ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নতুন অর্থনীতির জন্য শিক্ষা ।। ডেভিড এলস্টোন

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০১৪
নতুন অর্থনীতির জন্য শিক্ষা ।। ডেভিড এলস্টোন

জ্ঞান-বিজ্ঞানে আধুনিক বিশ্বের এগিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি হল শিক্ষা। কিন্তু এখনো বিশ্বের অনেক দেশেই আধুনিক শিক্ষার সর্বোচ্চ বিকাশ তো দূরে থাক শিক্ষার আলোই পৌঁছেনি।

কোনো কোনো অঞ্চলে নিরক্ষতা এখনো ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে।

আজ বিশ্ব সাক্ষরতা দিবস। ১৯৬৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর সব দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে জাতিসংঘের নেতৃত্বে দিবসটির সূচনা হয়। দিবসটি উপলক্ষে এই নিবন্ধে ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ার শিক্ষার পরিবেশ পর্যালোচনা করে কয়েকটি  দিক তুলে ধরা হবে।  

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে এগিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় মাইল ফলক ধরা হয় দুটি ঘটনাকে। একটি হল চাঁদে মানুষের গমন, অপরটি হল ‍কম্পিউটার আবিষ্কার।

১৯৬৫ সালে সাক্ষরতা দিবসের সূচনার মাত্র কয়েক বছর পর ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষের প্রথম অভিযানের ঘটনা ঘটে। চাঁদের যাওয়ার ঘটনার পর ৪৫ বছর হয়ে গেল। কিন্তু ভেবে দেখুন, দুটি বিষয় ছাড়া চাঁদে মানুষের গমন সম্ভব হত না। একটি হল রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা প্রশাসনের সমর্থন। কিংবা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়া এটি রীতিমত অসম্ভব ছিল। তার মানে এ ঘটনার সঙ্গে ঠিক এ দুটি বিষয় যেমন যুক্ত তেমনি শিক্ষার অগ্রগতির সঙ্গেও মূলত এ দুটি বিষয় যুক্ত।    

ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ার অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি কানাডার গণমাধ্যম সিবিসি’র তত্ত্বাবধানে শিক্ষা বিষয়ক ‘কোড কিডস’ নামের একটি ডকুমেন্টারিতে এই অভিজ্ঞতা উঠে আসে। তাতে ডেভিড এলস্টোন ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ার প্রধান ও প্রভাবশালী শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদানের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরেন।

ডেভিড এলস্টোন বলেন, ‘আমি এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ডর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে এসেছি। এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ডকে শিক্ষার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ হিসেবে আদর্শ মনে করা হয়। বিশেষত দেশ দুটির যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে শিশুদের সহজে ও আনন্দের সাথে শিক্ষা দিতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সেসব প্রতিষ্ঠানে আমি ঘুরে দেখেছি। ’  

গত বছর এলস্টোন ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়ায় সফর করেন। এই দুই দেশের বাস্তব শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার জন্য তিনি এ সফর করেন।

এ ধরনের প্রামাণ্য চিত্র তৈরিতে সাধারণত সবারই ধারণা থাকে, পাঠদানের যে বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা আছে তার শক্তিটা কি তা তুলে আনার চেষ্টা করা। মানে বাস্তবে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করে দেয়ার দক্ষতা ও সমন্বয় তৈরিতে প্রযুক্তির ব্যবহার একটি আধুনিক দক্ষতাগত বিষয়। তবে এলস্টোন জানান, প্রযুক্তি ব্যবহারের চাইতেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি তিনি ওই দেশদুটিতে দেখেছেন তা হল, শিক্ষাকে অপরের কাছে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি কেমন করে তৈরি হয়ে আছে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় তার প্রক্রিয়াটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

শিক্ষা বনাম পাঠদান পরিবেশ
ডেভিড এলস্টোনের প্রশ্ন, তাহলে তাদের পুরা শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন জিনিসটি মূলত এই অগ্রগতির প্রধান কারণ? তার মতে শিক্ষা বনাম পাঠদান কেন্দ্রিক পরিবেশই এর মূল কারণ।

