ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গাজার দুঃস্বপ্ন ।। নোয়াম চমস্কি

অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০২ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১৪
গাজার দুঃস্বপ্ন ।। নোয়াম চমস্কি ছবি : সংগৃহীত

গাজায় সর্বশেষ ইসরাইলের হামালয় সব ধরনের আতঙ্ক-বিভীষিকা উপচে পড়েছে। এই ভয়ানক পরিস্থিতি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ইসরাইলের লক্ষ্য একেবারেই সিম্পল।

আর তা হল: শান্তকে একেবারে শান্ত করে দাও। এভাবে সর্বশান্ত করে পুরা ভূখণ্ড নিজের কব্জায় নিয়ে আসার রীতি অনুসরণ করা। তো সেই রীতিটা কী? 
পশ্চিম তীরকে লক্ষ্য করে তেলআবিবের সেই রীতি হল, ইসরাইল সেখানে অবৈধভাবে লাগাতার বসতি স্থাপন করে যাবে। ঘরবাড়ির অবকাঠামো তৈরি করে যাবে।

যাতে পশ্চিম তীর ইসরাইলের সঙ্গে এক হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে ইসরাইল ফিলিস্তিনকে ভারসাম্যহীন ও সার্বিক অর্থে অস্থিতিশীল একটি অঞ্চলে পরিণত করেছে। তাদেরকে দমন-পীড়ন, সহিংস জুলুম নির্যাতনের মধ্যে নিয়ে গেছে।          

গাজার জন্য এক নিষ্ঠুর-ধ্বংসাত্মক অবরোধের মধ্যে দুর্বিষহ জীবনযাপনই হল এ রীতি। ইসরাইলের শাসকগোষ্ঠী শুধু তাদেরকে একটু বেঁচে থাকার সুযোগ দিচ্ছে। এরচে বেশি কিছু না।   

গাজায় ইসরাইলের এই তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে ইসরাইলের তিন কিশোরকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে। দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইলের একটি বসতি থেকে ওই তিন কিশোরকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করা হয়। এর এক মাস আগে রামাল্লার পশ্চিম তীরের দুই ফিলিস্তিনি কিশোরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার দিকে কিছুটা মনোযোগ দিতে হল। কারণ এটা যে রুটিন বা নিয়মিত কাজ সেটা বুঝার ব্যাপার আছে।         

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক মুইন রাব্বানি তার এক রিপোর্টে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের জীবনের প্রতি পশ্চিমে প্রাতিষ্ঠানিক যে অবহেলা গড়ে উঠেছে তাতে কেন ফিলিস্তিনিরা সহিংসতার ক্ষেত্র তাই শুধু ব্যাখ্যার জন্য সহায়ক হয়ে ওঠেনি। এমনকি গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সর্বশেষ হামলার ঘটনা ব্যাখ্যা করতেও কাজে লাগছে পশ্চিমের এই অবহেলা। ’ 

বেশ কয়েক বছর ধরে ইসরাইলের হত্যাযজ্ঞ এবং সন্ত্রাসের মধ্যেই গাজায় অবস্থান করছেন মানবাধিকার আইনজীবী রাজি সুউরানি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘যখনই লোকজন যুদ্ধ বিরতি নিয়ে কথা বলা শুরু করে তখন তাদের মুখে আমি একটি বহুল প্রচলিত কথাই শুনি। সবাই তখন এ কথাটাই বলে যে, আমাদের সবার জন্য সবচেয়ে ভাল হল মরে যাওয়া। পরিস্থিতি থেকে পিছনে ফিরে যাওয়া নয়। আমরা তো এই যুদ্ধেরও বহু আগে থেকেই এভাবে অভ্যস্ত। আমরা এমন কিছু করতে চাই না যা আবার করতে হয়। আমাদের কোনো আত্মমর্যাদা নেই। আমাদের কোনো গর্ব নেই। আমরা নিছকই কারো নরম কোমল লক্ষ্যবস্তু মাত্র। আমরা খুবই সস্তা। হয় এই পরিস্থিতির সত্যিকার উন্নতি হবে, না হয় আমাদের জন্য মরে যাওয়াই ভাল। আসলে আমি বুদ্ধিজীবী, একাডেমিশিয়ান ও সাধারণ মানুষদের বলা কথা সম্পর্কে এমন কথাই বলছি যা আসলে তারা সবাই বলছে। ’  

