আমার মা খালেদা পারভীন। আমার ও আমাদের ভাই-বোনদের আশ্রয় সর্বোপরি।
স্কুল, সংসার-সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের চার ভাই-বোনকে হাসিমুখে আগলে রেখেছেন, বড় করেছেন। বেশি কিছু আশা তার ছিল না, আছে তার একটি স্বপ্ন, তার সন্তানরা ‘ভালো’ মানুষ হয়ে উঠুক, ‘সুশিক্ষিত’ হয়ে উঠুক, ‘শুভবোধসম্পন্ন’ মানুষ হয়ে উঠুক। জানি না আমরা তার যোগ্য হয়ে উঠেছি কীনা। আমি তাঁর অকৃতী সন্তান। তবে তিনি সফলভাবে তার স্বপ্নের দীপ্তি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন প্রিয় ছাত্রীদের মধ্যে, তাঁর চোখে-মুখে সেই প্রশান্তি দেখি, খুব আপন গর্বে বলেন, এই তো সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ডিন অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, খবরটি পেতেই উল্লসিতভাবে বলে উঠলেন, ‘আমার ছাত্রী’। গতরাতে ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন, দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করবেন বলে।
মনটা হতাশায় ভেঙে পড়ে যখন মনে হয় জীবনটা বৃথা, যখন পৃথিবীর সবকিছুই অসুন্দর মনে হয়, তুচ্ছ লাগে, তখন আমার এ-মায়ের এক চিলতে হাসি সবকিছুকে আড়াল করে দেয়। এইচএসসি পরীক্ষার্থী অবস্থায় তার বিয়ে হয়েছে। সেখান থেকে তিনি পিছিয়ে যান নি। আমার বাবার সহযোগিতায় এগিয়ে গেছেন সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে। ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। মানুষের সেবা করবেন বলে। বিয়ে, সংসার সেখান থেকে উঠে এসে, বিভিন্ন প্রতিকূলতার ভেতর আম্মু মর্যাদাবান একটি অবস্থানে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর জীবনসমগ্র আমাদের জীবনকে আলোকিত করে। পরিপূর্ণ করে।
কুমিল্লায় থাকতাম তখন। ছোট্ট একটি বাসা। প্রখর রোদ এসে ভিড় করতো সেখানে। সারা ঘর গরমে তেতে থাকতো। আমাদের তখন কোনো ফ্যান ছিল না। গায়ে বাতাস লাগার কোনো সুযোগও ছিল না। আম্মু তখন আমাকে খাটের নিচে রাখতেন, যাতে কোনো রোদ কিংবা গরম না স্পর্শ করে।
২০১০ সাল, ১৭ ফেব্রুয়ারি। আমার সম্পাদনায় ‘নোয়াখালীর কবি ও কবিতা’ প্রকাশিত হল। আব্বু-আম্মুকে দিয়ে মোড়ক উন্মোচন করাবো বলে সেদিন রাতে আমি বাসায় দুটো কপি নিয়ে আসি। আম্মু আমার বইটি দেখে কী যে খুশী হলেন। বইটা উৎসর্গ করি আব্বু-আম্মু-কে। আমাদের সাফল্যে সবসময় তিনি হেসেছেন। ব্যর্থ হয়েছি যখন ঘুরে দাঁড়াতে সাহস যুগিয়েছেন অকাতরে।
মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক চেতনায় যতটা আমি উজ্জীবিত হয়েছি তার পেছনে আমার আম্মুর ভূমিকা বেশি। প্রতিরাতে আম্মু আমাদের তার দেখা মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন। সেগুলো শুনে শুনে নিজেদের ভেতর মুক্তিযুদ্ধকে লালন করেছি। আমি যখন কলেজজীবনে রাজনীতি করা শুরু করেছি আমার মা জানতেন না, ভেবেছিলাম হয়তো বাধা দেবেন। কলেজজীবন ছাপিয়ে কিছু বছর বিরতির পর আবার যখন প্রকাশ্যে রাজনীতি করা শুরু করি, বাধা দেননি আমার মা। বরং অনুপ্রাণিত করেছেন। মাঝে মাঝে চিন্তিত হন আমাকে নিয়ে।
বইপড়ার অভ্যাসটা আমরা সব ভাই-বোন মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। চোখ ফুটেই দেখে আসছি আম্মুকে বই পড়তে। অসম্ভব বই পড়ার অভ্যাস তার। প্রতিদিন নিয়ম করে বই পড়েন তিনি। আমাদের বাসায় বইয়ের সংগ্রহ সবসময় ছিলো।
আনন্দ-কলেরবে আমার জন্মক্ষণটি উদ্ভাসিত হওয়ার কথা থাকলেও হয়ে ওঠেনি। কেননা আমি একজন জন্মগত অস্বাভাবিক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। কিন্তু তারপর! আমার জন্মের পর আত্মীয়-পরিজন, সমাজ অনেকজনের কথা তাঁকে শুনতে হয়েছে। তাতে ভেঙে পড়েন নি তিনি। কখনো আফসোস করতে দেখিনি। অথবা অস্পৃশ্য করে রাখেননি আমাকে। এটা তাঁর আশ্চর্য সাহসিকতা, তাঁর জয়িতা।
হাবীব ইমন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, গণমাধ্যমকর্মী, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০১৬ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৪