ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পুরুষালি বাঁধ ও তিস্তার অকাল গর্ভপাত

পাভেল পার্থ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০৪ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৪
পুরুষালি বাঁধ ও তিস্তার অকাল গর্ভপাত

পর্ব এক

তিস্তাপাড়ের এক আদি গ্রাম কিসামত চীনাতলী। বাংলাদেশের লালমনিরহাটের এ গ্রামে তিস্তার স্পর্শেই জন্ম নলিন চন্দ্র বর্মণের।

১৯৭৪ সালে প্রথম তাদের গ্রাম তলিয়ে যায় তিস্তায়। তারপর ১৯৭৫ সনে দ্বিতীয়বার। এভাবে ২০০৮ সনে বসতবাটি সব যায় ১১ বারের মতো তিস্তায়। তিস্তাপাড়ের প্রবীণজনের ভাষ্য, ‘‘তিস্তা চড়া নদী, পানি কম স্রোত বেশি। তাই ভাঙে। আগে নদী খাড়া গভীর ছিল, যতই পানি আসত স্রোত তলাইয়া যেত। এখন স্রোত উজাইয়া আসে। আগে এমন ছিল না, দিনে দিনে এই ভাঙন বাড়তেছে। নদীর এইদিক বান্ধলে, আরেকদিক ভাঙবেই। নদীর তো একটা জান আছে, শত বান্ধন দিয়া তারে আটকানো যায় না। এ বিধি নদীর বিধি নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড যখন তিস্তা নদীতে ভাঙন ঠেকানোর জন্য ৩নং স্পার তৈরি করে সেটি তৈরির সময় ব্রীজের তলায় যে পরিমাণ পাথর ফেলার কথা সে পরিমাণ পাথর ফেলা হয়নি। তাই এ ব্রীজ এখন তিস্তার দুর্মর স্রোত আটকাতে পারছে না’’ । পাশাপাশি বাংলাদেশে তিস্তার ভাঙনের ফলে বিলীন হচ্ছে গ্রাম। নিরুদ্দেশ হচ্ছে জীবন। জেগে ওঠছে নয়া চর। আর এ চর নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী বাঙালি মুসলিম পুরুষেরা তিস্তাবাসী নিম্নবর্গের উপর বারবার হামলে পড়ছেন। তিস্তা ভাঙনে উদ্বাস্তু স্থানীয় মানুষদের উচ্ছেদ করে তারা লুটে নিচ্ছেন তিস্তার নয়া চর, তৈরি হচ্ছে সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কের এক নয়া মেরুকরণ


বাংলাদেশ জুড়ে যখন তিস্তার পানির আকাল নিয়ে দরবার চলছে, রাজপথ জুড়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো পর্যন্ত যখন তিস্তার এক ফোঁটা পানির জন্য তোলপাড়। তখন চলতি আলাপটি শুরু হয়েছে তিস্তার প্রবল জলস্রোতের ধাক্কাকে স্মরণ করিয়ে। ঘোর বর্ষায় তিস্তার বন্যা ও ভাঙনের ঘটনাকে সামনে টেনে। জলহীন মুমূর্ষু তিস্তার প্রবল স্রোতস্বী উন্মাতাল হওয়া এও এক গগণবিদারী রূপ। আজকে যারা তিস্তার মতো অভিন্ন জলপ্রবাহ নিয়ে কথা বলছেন বা বলতে চাইছেন, তাদেরকে অবশ্যই তাঁর প্রতিবেশ রাজনৈতিক অবস্থানটি স্পষ্ট করে নেয়া জরুরি কারণ প্রতিবেশ একটি রাজনৈতিক দরবার। অভিন্ন নদীর ন্যায্য হিস্যা উজান থেকে ভাটি অবধি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। যেহেতু দুঃখজনকভাবে দেশজুড়ে বিস্তৃত বিকশিত নদীগুলোকে দুম করে রাষ্ট্রের টুকরো টুকরো সীমানায় বন্দী করে ফেলা হয়েছে। চলতি আলাপটি তিস্তা নদী বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নকে পুরুষালি বলপ্রয়োগ হিসেবে পাঠ করছে। তিস্তার উজান থেকে ভাটির চলতি এ করুণ পরিস্থিতিকে চলতি আলাপ ‘অকাল গর্ভপাত’ হিসেবে দেখছে। অধিপতি লিঙ্গ যেমন লিঙ্গীয় নিম্নবর্গের উপর অনিবার্য জখম ও জালিয়াতি জিইয়ে রাখে, তেমনি বহুজাতিক করপোরেট পুরুষালি উন্নয়ন বলপ্রয়োগ তিস্তার অভিন্ন ধারাকে কেটে ছেনে ফালি ফালি টুকরো টুকরো করে উজান ও ভাটি মিথ্যা বানোয়াট রাজনৈতিক-উন্মাদনা জারি রেখেছে। ভারত ও বাংলাদেশ এবং এ দুই রাষ্ট্রের প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের সকল এজেন্সি সকলে মিলেই তিস্তার নদীর করুণ অকাল গর্ভপাত ঘটিয়েছে। তারা টেনে খুবলে তিস্তার গর্ভফুল পিষে ফেলেছে। যাতে তিস্তা আর কখনো কোনো জলধারা গর্ভে ধারণ না করতে পারে, যাতে তিস্তা থেকে আর কোনো প্রবাহ জন্ম না নেয়। তিস্তা নদী নিয়ে তথাকথিত মূলধারার আলাপচারিতাগুলো কখনোই নিম্নবর্গের প্রতিবেশ দর্শনের জায়গা থেকে আলোচিত হয় না।