২০০৬ এর জানুয়ারিতে বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয় ফিলিস্তিনে। আর এ অপরাধ হল, এতে ভুল প্রক্রিয়ায় খুবই সচেতনভাবে পর্যবেক্ষণ করা একটি অবাধ নির্বাচনে তারা ভোট দেয়। যেখানে পার্লামেন্টের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হামাসের হাতে।    

আর তার সঙ্গে মিডিয়া একেবারে অব্যাহতভাবে বলে যায়, হামাস ইসরাইল ধ্বংসের জন্য জানপ্রাণ। অথচ বাস্তবতা হল, হামাস বারবার এই কথা পরিষ্কারভাবে বলে আসছে, তারা আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও স্বীকৃতির ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্র সমাধানের নীতি মেনে নেবে। আর এর চেয়ে বড় বাস্তবতা হল ৪০ বছর ধরে দুই রাষ্ট্র সমাধানের এই বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল যৌথভাবে আটকে রেখেছে।    

অথচ উল্টা যে ঘটনা সেটা হল, হামাস ইসরাইলের ধ্বংসের জন্য জানপ্রাণ নয় বরং ইসরাইলই পাল্টা ফিলিস্তিনকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অবশ্য এ নিয়ে তারা কিছু অনর্থক অনুষ্ঠান সর্বস্ব কথা দেয় আর অযথা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথাও বলে যায়।     

২০০৬ সালে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন করে যে অপরাধ করেছে ফিলিস্তিনিরা তার জন্য তাদেরকে শাস্তিও দেয়া হয়েছে। ইউরোপকে সাথে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল নির্লজ্জভাবে ফিলিস্তিনের নিরীহ জনগণের উপর নগ্নভাবে অবরোধ আরোপ করে। আর তারপরই ইসরাইল তার সহিংস হামলা শুরু করে।
সত্য কথা হল, ফিলিস্তিনের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে দিতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের দ্রুত পরিকল্পনা করছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। কিন্তু হামাস মারাত্মক সাহসিকতার সাথে ওই পরিকল্পনা নস্যাত করে দেয়। আর তাতেই ইসরাইল গাজায় হামলা শুরু করে। এবং গাজায় ইসরাইলের যে অবরোধ চলে আসছিল তা আরো কঠোর ও ভয়াবহ হয়ে ওঠে।   

এই দুঃসহ আর ভয়ানক ঘটনাগুলো আর পর্যালোচনার দরকার নেই। তাদের অবিরাম অবরোধ আর বর্বর হামলা এমন ‘কচুকাটা’র মত হত্যাযজ্ঞের ফলে বরং বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শত্রু বধ করার অনুশীলনের নামে একটি পুকুরে তারা গুলি করে মাছ মারার মহড়া দিচ্ছিল। সে সময় ইসরাইলের যে সুখের অভিব্যক্তি দেখা গেছে তাতে তো তাই মনে হয়। এ মহড়া ছিল তাদের আত্মরক্ষার। তারা বলেও, গাজার বিরুদ্ধে তাদের হামলা একটি ‘আত্মরক্ষার লড়াই’।  

এর আগেও একবার এমন ‘কচুকাটা’ হয়েছিল। তো ফিলিস্তিনের বেপরোয়া জনগণ চাইল যেকরেই হোক যে কচুকাটা হয়েছে তা পুনরুদ্ধা করতে। হত্যা ও ধ্বংসের করাল থেকে এই কাটা কচুগুলোকে নতুন করে গড়ে তুলতে। তো তাদের কাছে একটিই উপায় ছিল আর তা হল যুদ্ধবিরতি চুক্তি। গাজায় যে যুদ্ধবিরতির কথা এখন শোনা যায় সেটা তখনকার সেই ২০১২ সালের কচুকাটার সময়ে বলবৎ হয়েছিল। ২০১২ সালের সেই কচুকাটা অপারেশনকে বলা হয়েছিল ‘অপারেশন পিলার অব ডিফেন্স’।     

