ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদ হত্যায় দায়ী কে

ড. কে এইচ এম নাজমুল হুসাইন নাজির, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১৪
সাদ হত্যায় দায়ী কে সাদ ইবনে মোমতাজ

ঢাকা: মা-বাবা তাদের আদরের সন্তানকে বিশ্বমানের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান। পরম মমতায় মা ডালের বড়ি তৈরি করে রোদে শুকিয়ে রাখেন।

গাছের সজনে বা কুমড়ো ফুল ও লতা সন্তানকে খাওয়ানোর আশায় বসে থাকেন। বিন্নি ধানের খই ভেজে বা নারকেলের চিড়ে কুটে রাখেন। আপশোস করেন সন্তানের ছুটি না থাকার কারণে। শত দুঃসময়েও সময়মত টাকা পাঠান বাবা।

জমি বিক্রি করেও সন্তানকে টাকা পাঠাতে শোনা যায়। সন্তানকে জানতেও দেন না। এই ভেবে যে জানলে সন্তান বেশি চিন্তা করবে। পরিণামে পড়াশোনার ক্ষতি হবে। আদরের সন্তানটি একদিন মানুষের মত মানুষ হয়ে পরিবারের সব দুঃখ ঘোঁচাবে। গর্বে ভরে উঠবে মা-বাবার বুক। অজান্তে একফোঁটা আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়বে প্রতিষ্ঠিত সন্তানকে দেখে।

এমন সুখের কান্না সব মা-বাবা কাঁদতে চান বলে সবার মত আমারও বিশ্বাস। সদ্য ঝরে যাওয়া বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র সাদের জন্য তার মা-বাবাও অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলেন। আনন্দাশ্রুর পরিবর্তে আজীবন বোবা কান্নার পাহাড় ঘিরে ধরবে সাদের গোটা পরিবারকে এমনটা কারোরই জানা ছিল না।

ঘটনাটির জন্য কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত 'মাগো- ওরা বলে' কবিতার কথা মনে পড়লো। ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দেওয়া সন্তানকে হারিয়ে মায়ের শান্ত্বনা ছিল- বাংলা ভাষা রক্ষা হয়েছে। কিন্তু সাদের মা কি দিয়ে মনকে শান্ত্বনা দেবেন?

বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি রক্ষা পেয়েছে! একটি রাজনৈতিক দলের কিছু কর্মীর স্বার্থ রক্ষা পেয়েছে! নাকি তাঁর সন্তানের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান নোংরা ছাত্র রাজজনীতির অবসান হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্তানকে পাঠিয়ে মা-বাবা ভাবেন সেখানে মা-বাবা তুল্য প্রফেসররা রয়েছেন। যারা তাঁদের সন্তানকে দেখাশোনা করবেন। তাদের সন্তান মানুষের মত মানুষ হয়ে ফিরে এলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি গোটা পরিবার, সমাজের মানুষের শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একাংশের একটি মৌন মিছিল দেখে মনে হলো- শিক্ষকরা কতটা অসহায়। তাঁদের মুখের ভাষা রহিত হয়েছে। বাস্তবতা আমার মনে হয় সে রকমই। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করলে আমিও হয়ত সেই মিছিলে সামিল থাকতাম। রাজনৈতিকহীন স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে, নোংরা রাজনীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় বা বিবেককে বিসর্জন দেওয়ার জন্য ছাত্র-সংশ্লিষ্ট বিষয়েও শিক্ষকদের মৌন মিছিল করতে হচ্ছে। এ লজ্জার দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই বেশি। আমরা ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে চালিত করতে ব্যর্থ হয়েছি। সঠিক শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের সুশিক্ষা প্রদানের নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মান কমে যাচ্ছে বলে আমরা চীৎকার করছি। অথচ নিজেদের মডেল হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছি।

উপরন্তু, ছাত্রছাত্রীদের অনৈতিক কাজকে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সমর্থন করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ ভালো রাখার দোহিই দিয়ে কিছু ছাত্রকে ক্যাম্পাসের বাইরে রাখছি। তাদেরকে শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি। ব্যক্তিগত হীন স্বার্থ উদ্ধারে ছাত্রদের ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছি না। ছাত্ররাজনীতির নামে ছাত্রনেতাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দেখে না দেখার ভান করছি। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের রক্ষা করতে বা তাদেরকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছি। নির্মম এ সত্যের পরিণামে যা হবার তাই হচ্ছে। ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। একের পর এক ঘটছে খুনের মত অমার্জনীয় অপরাধ। আশ্চর্যের বিষয়, এমন গর্হিত কাজেরও হচ্ছে না কোন বিচার। কমিটি গঠন, রিপোর্ট প্রদান বা লোক দেখানোর নামেমাত্র সাজা প্রদানের  মধ্যেই থাকছে সীমাবদ্ধ। যে কারণে অপরাধী দ্বিগুণ উৎসাহে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার অপরাধ করেই চলেছে। সাদ হত্যাকাণ্ড এ ঘটনা প্রবাহের একটি অনাকাঙ্খিত ফলাফল মাত্র।

ছাত্রছাত্রীদের গঠনমূলক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থনযোগ্য। তাই বলে তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। পিটিয়ে ছাত্র হত্যার মত জঘন্য অপরাধেরও যদি কোন সঠিক বিচার না হয় তাহলে আমাদের এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থকাতে হবে। একটা বিষয় পরিষ্কার যে, ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যলয়ে নিয়ম-বহির্ভূত কিছুই করতে পারবে না যদি শিক্ষক হিসেবে আমরা মন থেকে চাই।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা, প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাসহ পাঁচ সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে শিক্ষক সমিতির জরুরি সমাবেশে। বিষয়টা আশাব্যঞ্জক। সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার স্বার্থে শিক্ষক সমিতি গৃহীত সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে- এ আশায় থাকবে। সাদের মায়ের মত আর কোন মাকে যেন মৃত সন্তানকে পাওয়ার জন্য প্রহর গুণতে না হয়।

ড. কে এইচ এম নাজমুল হুসাইন নাজির: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ ও গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া।


বাংলাদেশ সময়: ১৯১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।