অধিকাংশ সময়েই তা কিছু মুখস্থ পরিসংখ্যান, অবকাঠামো নির্মাণের দরপত্র-গুন্ডামি, পানির পরিমাপ, সন-তারিখ আর রাজনৈতিক দল, কে হিন্দু কে মুসলিম কার কে কত পছন্দ কে কতখানি জল ছাড়ল এসব নিয়ে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে এসব আলাপকারীদের অধিকাংশই তিস্তাবিচ্ছিন্ন প্রতিবেশ-নিরক্ষর ধবধবা ফিটফাট সাহেব পুরুষ। চলতি আলাপখানি তিস্তা নিয়ে সকল ফিটফাটগিরি প্রশ্ন করার মানত করেছে। এটি জরুরি। তিস্তাপাতের নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের জটিল নদীসম্পর্কের ভেতর থেকেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তিস্তার অভিন্ন জলপ্রবাহের মুক্তি মিলুক।   tista_1
তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত
ভারত থেকে বাংলাদেশ জুড়ে তিস্তা কেবল জলপ্রবাহ নয়, জড়িয়ে আছে মানুষসহ প্রাণের স্মৃতিপ্রবাহে। তিস্তা অববাহিকার আদি বসতিস্থাপনকারীদের ভেতর তিস্তা নামটি হরহামেশাই দেখা যায়। রাজবংশীদের ভেতর তিস্তামণি বর্মণ। এমনকি তা আরো জলপ্রবাহ ডিঙিয়ে হাজংদের নামের সঙ্গেও একাত্ম হয়েছে। নেত্রকোণার সীমান্তে সংগঠিত ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের এক লড়াকু দ্রোহীর নাম তিস্তামণি হাজং। বাংলাদেশের ২৩০টি নদ-নদীর ভেতর ৫৭টি প্রধান নদ-নদীর উৎস সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চল। বাংলাদেশের নদীপ্রণালী এক জটিল জলসার্কিট তৈরি করেছে যা দুনিয়ার অন্য কোনো নদীপ্রণালী দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মত এই ব-দ্বীপ ভূমির নদী অববাহিকার জলধারার উৎস উজানের উত্তর-পূর্বের হিমালয়-মেঘালয় পাহাড় ভূমি যা ক্রমান্বয়ে দেশব্যাপী বহুমাত্রিক জলসার্কিট তৈরি করে ভাটিতে দক্ষিণপ্রান্তে বঙ্গোপসাগরে মিলেছে। প্রতিদিন বাংলাদেশের নানান জলপ্রবাহ থেকে প্রায় ৩০০০ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশে। এই ৩০০০ মিলিয়ন ঘনমিটার জলপ্রবাহে অভিন্ন নদী তিস্তার অংশগ্রহণ গুরুত্ববহ। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বাংলাদেশের নদ-নদী সমূহের হাইড্রোলজিক্যাল প্রতিবেশ অঞ্চলকে মোট ১৭টি হাইড্রোলজিক্যাল রিজিয়নে ভাগ করেছে। তিস্তার পানিবন্টন বিষয়ক একটি লেখায় মো. নূরুল ইসলাম ও অন্যান্যরা জানিয়েছেন, তিস্তা হলো বাংলাদেশের প্রধান আন্তঃরাষ্ট্রিক নদীসমূহর ভেতর চতুর্থতম। তিস্তা হলো করতোয়া-আত্রাই-যমুনেশ্বরীর প্রধান জলপ্রবাহ। বাংলাদেশে প্রবাহিত তিস্তার মোট অববাহিকা ২০৭১ বর্গ কি.মি., যা সমগ্র তিস্তার ১৭ ভাগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০০১ সনের সমীক্ষা অনুযায়ী তিস্তাপ্লাবন সমভূমি কৃষিপ্রতিবেশ দেশের মোট কৃষিভূমির ১৪ ভাগ এবং তিস্তা অববাহিকায় দেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৫ ভাগ মানুষ দিনযাপন করে।


