নিষ্ঠুর সময় দ্রুত চলে যায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যখন এই লেখাটি যাদের উদ্দেশ্যে লিখছি তারা দুজনই এই জাগতিক জীবন থেকে অনেক দূরে।
অথচ এই সেদিনও মিশুক ভাই এর সাথে নিউইয়র্কের স্টারবক্স এ বসে কফির চুমুকের সাথে সাথে কত বিষয় নিয়েই না আড্ডা! মিডিয়া নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন!! এটিএন নিউজে নতুন নতুন কত বিষয় নিয়ে অনর্গল কথা বলে গেলেন মিশুক মুনির। আমি আর বন্ধু আতিক তাই শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনেছি। বয়সের লম্বা তফাত থাকা সত্বেও কখনও মনে হয়নি মিশুক ভাই আমাদের চেয়ে অনেক বড়। কখনও মনে হয় নি তিনি বাংলাদেশের একজন বড় মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব। শুধু মনে হত তিনি বুঝি আমাদেরই একজন খুব কাছের এক বন্ধু। অথচ তাঁর সাথে আগে থেকে যে খুব পরিচয় ছিল তাও কিন্তু নয়।
নামটা জানা ছিল। আরো জানা ছিল তিনি শহীদ মুনির চৌধুরীর পুত্র। অথচ বন্ধু আতিকের বাসায় আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের পরমুহুর্ত থেকেই তিনি একজন কাছের মানুষ হয়ে গেলেন। সমস্যাটা হয়ে গেল সেখানেই। কাছের মানুষ হয়ে যাওয়া মানেই আত্মার আত্মীয়।
মিশুক ভাই বাংলাদেশে চলে গেলেন। ঠিক তিন দিন পর গভীর রাতে চলচ্চিত্র নির্মাতা এনায়েত করিম বাবুল ভাই এর ফোন। মিশুক ভাই, তারেক মাসুদ নাকি আর নেই। সেই চশমা আর তার আড়ালে বুদ্বিদীপ্ত চোখ, কাশ ফুলের মত ইয়া বড় গোফ ঝুলে আছে নাকের ডগায়, এলোমেলো শুভ্র চুল, ছিপছিপে লম্বা, কফি পাগল, বিরিয়ানি পাগল লোকটা নাকি আর নেই!! কি অবাক করার মত কথা!! মৃত্যুর কঠিন আর নির্মম বাস্তবতার শিকার তাকে হতেই হল।
শুধু বার বার মনে হয় এই মৃত্যুর মত এত বাস্তব সত্য আর কি হতে পারে?
গত ৫ সেপ্টেম্বর, সোমবার নিউইয়র্ক ফিল্ম সেন্টার জ্যাকসন হাইটস এর জুইস কমিউনিটি সেন্টারে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদ এবং তাদের তিনজন সহকারীকে বুক ভরে স্মরণ করল। আলোচকরা কেউ ছিলেন তাদের নিকট আত্মীয়, কেউ বন্ধু, কেউ সহযোগী যোদ্ধা। অসাধারণ এক অনুষ্ঠান। এই দুই চলে যাওয়া বরেণ্য ব্যক্তিত্বের উপর নির্মিত এনওয়াইএফসির ১৫ মিনিটের একটি ছোট্ট তথ্যচিত্র ছিল অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শকবৃন্দের জন্য আরেকটি বাড়তি উপহার। পিনপতন নীরবতায় অনুষ্ঠানে সবাই তাদের শ্রদ্ধা জানালেন।
নিউইয়র্ক ফিল্ম সেন্টার এই দুই কৃতি ব্যক্তিত্বের উপর ছোট্ট পরিচিতিমূলক পুস্তিকা প্রকাশ করল।
সেখানে তারা লিখল, ‘বন্ধু, আমরা তোমাদের কবর দিইনি, আমরা তোমাদের রোপন করেছি ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে...’ কি অসাধারণ কথা! মৃত্যু মানেই কি শুধু সমাপ্তির শেষ ঠিকানা? মৃত্যু মানেই কি চোখের পলকে উপরে উঠা স্বপ্নের বীজ? না। মৃত্যুকেও জয় করা যায়। মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদদের মৃত্যু নেই। তাদেরকে রোপন করা হয়েছে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই বাংলায়। আমরা নিশ্চিত বাংলার একুল ওকুল দুকুল ছাপিয়ে সেখান থেকে আরো অগণিত তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরদের জন্ম হবে।
নিউইয়র্ক ফিল্ম সেন্টারকে ধন্যবাদ জানাই এমন একটি সময় উপযোগী, সুন্দর ঝরঝরে স্বরণ সভা আয়োজন করার জন্য। তবে সেই সাথে আরো দুটো কথা বলার জন্য প্রাণটা ব্যাকুল হয়ে আছে। স্মরণ সভায় দেখা গেল, অনেক বক্তাই অতিরিক্ত আবেগ আর ভালোবাসার চোটে অনেক ভুল ভাল বকে গেলেন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা কবির আনোয়ার বললেন, তিনি নাকি তারেক মাসুদের ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ প্রয়াত চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবির এর সাথে দেখেছিলেন এক সাথে বসে এবং এর প্রশংসাও করেছিলেন। কি তাজ্জব কথা? আলমগীর কবির মারা গেলেন ১৯৮৭ সালে, আর ’গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ মুক্তি পেল ১৯৯১ সালে। প্রশ্ন হল- যে ব্যক্তিটি এনিমেশনটির জন্ম হওয়ার তিন বছর আগেই মারা গেলেন তার সাথে একসাথে বসে কবির আনোয়ার কিভাবে ছবিটি দেখলেন এবং এর প্রশংসা করলেন?
লেখক বেলাল বেগ আরো এক কাঠি এগিয়ে বলেই দিলেন যে, তারেক মাসুদ নাকি উচ্চ শিক্ষার জন্য পুনাতে গিয়েছিলেন। অথচ সত্য হল এই- তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্রি হয়েছিলেন।
অ্যাডভোকেট এন মজুমদার নামে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে গেলেন কিছু কথা বলার জন্য। মাইক হাতে নিয়েই তারেক মিশুক স্মৃতিকে সম্পূর্ন পাশ কেটে ভিন্ন সুরে কথা বলার চেষ্টা শুরু করে দিলেন। যদিও এনওয়াএফসির কর্মকর্তাদের প্রচণ্ড তোপের মুখে ভদ্রলোক খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি।
কিন্তু কথা হল এমন কেন হবে? মাইক দেখলেই এখানে অনেকেই আছেন যারা উপযাজক হয়ে দাঁড়িয়ে দুকথা বলতে চান। কিন্তু কেন? সব বিষয়ে সবাইকে কথা বলতে হবে কেন? বিষয়টা নিয়ে ভাববার অবকাশ আছে বৈকি?
আবারো মিশুক ভাই এর কাছে ফিরে আসি। এই মিশুক ভাইরা হলেন আমাদের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। এদের মৃত্যু নেই। মৃত্যু এদের কে ছুঁতে পারে না। পারবে না। আর সে কারণেই মিশুক মুনীর, তারেক মাসুদরা বেচে রইবেন আমাদের মাঝে সবসময়, সকল সময় ধরে।
আদনান সৈয়দ: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