ইসরাইলের অবরোধের মধ্যেই যুদ্ধবিরতি পালন করেছে হামাস। ইসরাইল তা স্বীকারও করে নিয়েছে। তবে এ বছরের এপ্রিলে এসেই ঘটনা অন্যরকম হয়ে গেল। এপ্রিলে ফাতাহ ও হামাস একটি সমঝোতা চুক্তি করে। এ চুক্তি মতে তারা একটি নতুন ঐক্য সরকার গঠন করে। এ সরকার গঠনের প্রক্রিয়া হল টেকনোক্র্যাট পদ্ধতি। মানে সরকার কাঠামোতে কোনো দলেরই দলীয় কোনো সম্পর্ক বা দলীয় লোক যুক্ত হবে না।

প্রাকৃতিকভাবেই ইসরাইল ভয়ঙ্কর। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন যখন ইসরাইলের চলমান এই ভয়ঙ্কর তৎপরতাকে নীরবে অনুমোদন বা অঘোষিতভাবে স্বীকৃতি দিতে পশ্চিমা দুনিয়াকে যুক্ত করল তখন দেশটি আরো নির্মম ভয়ানক হয়ে ওঠে। ইসরাইল বারবার দাবি করে আসছে তারা বিভক্ত ফিলিস্তিনের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনায় যেতে পারবে না। আর তার জন্যই যখন ফাতাহ ও হামাসের এই ঐক্য চুক্তি হয়, তখনও ‘বিভক্ত ফিলিস্তিনের সঙ্গে’ আলোচনায় না যাওয়ার ইসরাইলি দাবি অপরিবর্তিত থেকে যায়। এমনকি ইসরাইল আরো একধাপ এগিয়ে হুমিক দেয় যে, তারা পশ্চিম তীর থেকে গাজাকে দীর্ঘ মেয়াদে আলাদা করে রাখবে। এটাও তাদের লক্ষ্য। একইসঙ্গে তারা গাজা ও পশ্চিম তীরে তাদের ধ্বংসাত্মক নীতি বাস্তবায়ন করে যাবে।

পশ্চিম তীরে যখন ইসরাইলের তিন কিশোরকে খুন করা হয় তখন ১২ জুন তো কিছু ঘটারই ছিল। তাদেরকে যে মারা হবে সেটা আগে থেকেই নেতানিয়াহুর সরকার জানত। অথচ তারা এ ঘটনাকে অন্যভাবে বুঝানোর একটা ভান করে। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই তারা মূলত হামাসকে লক্ষ্য করে পশ্চিম তীরে তাণ্ডব শুরু করার সুযোগ তৈরি করে।     

প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবিও করেছিলেন যে, হামাস ওই তিন ইসরাইলি কিশোর হত্যার জন্য দায়ী এ কথা তিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানেন।   
তবে হামাস বিষয়ক ইসরাইলের অন্যতম প্রধান কর্তৃপক্ষ শলমি এল্ডার জানান, এই ঘটনার হত্যাকারীরা খুব সম্ভব হেবরনের একটি ভিন্ন মতাবলম্বী গ্রুপের। যারা হামাসকে অনেক আগে থেকেই কাঁটার মত বাধা দিয়ে আসছে। এল্ডার বলেন, ‘আমি নিশ্চিত, তারা হামাসের নেতৃত্ব থেকে কোনো ধরনের সবুজ সংকেত পায়নি। তারা শুধু মনে করেছিল, এটাই হল ঘটনা ঘটিয়ে দেয়ার সঠিক সময়। ’

এই অপহরণ ও খুনের পরবর্তী আঠারো দিনের ইসরাইলি তাণ্ডব ফিলিস্তিনির ঐক্য সরকারকে দুর্বল করতে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। একইসঙ্গে ইসরাইলের দমন-পীড়ন আরো বাড়াতেও সফল হয়েছে দেশটির বিধ্বংসী তৎপরতা। ৭ জুলাই ইসরাইল গাজায় হামলা চালিয়ে হামাসের সাত সদস্যকে হত্যা করে।
জবাবে হামাস রকেট হামলা চালায়। ১৯ মাসের মধ্যে এটাই প্রথম হামাসের রকেট হামলা। ৮ জুলাই পর্যন্ত ইসরাইল আত্মরক্ষার্থে হামলা চালাচ্ছে এমন একটা ভান ধরে।   

