বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক রয়েছে। এটা পার্টিজান রাজনীতির কারণে থাকবে হয়তো অনাদিকাল।
তবে সাদা চোখে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তবে মেজর জিয়াউর রহমান অবিসংবাদিতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না। এটা ইতিহাসের সাক্ষ্য, অস্বীকারের উপায় নেই।
মেজর জিয়া ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এর আগের দিন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৫ মার্চ কালরাতে গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহূর্তে ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। আরোপিত কোনো কিছুর অবকাশ এখানে নেই। তার আগে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের মহাসমুদ্রে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম বা আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি... এ ধরনের ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশের ইতিহাস বলে জীবদ্দশায় মেজর জিয়াউর রহমান কখনোই নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের শেষের দিকে যখন বাকশাল প্রতিষ্টিত হয় তখন মেজর জিয়াও তাতে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তখন তার মধ্যে প্রকাশ্য রাজনৈতিক অভীপ্সা ছিল না বলে নিজেকে তিনি সেভাবে উল্লেখের দাবিযোগ্য কেউ ভাবেননি।
বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে তার ‘জড়িয়ে’ যাওয়ার কাহিনী আছে ইতিহাসবেত্তাদের লিখনীতে। কিন্তু প্রকাশ্য স্বাধীনতার ঘোষক এমন দাবি করার মতো নৈতিক শক্তি তার ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রথম পাঠ যোগ করেন জিয়াউর রহমান। তার হাত ধরে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করার অধিকার লাভ করে। তার শাসনামলে ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে তিনি অগুণতি মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেন। আদতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সমান্তরালে পাকিস্তানি ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠার অগ্রপথিক ছিলেন মেজর জিয়া। শাসক জিয়া যখন মুক্তিযোদ্ধা হন্তারকের ভূমিকায়, তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি রাজনীতিবিদদের আত্মপ্রকাশের পালা শুরু হয়। যার মূলভাগে ছিল একাত্তরের ঘাতক রাজাকারদের মন্ত্রীত্ব ও সরকারি সুবিধাদি। এই সুবিধাবাদী চরিত্রগুলোর হাত ধরে এক সময়ে জিয়াউর রহমান হয়ে যান স্বাধীনতার ঘোষক।
তবে মজার বিষয় হচ্ছে, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া যেদিন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন সেই ২৭ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য কোনো দিন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ নেমে পড়ে সম্মুখ সমর আর প্রতিরোধে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে দাবি করে। এই দাবি পুরোপুরি রাজনৈতিক তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জিয়াউর রহমান ছিলেন জেড ফোর্সের প্রধান। এই ফোর্স গঠন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তিন মাস তিনি এই ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। একাত্তরের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অন্য অনেকের মতো জিয়াও স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন- এটা মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান। তার আগের দীর্ঘ ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রামে জিয়াউর রহমানের কোনো অবদান ছিল এমন কোনো ইতিহাস কোথাও লেখা নেই। কেউ কখনো দাবিও করেনি। সে রকম কোনো কিছুর সন্ধানও পাওয়া যায়নি। যদি মাত্র নয় মাসকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আখ্যান বলে কেউ দাবি করে, তখন তা হয়ে যায় ইতিহাসের খণ্ডিত পাঠ। খণ্ডিত পাঠ ইতিহাস হতে পারে না; হতে পারে ভুলে ভরা এক আখ্যান!
জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক এমন দাবি বিএনপির বহু পুরনো রাজনৈতিক কৌশল। যখন বিএনপি লৌকিকতা হলেও দলগতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অনুশীলন করার চেষ্টা করতো তখন তারা এই কৌশলকে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় প্রয়োগের চেষ্টা চালাতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে অতি জামায়াতিকরণের ফলে দলটি ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্নভাবে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করছে। সর্বশেষ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে দেশের অনেক জায়গার মত সিলেটে তারা স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করেনি বলে মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। এটা তাদের বর্তমান রাজনৈতিক বিশ্বাস আর দেউলিয়াত্বের প্রকাশ কিনা তা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে প্রমাণ হবে। তবে সোজা কথায় বলা যায়, এটা নিন্দাজনক। একই সঙ্গে তা হতাশাজনকও বটে।
স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিএনপির কৌশল কিংবা মিথ্যাচারের সঙ্গে বর্তমানে যোগ হয়েছে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করার মতো ধৃষ্টতা ও মিথ্যাচার। এই মিথ্যাচারের শুরুটা করেছেন তারেক রহমান। যিনি আবার জিয়াউর রহমানের পুত্র। লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমান স্বাধীনতা দিবসের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবির পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেও দাবি করেন। তারেক রহমানের এই দাবি উপস্থিত বিএনপি কর্মীদের ব্যাপক করতালির মাধ্যমে গৃহিত হলেও তা যে আদতে মিথ্যাচারের নগ্ন প্রকাশ বলার অপেক্ষা রাখে না। একটি দলের সম্ভাব্য ভবিষ্যত নেতৃত্ব কতখানি নির্লজ্জ হলে এমন ঢাহা মিথ্যা কথা বলতে পারেন তা আমাদের বোধের অতীত।