১৯৯০ সনে অকাদেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত দেবেশ রায়ের ‘তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসের একশ চুরানব্বই অধ্যায়ের নাম ‘তিস্তা ব্যারেজ কী করে হল’। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প নিয়ে দেবেশ রায় লিখেছেন, ... তিস্তা ব্যারেজের পরিকল্পনা কী, কবে থেকে তার কাজ শুরু হয়েছে, কাজ শুরুর আগে কী গোলমাল হয়েছে, রাজ্যের কোন সরকার আর কেন্দ্রের কোন সরকার কী করেছে-সেসব ত সাতকাহন কথা। তিস্তার জল কোথাও আটকে সেখান থেকে জলবিদ্যুৎ বানানো যায় কিনা-এ নিয়ে নানারকম কথাবার্তা নানা সময়েই হয়েছে। কিন্তু জলঢাকা বিদ্যুৎ প্রকল্পের হালের পর কারো ঘাড়ে আর দুটো মাথা ছিল না যে উত্তরবঙ্গের এই সব পাহাড়ি নদী নিয়ে কোনো কথা জোর দিয়ে বলে। জলঢাকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপর্যয়ের পর কারো গর্দানই কাটা যায়নি। সরকারি কোনো প্রকল্পেই কোনো একজনকে দায়ী করা যায় না। জলঢাকায় সব হিশেসবই ঠিক ছিল-জল বছরে কোন কোন সময় কত পরিমাণ আছে, জলের বেগ কত থাকে, সেই বেগের আঘাতে টারবাইন কত জোরে ঘুরতে পারে, কতটা শক্তি তৈরি হতে পারে-এসব হিশেবের কোনো জায়গায় কোনো ভুল ছিল না। পৃথিবীর সব জায়গায় যে অংক মিলিয়ে বিখ্যাত বিখ্যাত সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হয়েছে, জলঢাকাতেও সেই অংক ছিল নির্ভুল। কিন্তু পৃথিবীর বিখ্যাত বিখ্যাত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংককষা বইগুলিতে শুধু ছিল না এখানকার পাহাড়ের বৈশিষ্ট্যের ‘লোকাল ফ্যাক্টর’। তাই সেই স্থানিক উপাদান অংকের হিশেবে ধরা হয়নি। এখানকার পাহাড়ে পাথরের চাইতে মাটি অনেক বেশি। জল যখন পাহাড় বেয়ে নীচে নামে, স্বাভাবিক খাতে বা ঢলে, তখন জলের সঙ্গে সঙ্গে নামে পাহাড়ের মাটিও। পাহাড় থেকে মাটি অত খসে যায় বলেই এদিকের পাহাড়ে এত ধস নামে। আর সেই মাটি, জল গোলা মাটি টারবাইনের ঘূর্ণন যে থামিয়ে দিতে পারে, তা জানা গেল যখন টারবাইন থেমে গেল তখনই। জলঢাকার এই অভিজ্ঞতার ফলে উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি নদী সম্পর্কে সবাই একটু অনিশ্চিত হয়ে যায়। এরা ঠিক চেনা নদী নয়। এদের স্ভাবও সবসময় বইপড়া নদীবিজ্ঞানের সঙ্গে মেলে না। এইসব নদীর ধর্ম পাকাপাকি যতদিন জানা না যায়, ততদিন নদীগুলো নদীর মতই থাকুক, নদীর গায়ে হাত দেয়ার দরকার নেই। ১৯৬৮ সালে তিস্তার বড় বন্যার পর, ৬৯ সালের দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় তিস্তাপ্রকল্প কথাটা প্রথম খবরের কাগজের পাতায় আসে। তিস্তা-মহানন্দা মাস্টার প্ল্যানটিও সেই সময়ের। ১৯৭৭ সনে ভোটে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার হল। তিস্তা ব্যারেজের জন্য স্পেশাল সেটেলমেন্টর জরিপ কাজ শুরু হল তখনি। তিস্তা-মহানন্দা মাস্টর প্ল্যানের একটা পর্যায় হিসেবে তিস্তা ব্যারেজের কাজটা কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই হতে লাগলো। গাজোলডোবা গ্রাম হয়ে উঠল প্রধান কর্মকেন্দ্র। দেখতে দেখতে এপারে গাজোলডোবা আর ওপারে বৈকুন্ঠপুর ফরেস্টের মাঝখানে চওড়াচওড়ি তিস্তার মাঝখান দিয়ে ব্যারেজ তৈরি শুরু হয়ে যায়। স্লইস গেট, রিজার্ভারসহ তিস্তা ব্যারেজ। ব্যারেজের কাজ শেষ না হতেই উদ্বোধন হয়। চোখের সামেন দেখা যাচ্ছে, নীচে তিস্তার জলকে এক জায়গায় আটকে, তিস্তাকে একটা মূলখাতে বইয়ে দেয়ার কাজ চলছে, কাজ এগুচ্ছে। সেদিকে আঙুল দেখিয়ে বলা যায়, ঐ দেখো তিস্তা ব্যারেজের কাজ চলছে, তিস্তা ত পাহাড়ের নদী, কালিম্পঙের নদী, আমাদের নদী, কিন্তু