৩১ জুলাই পর্যন্ত ১৪০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। যাদের বেশির ভাগই সাধারণ মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু। অবশ্য ইসরাইলের তিন বেসামরিক নাগরিকও নিহত হয়। আঠারো দিনের এ সময়ে গাজার বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। চারটি হাসপাতালে হামলা চালায় ইসরাইল। এর প্রতিটিই যুদ্ধাপরাধ।   
এরপরও ইসরাইলের কর্মকর্তারা মানবতার দোহাই দিয়ে বলছেন, তাদের সেনাবাহিনীই হল ‘বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিকতা সম্পন্ন সেনাবাহিনী। ’ এই সেনাবাহিনীই ঘোষণা দিচ্ছে যে, ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়া হবে। এই আচরণ ‘আগ্রাসী, বকধার্মিকতার এবং দয়া ও মানবতার নামে ছদ্মবেশী। ’ ইসরাইলের সাংবাদিক আমিরা হাস এক প্রতিক্রিয়ায় এমনটি বলেছেন।

আমিরা হাস বলেন, ‘একটি রেকর্ড করা বার্তায় দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষে অন্য কোনো একটি নিরাপদ জায়গার জন্য শত শত চিৎকার দিচ্ছে। ইতিমধ্যে তারা তাদের টার্গেট করা ঘরবাড়ি ছেড়ে বের হয়ে গেছে। অথচ ১০ কিলোমিটার দূরে যে জায়গায় যাওয়ার জন্য তারা চিৎকার করছে সেটাও সমান বিপজ্জনক। ’
এমনকি গাজার কারাগারও ইসরাইলের আগ্রাসন থেকে নিরাপদ নয়। এমনকি এই আগ্রাসন ২০০৮-০৯ সালে গাজায় ইসরাইলের অপারেশন কাস্ট লিড এর ভয়াবহ অপরাধের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে।  

অপরদিকে বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিকতা সম্পন্ন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার কাছ থেকে যেসব সাধারণ প্রতিক্রিয়া আসে তার মধ্যে গোপন সব কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। যেমন ইসরাইলিদের প্রতি গভীর সহানুভূতির কথা ফাঁস করে দিয়ে ওবামা বলেন, ইসরাইলিদের জন্য ব্যাপক সহানুভূতি। হামাসের প্রতি তীব্র নিন্দা। এবং সবশেষে তিনি উভয় পক্ষের প্রতি উদার হওয়ার আহবান জানান।

ইসরাইলও তেমনি আশা করেছিল। কারণ আগেও এধরনের পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি তার সমর্থনের কথা জানিয়ে গেছেন। আর ইসরাইল সে সমর্থনও পেয়েছেন। যখন চলমান হামলার ডাক দেয়া হল, ইসরাইল আশা করেছিল, স্বাধীনভাবে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই দখলকৃত এলাকাগুলোতে তাদের অপরাধমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে যাবে।

অবশ্য গাজাবাসীকে মুক্ত করা হবে। ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত কারাগারগুলোতে ফেরত পাঠিয়েই তবে তাদেরকে মুক্ত করা হবে। অপরদিকে ফিলিস্তিনিদের যা কিছু অধিকার ও মালিকানা এখনো অবশিষ্ট আছে তা যখন ইসরাইলের সেনাবাহিনী ধুলিস্যাত করে যাচ্ছে তখনও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা শান্তি দেখতে পাচ্ছে।  

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞে প্রধানত ও একতরফাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর এ অপরাধযজ্ঞই হল ইসরাইল-মার্কিন সম্পর্কের ফলাফল। অপরদিকে ইসরাইল-ফিলিস্তিন নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমধানের বিষয়ে যে সমঝোতা হয়েছে সেটাও প্রত্যাখ্যান করছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরাইলের প্রতি তার সমর্থন তুলে নেয় তবে ভবিষ্যত অন্যরকম হবে।    