তারেক রহমানের এই দাবি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকে এটাকে বেফাঁস মন্তব্য বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও দলীয় অবস্থান বিবেচনা করলে তার আরো বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল বলে অভিমত প্রকাশ করেন।
তবে মনে রাখা দরকার, ইনডোর অনুষ্ঠানগুলোতে খুব বেশি বেফাঁস মন্তব্যের সুযোগ থাকে না যতটা থাকে মাঠে-ময়দানের মেঠো বক্তৃতায়। তারেক রহমানের এই প্রথম রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত দাবি কি তবে ধৃষ্টতা, না অজ্ঞতা সেটা বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের ধারাবাহিক কার্যভার গ্রহণ ও কার্যকালের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃতি দিয়েছে সেহেতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম বৈধ রাষ্ট্রপতি।
যেহেতু ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিন বলে স্বীকৃতি দিয়েছে আমাদের সংবিধান সেহেতু মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারই সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের বৈধ সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের এপ্রিল ১২ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। এরপর মোহাম্মদউল্লাহ (১৯৭৩ এর ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ এর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত), বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ (১৫ আগস্ট ১৯৭৫-৬ নভেম্বর ১৯৭৫), আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম (৬ নভেম্বর ১৯৭৫-২১ এপ্রিল ১৯৭৭)। তারপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর নিজেকে রাষ্ট্রপতি বলে ঘোষণা করেন ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে। তিনি ১৯৮১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের কার্যকালের দিকে চোখ রাখলে দেখা যায়, জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি। তিনি কোনক্রমেই বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন না।
জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে তারেক রহমান দাবি জানানোর একদিন পর এ বছরের ২৭ মার্চ খালেদা জিয়াও একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। তিনিও জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করলেন। এটা দুঃখজনক যে খালেদা জিয়ার মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তারেক রহমানের মতো সম্ভাব্য বিএনপি দলীয় সর্বোচ্চ নেতা প্রকাশ্যে নীতিজ্ঞান, রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে মিথ্যাচারের মাধ্যমে অদ্ভুত দাবি করলেন। খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানের এই মিথ্যাচারকে অনেকেই তাদের রাজনৈতিক খেলা বলে মনে করলেও আদতে তা নয়। এটা একান্তই বিশ্বাস ও চেতনা সম্পর্কিত। দেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতিকে প্রথম রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা তাদের আগের সাতজনকে পরিষ্কার অস্বীকার। যা সংবিধান অস্বীকারের পর্যায়েও পড়ে।
খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো যারা বিশ্বাস করতে চায় জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, তারা বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামকে অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্তর্বতীকালীন সরকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সব সরকারকে অস্বীকার করে। এটা ইতিহাস বিকৃতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকারের নামান্তর।
তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া দু’জনই জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করে কি ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মক্ষণ হিসাব করছেন? তাদের এই হিসাব বাংলাদেশ জন্মের ধারাবাহিক সংগ্রাম আর প্রক্রিয়াকে অস্বীকারের মতো ধৃষ্টতাস্বরূপ। আমি নিশ্চিত না, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই ধৃষ্টতা, মিথ্যাচার আর ইতিহাস বিকৃতির জবাব চাইবে কিনা?
মানসিকভাবে ভারসাম্যহীনদের অনেককেই দেখেছি নিজেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অনেক কিছুই দাবি করে। আমাদের যদ্দূর ধারণা, বিএনপির প্রভাবশালী এই দুই নেতার কেউই মানসিকভাবে অসুস্থ নন। আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, তবে তাদের এসব ঘোষণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তাতে সন্দেহ নেই। তাই প্রশ্ন জাগে- তারা কি জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের দিনকেই বাংলাদেশের বিজয়ের দিন অথবা দেশের ইতিহাসের প্রথম দিন গণনা করছেন?
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বাসের দিক থেকে বাংলাদেশ জন্মের দিনগুলোকে সরাসরি অস্বীকারকারীরা কেউ কোনোদিনও জবাবদিহি করবে না!
তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার মিথ্যাচার ভিত্তিক দাবির বিপরীতে জীবনানন্দের ভাষায় একটা কথাই কেবল বলা যায়- ‘‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’!
হ্যাঁ, আমার চারপাশে অদ্ভুত আঁধার ধেয়ে আসছে, আমরা ক্রমে সে আঁধারে নিপতিত হচ্ছি। সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনীতিবিদরা যখন এমন মিথ্যাচারের ধারক-বাহক-প্রচারক তখন কেউ কি জানে সত্যিকার অর্থে আমাদের গন্তব্যটা কোথায়?
লেখকের মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫১ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০১৪