একেবারে নীরব নয়, হালকা বা ‘মৃদু শব্দময় ক্লাসরুম’র ভঙ্গি ধারণ করেন সেখানকার শিক্ষকরা। যেখানে শিক্ষকরা হয়ে ওঠেন একজন কোচ। আর শিশুরা হয়ে যায় মূল বিষয়। মানে শিশুরাই মূল কাজটা করে ফেলবে আর কোচ শুধু দেখিয়ে দেবেন। সেকারণে দেখা যায়, শিশুরা স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে যাচ্ছে, পরের দিনের ক্লাসের পড়া পড়ছে, ক্লাসে এসে হাতে কলমে শিশুরা নিজেরাই নিজেদের কাজ করে ফেলছে। তবে অবশ্যই কাজটা করছে সহপাঠীদের সাথে নিয়ে।    
 
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্লাসে যেটা পড়া ছিল, বা সহায়ক ও প্রয়োজনীয় বিষয় ছিল সেটা এক শিক্ষার্থী অপর শিক্ষার্থীকে শেখায়।

শুধু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা তাদের বিষয় পড়ান। কিন্তু স্কুলগুলোতে ঠিক তা নয়। স্কুলগুলোতে থাকে শিক্ষার পরিপূর্ণ ভঙ্গি। স্কুলগুলোতে ছাত্র, শিক্ষক সবাইকে মিলে লিখতে হয়, পড়তে হয়, তৈরি করতে হয়, গড়তে হয়, ডিজাইন করতে হয়, প্লান করতে হয়, এমনকি ছাত্র-শিক্ষক মিলে খেলতেও হয়। সব কাজই সেখানে ছাত্র-শিক্ষার্থী মিলে করতে হয়। স্কুলগুলোতে শিক্ষার পদ্ধতিও বিশেষ ধরনের। বিশেষভাবে শুধু হাতে কলমেই নয়, শিশুদেরকে শিক্ষাটা তাদের স্মৃতিতে-মন মগজে একেবারে বসিয়ে দিতে হয়।
    
এস্তোনিয়ায় দেখা গেছে, সেখানকার শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে নতুন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এমনকি তাদের হাতে নানান রকম ডিভাইসও থাকে—যেগুলো তাদের প্রতিদিনের শিক্ষারই অংশ।  

প্রতিদিনই নিয়মিত তারা তাদের পড়ার মান মূল্যায়ন করে। তবে যখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন তারা এই মূল্যায়নটা আগের মত সাধারণভাবে করে না। অপরদিকে তাদের শিক্ষকরা যেমন বিশেষজ্ঞ তেমনি তাদের শিক্ষার্থীরাও জাতীয় পর্যায়ের, যেটা সর্বোচ্চ মানের।

শিক্ষার বিরাজনীতিকরণ
দুই দেশে বিশ বছরের মধ্যে সাবেক হওয়া তেরো জন শিক্ষামন্ত্রীর সাথে কথা বলেছেন ডেভিড এলস্টোন।

এই মন্ত্রীদের সাথে কথা বলার পর ডেভিড এলস্টোনের বক্তব্য হল, শিক্ষার বিরাজনীতিকরণ মানে দলীয় রাজনীতি থেকে শিক্ষাকে মুক্ত রাখা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ জরুরি বিষয়। এলস্টোন মনে করেন, পুরো স্কুল ব্যবস্থার কাজ হল তার পুরো কাজটার আয়োজন করা। উন্নত শিক্ষা বলতে যা বুঝায় স্কুলকে তাই করতে হয়। কিন্তু তার উপায় সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি নন এলস্টোন। তিনি মনে করে, শিক্ষায় বড় ধরনের পরিবর্তন হওয়া দরকার। আর সেটা করতে হবে একেবারে দিল খুলে।    

রাজনীতিবিদদের উপর খেদোক্তি করে এলস্টোন বলেন, রাজনীতিবিদরা শুধু দুইটা জিনিস বলতে পারেন, একটা হল, শিক্ষার ফলাফল, আর শিক্ষা নিয়ে বাজেট।

তবে এলস্টোন ভিন্ন কথাও বলেন, শিক্ষার অবকাঠামোগত এবং প্রক্রিয়াগত উন্নয়নে রাজনীতিবিদদের ইতিবাচক ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
শক্তিশালী সংস্কৃতিতে উৎসাহ

