ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারে না

ইমদাদুল হক মিলন, সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৪
মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে পারে না ছবি: প্রতীকী

দেশের খুব নামকরা একটা হাসপাতালে মাসখানেক আগে ভর্তি করা হয়েছিল আসলাম সাহেবকে। হৃদরোগ ও কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন।

তাঁর স্ত্রী গৃহবধূ, মেয়ে এমবিএ পড়ছে। ছেলেও ছাত্র। সংসারের উপার্জনক্ষম মানুষ শুধু আসলাম সাহেবই। তিনি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অত নামকরা হাসপাতালে মাসখানেক চিকিৎসা করিয়েও বাঁচানো গেল না তাঁকে। ১৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টায় তিনি মারা যান। এই এক মাসে হাসপাতালে বিল হয়েছে ৩১ লাখ টাকা। অতি কষ্টে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি টাকার ব্যবস্থা হয়নি বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ আটকে রেখেছে। বাবার লাশের জন্য ৩৫ ঘণ্টা ধরে মেয়ে সাদিয়া হাসপাতালের বারান্দায় বারান্দায় দৌড়াচ্ছিল, কান্নাকাটি করছিল। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লাশ দিচ্ছে না। তাদের বক্তব্য, ‘আমরা আগে থেকেই বারবার রোগীর স্বজনদের সতর্ক করেছিলাম বিলের ব্যাপারে। এমনকি বিল পরিশোধের সমস্যা থাকলে প্রয়োজনে কম খরচের অন্য কোনো হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা বরাবরই জানিয়েছে, টাকার কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু রোগীর অবস্থার অবনতি শুরু হলে তারা বিল পরিশোধে গড়িমসি শুরু করে। এমনকি রোগীর মৃত্যুর পরও তারা টাকা দেই দিচ্ছি বলে সময় পার করছে। ১৯ লাখ ৮১ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। এই টাকার কী হবে?’ (কালের কণ্ঠ, ১৭ আগস্ট)

একদিকে মৃতের পরিবারের অসহায়ত্ব, অন্যদিকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মনোভাব- সব মিলিয়ে জটিল অবস্থা।

এ ধরনের পরিস্থিতি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয় বলে মনে হয় না। সেসব দেশের নাগরিকদের চিকিৎসাসেবার পদ্ধতি অন্য রকম। রাষ্ট্রের বড় দায়ভার থাকে তার নাগরিককে সুচিকিৎসা দেওয়ার।

দেশের খবরের কাগজগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই ‘চিকিৎসার্থে সাহায্যের আবেদন’ শিরোনামে অসুস্থ অসহায় মানুষের ছোট্ট ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে কতটা সাড়া দরিদ্র মানুষটি পান, তাঁর চিকিৎসা কতটা সুষ্ঠুভাবে হয়, তা আর আমরা জানতে পারি না। আদৌ হয় কি না, অসহায় অসুস্থ মানুষটির পাশে আদৌ দাঁড়ায় কি না সচ্ছল মানুষরা, আমরা জানি না। শুধু এটুকু জানি, বাঙালি আবেগপ্রবণ জাতি। আমাদের বড় সম্পদ আমাদের আবেগ। বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা আমাদের আছে, সে কারণেই অসহায় মানুষ এভাবে সংবাদপত্রের মাধ্যমে নিজের জীবন বাঁচানোর আকুতি জানায়। কমবেশি সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের চেষ্টা করে। বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চিকিৎসাক্ষেত্রের চেহারাটি এ রকম নয়। সংবাদপত্রের মাধ্যমে মানুষের সাহায্য চেয়ে চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের দৃষ্টান্ত কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই সব দেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় গরিব মানুষের চিকিৎসা হয়। টাকার অভাবে কেউ চিকিৎসা করাতে পারছে না- এমন নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেসব দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আছে স্বাস্থ্য বীমা। হাসপাতালগুলো রোগীর চিকিৎসা দেবে যতটা সম্ভব আধুনিক পদ্ধতিতে। চিকিৎসার ব্যয়ভার নিয়ে মাথা ঘামাবে না, রোগ সারানোর চেষ্টা করবে সাধ্যমতো। রোগী, ডাক্তার, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ- সবাই জানে চিকিৎসার ব্যয়ভার সমন্বিত হবে স্বাস্থ্য বীমা থেকে। বিনা চিকিৎসায় একজন মানুষও মারা যাবে না।

