ঢাকা, সোমবার, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ জুলাই ২০২৪, ২৩ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

মিলেই গরমিল!

পলাশ মাহবুব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৪
মিলেই গরমিল!

একটি টেলিভিশন চ্যানেলের একজন প্রযোজক ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন দিন কয় আগে। নাম পলাশ রায়।

সকাল বেলা। সকাল মানে নাগরিক সকাল। একেবারে আটটা।

তিনি অফিসের নাইট ডিউটি সেরে ফিরছিলেন কিংবা যাচ্ছিলেন অফিসের পথে, মনিং শিফট ধরতে। কানে ছিল হেডফোন। হয়তো সেখানে বাজছিলো ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও...’ কিংবা হালের কোনও হিট সং। অথবা রবীন্দ্রনাথ-নজরুলও বেজে থাকতে পারে।

পলাশ পার হচ্ছিলেন রেল লাইন ক্রসিং। সে পথে তখন আসছিলো কিংবা যাচ্ছিল একটি ট্রেন।

ট্রেনের চালক হুইসেল দিয়েছেন কি দেননি কিংবা কানে গানের মূর্ছনা থাকায় ট্রেনের হুঁইসেল শুনেছেন কি শোনেননি, সে আলোচনায় যাওয়ার দরকার নেই। কারণ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।

নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়বে- তা নিয়ে হয়তো প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ট্রেন একবার ছেড়ে দিলে তা হুট করে থামানোর সুযোগ নেই। ট্রেন থামেনি। থামতে ভুলে গিয়েছিলেন পলাশ রায়।

‘দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ধায়’ এই প্রবাদ হাজার বছরের। তখন কোনো সংবাদমাধ্যমই ছিলো না। ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটারতো দূরের কথা।

এযুগে অন্য পাঁচটি খবরে যা হয়, এই সংবাদ যেনো তারও আগে ছড়িয়ে পড়ল।

পলাশ, আরটিভি, প্রোডিউসার, সকাল, কুড়িল বিশ্বরোড, ট্রেনে কাটা পড়েছে। স্পট ডেড। ঢাকা মেডিকেল। মর্গ।

বাতাসে ওড়া সংবাদে পুরো খবর থাকে না, সাংবাদিকতা পড়তে গিয়ে সে কথা শিক্ষকদের শেখানো কঠিন থিওরিগুলোর মধ্যেও ছিলো। বলা হয়- যে খবর পাতলা সেটাই বাতাসে ওড়ে।

স্বাভাবিকভাবেই এই উড়ো খবরে পুরো খবর থাকে না।

উড়ো খবর অনেকটা যেমন খুশি তেমন সাজোর মতো। নিজের মতো করে সাজিয়ে নেয়া যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত না আসল খবর প্রকাশিত হয়।

আমিও এক সময় আরটিভিতে কাজ করেছি। কর্মসূত্রে ওই একই পেশা প্রযোজক।
ফলে গুজবের দুইয়ে দুইয়ে চার খুব সহজে মিলে যায়।

পরিচিতজন যারা টেলিভিশন কিংবা অনলাইনের কাছাকাছি ছিলেন না গুজবে তারাই বেশি আক্রান্ত হন।

নাম, পেশায় পুরোপুরি মিল আর সাবেক কর্মস্থল হওয়ায় ঘনিষ্টজনরা আমাকে নিয়ে আতঙ্কিত হন।

শুরু হয় একের পর এক ফোন আসা।
আমরা যার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েছি কিংবা যাকে ইতিমধ্যেই মৃত হিসেবে ধরে নিয়েছি তিনি নিজেই যদি ফোন রিসিভ করেন তখন কি বলতে হয় সেটা আমাদের জানা নেই!

সুতরাং প্রথম কথাই হয়- তুমি কেমন আছো?

আমি জানি যারা ফোন দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই অতিমাত্রার ব্যস্ত মানুষ। মোবাইল ফোনে ‘তুমি কেমন আছো?’ টাইপ নরম আলাপ করার মানুষ না। কিংবা ‘তুমি কেমন আছো?’ জানার জন্য এত সকালে কেউ কারো ঘুমও ভাঙান না।

খটকা লাগে।
খটকা খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্কাউটিংয়ের গেঁরোতে পরিণত হয়।

জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে ফোনকল।

একটা দুটো কলে জট খোলে-

তুমি বাসায়!
কি শুনলাম তাইলে!
ঠিকাছো তো?

ঘুম ভাঙা চোখে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করি।
হাত-পা নেড়েচেড়ে দেখি।
ঠিকাছি তো।
ওহ। গড। তাইলে তুমি না।
আমি না মানে!

অবাক হই। পরে যখন আসল কাহিনী যখন জানতে পারি তখন আমার নিজেরই ওহ, গড বলার পালা।
নামের মিলের কারণে অতীতেও কিছু বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
তবে সেগুলো ছিল নিছক বিড়ম্বনাই। কিছুদিন পরে যা হয়তো হাসির খোড়াক জুগিয়েছে।
বর্তমান কর্মস্থলেও আমরা একই ডাকনামের দু’জন আছি।
এ নিয়ে প্রায়শই নানা কা- ঘটে।

বস, একজনকে ডাকলে অফিস অ্যাটেন্ডেন্ট হয়তো আরেকজনকে খবর দেন। একজনের ঝারি অন্যজন খেয়েছি এমনটাও হয়েছে।
আবার আমার সেই সহকর্মীর বিয়ে যখন ঠিকঠাক তখন একদিন পাত্রী পক্ষের লোকজন আসলেন গোপন তল্লাশির মুখেও পড়েছি। জেরার মুখে আমি নাজেহাল হয়েছি। তথ্যে বড় ধরণের বিভ্রাট পাওয়ায় ভীষণ গোস্বাও হয়েছিলেন পাত্রীপক্ষ।

সে আলাপও আজকের নয়। নামের মিলের কারণে অনেকের কাছে মৃত মানুষ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
প্রচ- গরমেও মৃত্যুর শীতল একটা ঝাপটা অনুভব করি, পুরোপুরি না হলেও কিছুটা।

মৃত্যু বিষয়টাকে আমরা ভুলে থাকতে চাই। হয়তো নিশ্চিত নিয়তি বলেই।

কিন্তু যা চাই তা কি সবসময় হয়?

এই যে, নামের মিল হঠাৎ যেন জীবনে একটা গরমিল টেনে দিয়ে গেলো।

পলাশ রায়, তাজা-তরুণ যুবক। হেডফোনে গান শুনতে শুনতে, পরিপাটি সেজে, অফিসে যাচ্ছে কিংবা বের হয়েছে। রেলে কাটা পড়ে ঝড়ে গেলো তাজা তরুণ প্রাণটি সেটিও কি কম গরমিল!

পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার।
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।