নতুন ক্ষমতায়নের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে নেতৃত্বের প্রয়োজন। এস্তোনিয়া ও ফিনল্যান্ডের অভিজ্ঞতা নিয়ে এলস্টোনের প্রস্তাব হল, শিক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, নতুন ধরনের স্কুল ব্যবস্থা গড়ে তোলা। আর এর জন্য জরুরি হল, বর্তমান স্কুল ব্যবস্থা থেকে শিক্ষকদেরকে বেরিয়ে আসা। নতুন ধরনের স্কুল ব্যবস্থা গড়ে উঠতে প্রয়োজন হল, নতুন ক্ষমতায়নের নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

নতুন শিক্ষাপদ্ধতি, পাঠ কারিকুলাম, প্রতিষ্ঠান প্রধান, নেতৃত্ব, প্রশিক্ষণ, বাজেট ও শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নতুন ধরনের স্কুল ব্যবস্থার সাথে জড়িত।  

যে শিক্ষকরা পাঠদানকেই শুধু ভালোবাসে
যে ক্লাসরুমে এমন একজন শিক্ষক থাকবেন যিনি তার বিষয়ে পাঠদানে শুধু পেশাদারই নন, খুবই উৎসাহী ও আবেগময় এবং তিনি যা জানেন তা অন্যদেরকে জানাতে অস্থির হয়ে থাকেন সেই ক্লাসের একজন হতে চায় না এমন শিক্ষার্থী সম্ভবত পাওয়া যাবে না।

পাঠদানে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা প্রদান
ষাটের দশক থেকেই পাঠদানে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। আগে নানা কারণে প্রযুক্তির প্রয়োজন এতটা না থাকলেও তবে বর্তমানে প্রযুক্তির পরিপূর্ণ সুবিধা অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুন দুনিয়া গড়ে তুলতে হলে পাঠদানে প্রযুক্তির ব্যবহার অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে প্রযুক্তি ব্যবহারের পদ্ধতি এবং তা ভালবাবে প্রয়োগের দক্ষতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একজন কাঠমিস্ত্রীকে যেমন জানতে হয় কিভাবে হাতুড়ি, হাতকরাত, রান্ধা, পালিশ মেশিন চালাতে হয়, তেমনি একজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকেও শিক্ষা ও পাঠদানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পদ্ধতি জানতে হবে।

ফিনল্যান্ডে দেখা যায়, স্কুলগুলোতে ক্লাসরুমে বিভিন্ন বিষয় পড়াতে ভিন্ন ভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। যা খুব অল্প সময়ে সহজে শিক্ষার্থীদেরকে শেখাতে সহায়তা করে। গণিত থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, ব্যাকরণ ইত্যাদি প্রায় সব বিষয়েই সর্বশেষ প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে।  

যে শিক্ষা নতুন অর্থনীতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তার স্বীকৃতি
বর্তমান দুর্নিয়ায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে শিক্ষাই হল প্রধান দিক। যে দেশে শিক্ষা যেমন হবে তার অর্থনৈতিক অবস্থাও তেমন হবে। একইভাবে সব ধরনের উন্নয়নের মূল কারণও হল আধুনিক শিক্ষা। সেকারণে শিশু শিক্ষার স্তর থেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাঠকে গুরুত্ব দিচ্ছেন এলস্টোন। অপরদিকে চলমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের পন্থা বের করার উপায়ও শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকবে বলে মনে করেন এলস্টোন।

জনসংখ্যা, সামাজিক বিকাশসহ ডলার ও মুদ্রা ব্যবস্থার নানান পরিবর্তনের কারণে নতুন অর্থনীতি জরুরি হয়ে পড়েছে। সে কারণে যে শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন ধরনের অর্থনীতির প্রতি গুরুত্বারোপ করে তাকে বেশি স্বীকৃতি দিতে হবে বলে মনে করেন এলস্টোন।  
 
বাবা-মা অভিভাবক ও বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি এখন এমনই অর্থনীতির দিকে। আগের তুলনায় শিশুরাও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। নতুন যে ‍দুনিয়া গড়ে উঠবে তার জন্য চলমান বিশ্ব সংকট মোকাবেলায় শিশু স্তরেই সেই সংকট মোকাবেলার বীজ বপন করতে হবে। আর এই বীজই নতুন অর্থনীতির দুনিয়া গড়ে তুলবে।    

সিবিসি অবলম্বনে শাহাদাৎ তৈয়ব

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।