু কোনো সুখকর উন্নতি আসার আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বাধীনতা বিরোধীদের তাবেদার এক শ্রেণির উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ও সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য৷ এ সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সেনাবাহিনীর একটি অংশের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কথা অবগত করেন৷ কিন্তু তিনি বলতেন-‘এরা আমার সন্তানের মতো৷’ এভাবে তাঁর স্বভাবসুলভ উদারতা তাঁর বিপদ ডেকে আনে৷

সেই কালো রাত: ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল৷ রাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী কর্মকর্তা ও সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা চরম নৃশংস পন্থায়  তাঁর পুত্র, পুত্রবধু, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজনসহ ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে৷

পরদিন তাঁর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া নেওয়া হয় এবং তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়৷

কথিত যে, তাঁরই মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ মদদে এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়৷

ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্মিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ বাঙালি জাতি চিত্‍কার করে কাঁদার পরিবর্তে স্তম্ভিত- দিশেহারা হয়ে যায়৷ দেশের স্বাধীনতার জনক তাঁর বুলেটে ঝাঁঝরা বুক নিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন যে এই মাটিতেই৷ এ লজ্জা, শোকের কোনো তুলনা নেই।

আজও আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ দীর্ঘ দেহ, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট, পেছনে আঁচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ৷ শুধু সে পাইপ থেকে এড়িনমোরর’স তামাকের সুবাস আর বের হয় না৷

বাংলাদেশ সময়: ০২২১ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।