ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রামকানাই দাশ ও আমাদের মুরগি-বাৎসল্য ।। ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৯, ২০১৪
রামকানাই দাশ ও আমাদের মুরগি-বাৎসল্য ।। ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ পণ্ডিত রামকানাই দাশ, জন্ম ১৯৩৫, মৃত্যু : ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪

একবার রামকানাই দাশের গান শুনে আমি কাঁদছিলাম। সেদিন কেন কেঁদেছিলাম জানি না।

তাঁর এক ভক্তিমতি পুরনো ছাত্রীও কাঁদছিলেন। কেন কেঁদেছিলেন সেটা হয়ত ছাত্রী জানতেন। ওই ছাত্রীর সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না বলে তাঁর কান্নার কারণ জানা হয়নি।

আমার এমন হয়। ভালো চিত্রকলা, ভালো চলচ্চিত্র কিংবা ভালো মানুষ দেখে; ভালো গান, ভালো গ্রন্থ, ভালো কথা শুনে আমার ভেতর কেমন হুহু করে, কেমন একটা কান্না কান্না বোধ হয়। কান্না বোধ হলেই মনে হয়, আমি ওই সূত্রে বিশুদ্ধ-পরিশুদ্ধ হয়ে উঠেছি।

ময়-মরুব্বিদের মধ্যে যাদের কথা শুনলে, যাদের গান শুনলে নিজেকে বিশুদ্ধ মনে হত তেমন একজন, আমার বিশল্যকারী বিষহরি, পণ্ডিত রামকানাই দাশ। বলা হয়ে থাকে, উপমহাদেশীয় সঙ্গীতের বিকাশ ও প্রসারে তার অবদান অর্ধশতাব্দির। আর এই রামকানাই দাশের রামকানাই হতে লেগেছে প্রায় আশি বছর। বাবা-মায়ের জীবনের কিছু সময়, মনোনিবেশ ও পরিশ্রম সেই হিসেবের মধ্যে ঢুকে গিয়ে সেটাকে অনায়াসে একশ করে তুলে। এই কথা বলছি এই কারণে যে, রামকানাই দাশের বাবা রসিকলাল দাশ ও মা দিব্যময়ী দাশের জীবনও ছিল লোকসঙ্গীতের। মূলত লোকসঙ্গীত নিয়ে রামকানাইয়ের একজীবন।

লোকসঙ্গীত নিয়ে তার বিশুদ্ধতার বোধ ও প্রজ্ঞা বিস্ময়কর। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও পুরাতনী গানেও তার জীবনের দিগন্ত প্রসারিত। বিনামূল্যে সঙ্গীতশিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের জীবনকেই সঙ্গীতময় করে তোলার চেষ্টা নিয়েছিলেন রামকানাই দাশ।

রামকানাই দাশের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের বহুল পরিচিত ‌‌রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা  গল্পটির কথা ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথের রামকানাই তার মৃত্যুপথযাত্রী দাদা গুরুচরণের কাছে জানতে চেয়েছিলেন উইলের বিষয়বস্তু। দাদা গুরুচরণ মরতে মরতে বলেছিলেন, যাবতীয় বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন আমার স্ত্রী বরদাসুন্দরী। উইলে কিন্তু দাদার এই অছিয়ত অনুযায়ী বরদাসুন্দরীর নাম না লিখে নিজের পুত্র নবদ্বীপের নামটা লিখতে পারতেন, দাদার তা দেখারও সামর্থ ছিল না, দাদার অছিয়তে আশাহত হলেও কিন্তু রামকানাই তা করেননি। এমনকি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় বরদাসুন্দরীর উইলের সত্যতা নিশ্চিত করেছিলেন সাক্ষ্য দিয়ে। নিজের স্ত্রী বা ছেলে কেউ তা মানতে পারেনি। আমাদের চারপাশে গুরুচরণ বা রামাকানাইয়ের সংখ্যা খুব কম এবং আরো কমছে দিনে দিনে। তবে রামকানাইয়ের স্ত্রী-পুত্রের সংখ্যা কিন্তু বাড়ছে প্রবল হারেই।