এই যে আমাদের নদী সে যতক্ষণ পাহাড়ের নভেতর বয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ তার দিকে রাজ্য সরকারের নজর নেই, এমনকি সেই ইংরেজরা তিস্তার ওপর যে-কটা সাঁকো পাহাড়ে তৈরি করেছিল তারপর দেশী সরকার একটি সাঁকোও তৈরি করেনি, অথচ দেখো নীচে সমতলে কত বড় তিস্তা ব্রীজ তৈরি হল, ওরা আমাদের নদীও লুটে নিচ্ছে, আমরা এ হতে দেবো না, তিস্তা ব্যারেজ ভাঙতে হবে। উত্তরখন্ড, কামতাপুর, গোর্খাল্যান্ড ও পুরনো চরের নমশূদ্রের সংগঠন এই এতগুলো আন্দোলনের বিরোধিতার সামনে সরকার তিস্তা ব্যারেজের কাজের গতি বাড়িয়ে দিল।
Teesta_2_
বলা হয় এসব আন্দোলনে কোনো ঐক্য ছিল না। কারণ তিস্তার মতো অভিন্ন নদীকে উজান ও ভাটিতে কেটে কেটে টুকরো করা নিয়ে জনগণের ভেতর যে ক্ষোভ তার সাথে জড়িয়ে পড়ে আরো নানান রাজনীতি। উত্তরখন্ড চায় ভাটিয়া তাড়াতে, নমশূদ্ররা চায় উপযুক্ত পুনর্বাসন, উত্তরখন্ড চায় স্বতন্ত্র রাজ্য, কামতাপুর চায় আসামের একটা অংশের সাথে মিলন, গোর্খাল্যান্ড চায় স্বাতন্ত্র্য। তিস্তার অবস্থান পশ্চিমবঙ্গে হওয়ায় এখানকার যাবতীয় উন্নয়নকে কেবলমাত্র সমতল অঞ্চলের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা হয়েছে। অথচ এখানে রয়েছে পাহাড় ও পাহাড়ি সংস্কৃতি। তিস্তা চরের মানুষ, রাজবংশী, পোলিয়া রাজবংশী, চাবাগান শ্রমিক, সাঁওতাল-মুন্ডা, নেপালি শ্রমিক, কৃষক। তিস্তার চারধার জুড়ে নানা বর্গ, নানা সংস্কৃতি। রাষ্ট্র এ বিষয়টি নিয়ে শুরু করলো সেই বিচ্ছিন্নতার রাজনীতি। নিম্নবর্গের বিরুদ্ধে উসকে দিলো নিম্নবর্গের জান ও জবান। তিস্তা ব্যারেজের বিরোধীতাকারী মূলত উজানের আন্দোলনকে রাষ্ট্র ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আন্দোলন’ হিসেবে আখ্যা দিল। তাই জয় হলো রাষ্টপক্ষের, তিস্তাকে উজান থেকে কেটে মেরে লাশ বানিয়ে জোর করে ভাটিতে টেনে আনার বাণিজ্য পরিকল্পনার। দেবেশ রায় লিখেছেন, ...তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন উপলক্ষে উত্তরখন্ড, কামতাপুর, গোর্খাল্যান্ডের দল আজ বিক্ষোভ করছে বটে কিন্তু সে-বিক্ষোভ তিস্তা ব্যারেজ পর্যন্ত পৌঁছবে না, পৌঁছতে দেয়া হবে না। সরকারের দলগুলিও সারা জেলা থেকে মিছিল নিয়ে ব্যারেজে যাচ্ছে জনসমর্থন জানাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের জলবিষয়ক রাষ্ট্রমন্ত্রী, রাজ্য সরকারের সেচমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং আসছেন উদ্বোধন করতে। আর এরই ফলে ব্যারেজ ঘিরে পুলিশ, সিআরপি, বিএসএফের পাকের পর পাক, পাকেবর পর পাক। তিস্তা ব্যারেজের উদ্বোধন তাই একটা সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধনমাত্র নয়, হয়ে উঠেছে একাটা রাজনৈতিক ঘটনা। তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত পুস্তকটি শেষ করে সমাপ্তি টানতে গিয়ে দেবেশ রায় আবারো লিখেন, ...ব্যারেজ উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে এ বৃত্তান্তের তিস্তা ইতিহাস হয়ে গেলো। এখন আর তিস্তা সেই পুরনো তিস্তা থাকলো না। এখন প্রকৃতির সেই নদীর পুনর্জন্ম ঘটবে মানুষের হাতে। হিমালয়ের তুষারগলা জল আর মৌসুমি মেঘের বৃষ্টিধারায় তিস্তার জল যতই বেড়ে উঠকু, তা বয়ে যাবে মানুষের নিদের্শিত খাতে, নিদের্শিত গতিতে। তখন চর জেগে উঠবে মানুষের ইচ্ছায়। তিস্তা ব্যারেজ আরো কয়েক বছর পর শেষ হবে। তখন সেই নতুন মানুষের তৈরি নদীর সঙ্গে মানুষজনের সহবাসের রীতিনীতি একেবারে আমুল বদলে যাবে। কত দ্রুত আর কতটাই আমুল যে তা বদলায়-তা বদলানোর আগে আমরা ধারণাও করতে পারি না, বদলানোর পরও মাপতে পারি না।