আর আমাদের দেশে?
‘দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০ শতাংশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে। অন্যদিকে ধনী-দরিদ্র-নির্বিশেষে ৬৪ শতাংশ মানুষকে নিজ পকেটের টাকা খরচ করে চিকিৎসাসেবা কিনতে হচ্ছে। চিকিৎসার পেছনে মানুষের নির্ধারিত আয়ের বড় অংশ ব্যয় হওয়া ছাড়াও ভিটামাটি, ফসলের জমি, গৃহপালিত পশু ও জরুরি ব্যবহার্য জিনিসপত্র বিক্রি, ঋণ করা, মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নেওয়ার মতো উপায় বেছে নিতে হয়। ’ (কালের কণ্ঠ, ১৭ আগস্ট)।

এই অবস্থায় অতি প্রশংসনীয় এক উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০টি রোগের চিকিৎসার সার্বিক ব্যয় বহন করবে সরকার। ‘ন্যাশনাল সোশ্যাল হেলথ প্রোটেকশন স্কিম’ নামের একটি কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কর্মপন্থায় দরিদ্র অসহায় মানুষের স্বাস্থ্য বীমার ব্যবস্থাও আছে। এই স্কিমের আওতায় পর্যায়ক্রমে ধনী-দরিদ্র সব মানুষকেই স্বাস্থ্য বীমার আওতায় নিয়ে আসা হবে। বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে হবে উপার্জনের হার অনুযায়ী। গরিব ও দুস্থদের প্রিমিয়ামের অর্থ জোগান দেবে সরকারের বিশেষ তহবিল। সব মানুষই নির্ধারিত হারে প্রিমিয়াম দেবে। এর সুবাদে যখন যার চিকিৎসার প্রয়োজন হবে, তখন সে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাবে। যার চিকিৎসার প্রয়োজন পড়বে না, সে ওই বীমার কোনো সুবিধাও ভোগ করতে পারবে না; কিন্তু প্রিমিয়াম ঠিকই দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় একের টাকায় অন্যরা চিকিৎসা পাবে। বিশেষ করে গরিবদের চিকিৎসায় ধনীদের আর্থিক অংশগ্রহণমূলক সহায়তার বাধ্যবাধকতা থাকবে (কালের কণ্ঠ, ১৭ আগস্ট)।

অতি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। দেশের সাধারণ মানুষ এই উদ্যোগকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করবে। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে, সরকারের জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে বাড়বে। এ ধরনের উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদা, বেঁচে থাকার মূল ভিত্তি। পাকিস্তানিরা এই ভিত্তির ওপর বাঙালি জাতিকে দাঁড়াতে দিতে চায়নি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলাম এই ভিত্তির ওপর দাঁড়ানোর আশায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আলোড়িত হয়েছিল এই ভিত্তিকে আশ্রয় করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো, ধীরে ধীরে আমাদের এই পাঁচটি মূল চাহিদার জায়গা শক্ত হতে লাগল। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠল। এখন বাংলাদেশে অনাহারে আর একজন মানুষও মারা যায় না। বাংলাদেশের কোনো মানুষের পরনে কাপড় নেই- এমন কথা দেশের শত্রুরাও বলতে পারবে না। শিক্ষার হারও বেড়েছে অনেক গুণ। ধীরে ধীরে বাড়ছে উন্নতমানের বাসস্থান। শুধু জটিল অবস্থায় পড়েছিল স্বাস্থ্য খাত। গরিব মানুষরা বহন করতে পারছিল না চিকিৎসার ব্যয়ভার। সরকারি হাসপাতালগুলোর চূড়ান্ত অব্যবস্থাপনা, ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস, ওষুধের দাম- সব মিলিয়ে খুবই শোচনীয় পরিস্থিতি। এই অবস্থা দূর করতে হবে। উন্নত করতে হবে সরকারি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা।

একজন রোগীর সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিয়ে যে জটিলতা, যে দালালচক্রের কারসাজি, অসহায় মানুষকে জিম্মি করে যে টাকার খেলা- এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সরকারি ওষুধ রোগীর চিকিৎসায় না লাগিয়ে বিক্রি করে দেওয়া, ডাক্তারদের উদাসীনতা এবং দায়িত্বে অবহেলা- সব দূর করতে হবে। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রের যেখানে যেসব জটিলতা আছে, সব দূর করে মানুষকে বাঁচার পথ করে দিতে হবে। গরিব মানুষ সরকারি হাসপাতালে যাবে বাঁচার আশায়। তারা যেন সুচিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে আসতে পারে, আমরা সে রকম একটা পরিবেশ চাই। অনেক পরে হলেও চিকিৎসা খাতে দরিদ্র অসহায় মানুষের জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করল সরকার, এই ব্যবস্থার ফলে মানুষ স্বস্তির শ্বাস ফেলবে। মানুষ আশান্বিত হবে।
বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ।


 
ইমদাদুল হক মিলন, সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ
 


বাংলাদেশ সময় ১১০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।