দুনিয়াতে খ্যাতি-বিখ্যাতির চটকদার এতকিছু থাকতে রামকানাইয়েরা কেন চুপচাপ গান গেয়ে গেয়ে চুপচাপ মরে যান? অর্থ-বিত্ত-যশ-সুখ-শান্তি নয়, শুধু গানবাজনায় রামকানাই দাশ কেন একটা দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে দেন? নেচেকুঁদে চটকদার গান গেয়েও তো ধরণী প্রকম্পিত করা যায়, মরার সময়ও তাহলে বেশ শোরগোল তোলা যায়, যায় না কি?আজকের দিনের নবদ্বীপ, নবদ্বীপের মা আর বরদাসুন্দরীদের কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই, তাদের কাছে রামকানাইদের জীবন একটা বাজে খরচার মতো ব্যাপার।

রামকানাই দাশের সঙ্গে আমার কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই। রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ আ ব ম নূরুল আনোয়ারের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে তার একটি কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ, কৃষি, ক্রিকেট ও জীবন যার একাকার হয়ে গেছে। তিনি বলতেন, ভাত খেলে পেট ভরে, শরীরের কাজে লাগে, কিন্তু তা জেনেও মানুষ খাদ্যের চেয়ে অখাদ্য বেশি খায়, ভাতের চেয়ে মুড়িমুড়কি আর চানাচুর বেশি পছন্দ করে। এই যুগের মানুষের দুধের চেয়ে মদ, সুখাদ্যের চেয়ে অখাদ্য, ভাতের চেয়ে মুড়মুড়কির প্রতি আকর্ষণ প্রতিদিনই বাড়ছে, তা বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবসায়িক ফন্দি ও উসকানিও আছে। আগ্রহ থাকলে উসকানি খুব কার্যকর হবে তা-ই স্বাভাবিক। রামকানাইরা আমাদের মুড়িমুড়কির জোগানদার নন, অন্নের ঠাকুর। মুড়িমুড়কির তাড়নায় আমরা তাদেরই চিনি না। জীবিত থাকতে তো চিনিই না, এমনকি মরলেও তাকে নিয়ে একটু কথাবার্তা হতে থাকলে প্রশ্ন করি, হ্যাঁ গা, উনি যেন কে ছিলেন?

লোকসঙ্গীতের সুলুক-সন্ধান ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চিরাচরিতে সুতৃপ্ত; বিনয়ী ও নিবেদিত রামকানাইকে যারা বিষয়-বাসনার জাগতিক স্বার্থের বিবেচনায় খারিজ করে দেন তারা আসলে কাদের ত্যাগে গড়া পৃথিবীতে দাপিয়ে বেড়ান তার হিসেব জানেন না।

রামকানাই দাশের মৃত্যু আমাদের ও মিডিয়ার কিঞ্চিত মনোযোগ পেয়েছে। আমাদের কোনো নগর-নর্তকী বা নটিনী মরলে তিনি তার চেয়ে বেশি মনোযোগ পেতেন নিশ্চয়ই? মিডিয়ায় আগে-পরে দুইদিনে রামকানাই দাশ ও সালমান শাহের শোক-স্মরণের আয়োজন তুলনামূলক বিবেচনা করলে তাই তো মনে হয়।

রামকানাই দাশেরা মরে গেলে আমরাও তো এমনই মনে করি। রামকানাই দাশ অনেক প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি হয়ত পেয়েছিলেন, কিন্তু তার জনসমাজে তার প্রসারটা ছিল না। এই যে তার প্রসার না থাকা, এই যে হাওয়াই মিঠাই খাওয়া সমাজ থেকে আমরা কবে বের হতে পারব। এই জনসমাজ আর কতদিন সেই শিশুটির অবস্থায় থাকবে যে শিশুর ৫ বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর শোকগ্রস্ত বাড়ির ভিড়ের মধ্যে বসে কাঁদছিল। কাঁদছিল তার ১০ বছর বয়সী বোনটিও। বোনকে কাঁদতে দেখে ৫ বছরের শিশুটি বলল, ‘বুবু, আমি তো কাঁদছি, আমার ফুটবলটা হারিয়ে গেছে বলে, তুমি কাঁদছ কেন?’

লেখক : সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক

বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।