দ্বিতীয় পর্ব: লিংক
তৃতীয় পর্ব: লিংক
চতুর্থ  পর্ব: লিংক


……………………………………

১. নলিন চন্দ্র বর্মণ (বয়স ৮০, পেশা কৃষি, মা গাদলীময়ী বর্মণ ও বাবা শচীন চন্দ্র বর্মণ) এবং সারথী বর্মণী (বয়স ৬০, পেশা কৃষি, মা চানবালা ও বাবা কমলাকান্ত বর্মণ) এ ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। সাক্ষাতকার গ্রহণের সময় : জুলাই-আগস্ট ২০১০
২. রক্তাক্ত রাজপুর (ভূমি জবরদখলের প্রামাণ্য দলিল), ২০০৭, শৌর্য দীপ্ত সূর্য সংকলিত, শ্রাবণ, ঢাকা
৩ সূত্র: ওয়ারপো, ২০০০
৪ বাংলাদেশের নদ-নদী, সম্পাদনা ও প্রকাশনা : মো. শওকত আলী, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা, বাংলাদেশ, পানিবিজ্ঞান জুন ২০০৬
৫ http://www.watertech.cn/english/islam.pdf
৬দেবেশ রায়, ১৯৯০, তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ভারত, পৃ. ৪৪৪-৪৫০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।