এ অবস্থায় গাজায় ‘স্থায়ী সমাধান’র পথে উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হতে পারে। ইতিমধ্যে ইসরাইলে প্রতি ঐতিহাসিক নিন্দা জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি সমধানের আহবান জানিয়েছেন। তবে এই বক্তব্যের কয়েকটা ব্যাখ্যাও হতে পারে। ইসরাইলের অবরোধ তুলে নেয়া এবং নিয়মিত হামলা ও বিভীষিকা বন্ধের আহবান হতে পারে এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা। অথবা দখলকৃত এলাকায় আন্তর্জাতিক আইনের বাস্তবায়নের আহবানও হতে পারে।  

চল্লিশ বছর আগেই ইসরাইল তাদের নিজেদের নিরাপত্তা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এ সময় মিশর যে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দেয় দেশটি তাও প্রত্যাখ্যান করে। ইসরাইল তথন মিশরের সিনাই দখল করে সেখানে ব্যাপকভাবে বসতি স্থাপন ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছিল। দখলকৃত এই সিনাই উপত্যকা থেকে মিশরীয়দের সরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তখন। তবে ইসরাইল বরাবরই তাদের নীতি নিয়েই আছে। এর বাইরে নয়।      

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি বিশ্ব সম্প্রদায়ের সঙ্গে এক হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, তবে এর একটা বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। অবশ্য বরাবরই যেটা দেখা গেছে সেটা মার্কিন প্রশাসন যাই দাবি করেছে, যাই চেয়েছে, তাতেও ইসরাইল তার লালিত চিন্তা বা পরিকল্পনা থেকে সরে আসেনি।

এখন পর্যন্ত ইসরাইলের খুব সামান্য আশ্রয়ই আছে। ইসরাইল যখন তার নীতিমালা গ্রহণ করে তারপরই দেশটি এ আশ্রয় পায়। আর এসব নীতি গড়ে উঠেছে এমন একটি দেশের ভেতর থেকে, যে দেশ শুধু একটি দেশের কাছেই প্রশংসিত ও পছন্দনীয়। আর এই হল আতঙ্কিত ও ঘৃণ্য এক দেশ। অন্ধ সংকল্পযুক্ত এসব নীতি এখন ক্রমাগত নৈতিক অধপতনের দিকে যাচ্ছে। এমনকি সম্ভাব্য চূড়ান্ত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।      

তবে যুক্তরাষ্ট্র কি তার নীতি পরিবর্তন করতে পারে? এটি অসম্ভব নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মতামতের গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর ঘটেছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না।

কয়েক বছর ধরে জনমত ও গণ আকাঙ্ক্ষার একটি ভাল ভিত্তি গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রে। এতে করে ওয়াশিংটন সহায়তা সম্পর্কিত তার নিজস্ব আইন কানুন ও ইসরাইলকে দেয়া সামরিক সহায়তা বন্ধ করার বিষয়গুলোতে নজর দেয়া শুরু করেছে। মার্কিন আইনের বক্তব্য হল, ‘যে দেশের সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের ব্যাপকতর লঙ্ঘনের সঙ্গে অবিচলভাবে জড়িত, সে দেশকে কোনো ধরনের নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া যেতে পারে না। ’

এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে ইসরাইল অবিচলভাবে জড়িত এবং সুনির্দিষ্টভাবে অপরাধী। এমনকি বহু বছর ধরে দেশটি এ ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে।         
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যের সিনেটর প্যাট্রিক লিয়াহি এই আইনের বিধান রচয়িতা। প্যাট্রিক লিয়াহি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ঘটনায় তার আইনের যথার্থতা ও প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে সুপরিচালিত শিক্ষা, সাংগঠনিক ও আন্দোলনের প্রচেষ্টাও ছিল। এ ধরনের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সফলভাবে চালিয়ে নেয়া যেতে পারে।       

‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের’ অংশ ও শরিক হওয়ার জন্য ওয়াশিংটনকে বাধ্য করতে এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরি হতে পারে।
এছাড়া বছরের পর বছরের সহিংসতা ও দমন পীড়নের শিকার নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের জন্য আর কিছুই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেব না।

নিউ ইয়র্ক টাইমস সিন্ডিকেটের সৌজন্যে লেখাটি ৩ আগস্ট ট্রুথ-আউট তাদের অনলাইনে প্রকাশ করে

লেখক: মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক ও বিখ্যাত প্রতিবাদী বুদ্ধিজীবী

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।