বাংলাদেশে শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে সাপের উপদ্রব বাড়ে। খুউব বাড়ে।
সর্প শাবকদের কুকর্মে বাংলাদেশে প্রতি বছর পাঁচ সাত জন মানুষ মারা যায়। কিন্তু সাপ মারা যায় বেশুমার, অনেক। পত্র-পত্রিকায় মানুষ মরার খবর হয়, সাপ মরার খবর হয় না। দেখতে দেখতে শ্রাবণ-ভাদ্র মাস শেষ হয়। যে ক’টি মাতা-পিতা-ভাই-ব্রাদার সাপ বেঁচে থাকে, তারা যথারীতি গর্তে লুকায়। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করতে থাকে, স্বপ্নে দেখে আবার তারা বংশবৃদ্ধি করবে।
সর্পমাতারা তাদের নাদান, অবুঝ, জোয়ান সন্তানদের বংগ রজনীর হাজার এক রাত্রির গল্প বলে বলে নির্ঘুম রাত কাটায়। কিন্তু তাদের বংশ খুব একটা বৃদ্ধি হয় না, কোনো মতে টিকে থাকে মাত্র।
প্রিয় পাঠক, ‘খুনের মৌসুম’ শিরোনামের লেখায় সাপের গল্প কেন বলছি? কারণ একটু খেয়াল করে দেখুন, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলি রাজনৈতিক হত্যাকাণণ্ড ঘটেছে, সেগুলোর অধিকাংশই মে থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে। ৩০ মে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ২১ আগস্ট আইভি রহমানসহ ২৫ জন নেতাকর্মী হত্যাকাণ্ড, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতার জেলহত্যা কাণ্ড এবং ৭ নভেম্বর হত্যাকাণ্ড।
পাকিস্তানি মিলিটারি ২৫ মার্চ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে গণহত্যাগুলি চালিয়েছিল। এই সময়কালের মধ্যে আগস্ট মাস হচ্ছে একেবারে মাঝখানে। এই সময়ে কি শুধু খুনের ষড়যন্ত্রই হয়? না, আরো অনেক কিছু হয়। বাংলাদেশের কৃষকরা যেমন বর্ষাকালে বসে বসে ভাবেন, আগামী মৌসুমে কোন জমিতে, কোন ফসলের চাষ করবেন? তেমনি রাজনীতিবিদরা ভাবতে থাকেন, কার সাথে জোট করে কিংবা কার জোট ভেঙ্গে, কিভাবে পরবর্তী মৌসুমে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলবেন?
উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেসব অতি উচ্চাভিলাষি নাদান তরুণ সেনা অফিসার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল, তারা অধিকাংশই মারা পড়েছে। তাদের সর্পরাজ্য প্রতিষ্ঠা হয় নাই।
বাংলাদেশে আরেকটি মৌসুম আছে। তার নাম রাজনৈতিক মৌসুম। এটা শুরু হয় অক্টোবর মাস থেকে, শেষ হয় মার্চ এপ্রিলে। এই সময়েই সকল রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। এমনকি গণআন্দোলনের মুখে সরকার পতনও হয়। যেমন, ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ সরকারের পতন, ১৯৯৬ সালে মার্চ মাসে খালেদা জিয়া সরকারের পতন। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণও গড়ে উঠেছিল ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাসেই। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মামলার রায় যদি ফেব্রুয়ারি মাসে না হয়ে জুলাই আগস্ট মাসে হতো, তাহলে হয়তো ওই রায়ের বিরুদ্ধে এমন গণজাগরণ নাও হতে পারতো। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছিল, এই রাজনৈতিক মৌসুমকে মাথায় রেখেই। কারণ তারা ভেবেছিল, এপ্রিল মাস থেকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, বাঙালি আন্দোলন করতে পারবে না।
উল্লেখ্য, এই সময়ে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডও বৃদ্ধি পায়। যেমন, ওয়াজ মাহফিল, ওরশ মোবারক, বিশ্ব এজতেমা ইত্যাদি। কারণ আবহাওয়া অনুকুল থাকে।
খুনের এবং রাজনৈতিক মৌসুমের কথা কেন বলছি? কারণ কয়েকদিন আগে ‘ফিশ আউট অফ ওয়াটার’ এ তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে খুনি পরিবার বলেছেন। জনাব তারেক রহমান আপনাকে বলছি, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯ বার সেনা বিদ্রোহ হয়েছিল। ২০তম বিদ্রোহে তিনি নিহত হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হবার আগে যে সব সেনা কর্মকর্তা (প্রায় ১৭০০ অফিসার) তার বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি হয়নি, তাদেরকে কোর্ট মার্শাল দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা কার সাহায্য নিয়ে করা হয়েছে? আপনি তারেক রহমান সেই মামলার এক নম্বর আসামি। তাহলে খুনি পরিবার কোনটি?
আপনি লন্ডনে বসে ভিডিও বক্তব্যের রাজনীতি চর্চা করছেন। এসবে খুব একটা ফায়দা হবে না। আপনি না জানতে পারেন, বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু জানে, রাজনীতি বীর পুরুষের কাজ, কোনো ভীরু, কাপুরুষ, দুর্নীতিগ্রস্ত, ষড়যন্ত্রকারীর নয়। ওয়ান-ইলেভেনের পরে জেল-জুলুম, প্রাণনাশের হুমকি উপেক্ষা করেই শেখ হাসিনা দেশে ফিরেছিলেন। কারণ তিনি শেখ মুজিবের কন্যা। কোনো অবৈধ সামরিক শাসকের কন্যা নন। বাংলাদেশের মানুষ জানে, আপনার দৌড় কতদূর? শেখ হাসিনার মতো সাহস আপনার নেই। আপনি পারবেন না, কারণ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে। এটা এখন ওপেন-সিক্রেট।
জামায়াত এখন যে ভয়ে মিছিল-মিটিং তো দূরের কথা, সরকার বিরোধী কোনো বিবৃতি পর্যন্ত দেয় না। সেই ভয়ে আপনিও বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকেন। ভাবছি, আপনার যদি সর্বোচ্চ শাস্তি হয়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে? তখন কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্দায় আপনাদের দুই ভাইয়ের স্ত্রী, জোবাইদা-শর্মিলাদের মেগা সিরিয়াল চলবে?
শাখাওয়াৎ নয়ন: কথাসাহিত্যিক, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউক্যাসল, অস্ট্রেলিয়া, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২০৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৪