'১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' নামের একটি বই লিখেছেন মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক ও ১নম্বর সেক্টর কমান্ডার এ কে খন্দকার। মুক্তিযুদ্ধকালে তার বীরত্বব্যঞ্জক ভূমিকার জন্য মানুষ তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
এ কে খন্দকারের বক্তব্যের পেছনে একটা ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’-এর গন্ধ পাচ্ছি আমরা; আমরা যারা মুক্তিযুদের পক্ষশক্তির মানুষ। সাধে কি আর বলে ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ!’---পর্বতশীর্ষে ধোঁয়া উড়তে দেখলে বুঝতে হয় যে সেখানে আগুন আছে। এ কে খন্দকারের বক্তব্যের পেছনেও অনেক কারণ আছে বলে অনুমান করি। নইলে নিজের প্রায়-অর্ধশতাব্দীকালের অবস্থান থেকে সরে এসে কেন তিনি হঠাৎই এমন ভোল পাল্টাবেন? যা তিনি কখনো বলেননি, লেখেননি---- আড্ডায়, বৈঠকে, স্মৃতিচারণে সাক্ষাৎকারে কখনোই--- এখন বলছেন সেরকমই; সবই এম্নি এম্নি? আমরা তা মনে করি না।
আমাদের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এখন চর্কিবাজির মতো ঘুরছে। ধরা যাক প্রশ্নগুলো এরকম: তিনি কিছু পেতে চেয়েছিলেন অথচ তা পাননি বলে? অথবা যা তার ছিল তা তিনি হারিয়েছেন বলে? তিনি কোনো কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে? নাকি তার বার্ধক্যজনিত স্মৃতিবিভ্রম (ডিমেনশিয়া) ঘটেছে? নাকি বড় কোনো চাপ তাকে বাধ্য করেছে বুড়ো বয়সে নিজের আপন কাণ্ডজ্ঞানের মাথা খেয়ে ইতিহাসের জমিনে ময়লা ছিটাতে?
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের দিন একে খন্দকার রেসকোর্স ময়দানের জমায়েতে ছিলেন না---তিনি নিজেই তার বইতে একথা স্বীকার করেছেন। তিনি প্রত্যক্ষ করেননি সেই ঐতিহাসিক মহা-মুহূর্তটি। তাহলে প্রত্যক্ষদর্শী ও উপস্থিত শ্রোতা না হয়েও তিনি কি করে বলে দিলেন এমন কথা? বঙ্গবন্ধুর সেই ‘এবারেরর সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ যাদু বক্তব্যটি তিনি অন্য অনেক সামরিক আমলার মতোই শুনেছিলেন ব্যারাকে বা ঘরে বসে। অথচ যারা সেদিন মঞ্চে ছিলেন, যারা বেতারে–টিভিতে ভাষণটি সম্প্রচার করেছিলেন, যারা সাংবাদিক হিসেবে পত্রপত্রিকাতে কাভার করেছিলেন এবং যারা জীবনে বহুবার-বহুবার শুনেছেন ভাষণটি তারা কেউ বঙ্গবন্ধুর মুখে এমনতরো কথা (‘জিয়ে পাকিস্তান’) ঘূণাক্ষরেও শোনেননি।
এমনকি যারা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দোসর, যারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল, যারা হত্যা-লুণ্ঠন, ধর্ষণে মেতেছিল, যারা ছিল রাজাকার-আল বদর আল শামস-শান্তি কমিটি বা ইসলামী ছাত্রসেনার সদস্য ও নেতা, তারাও যা শোনেনি কস্মিনকালে, একে খন্দকার তা কী করে শুনলেন? অঘটনঘটনপটিয়স তৃতীয় কর্ণটি তিনি তাহলে কোথায় পেলেন---যা তাকে কোটি কানে অশ্রুত কথাও শোনায়?
বঙ্গব্ন্ধু যদি তা বলতেনই এহেন কথা তাহলে ওইসব নরপিশাচের দল কি খুশিতে বগল বাজাতো না? সে রকম কপাল ওদের হয়নি। অথচ হয়েছে কিনা এমন একজনের, যিনি নিজে একাত্তরের রণাঙ্গণের অন্যতম সেনাপতি। এজন্যেই বলা হয়, ‘‘রাজাকার সব সময়ই রাজাকার, মুক্তিযোদ্ধা সব সময় মুক্তিযোদ্ধা নাও থাকতে পারেন’’---এ কে খন্দকার প্রমাণ করলেন এই আপ্ত বাক্যটির যথার্থতা।
স্বাধীনতার পর গত চার দশকের বাংলাদেশের দিকে পিছে ফিরে তাকালে উপরের উক্তির সত্যতা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। এই দীর্ঘ সময়ে কতো মুক্তিযোদ্ধাকে যে রাজাকারের দলে ভিড়ে যেতে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই। বঙ্গবন্ধুকে সুপ্রিমো মেনে তার ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে আমরা কি কি করতে দেখেছি মনে নেই? সেক্টর কমান্ডার জিয়া সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর ডালিম-ফারুক-রশীদদের মতো খুনিদের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করে। খুনিদের রাষ্ট্রদূতও বানিয়েছিলেন জিয়া। গোলাম আজমের মতো রাজাকারকূলশিরোমণিকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জিয়া। রাজারদের নেতা শাহ আজিজকে জিয়া ডেকে এনে প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন। তাই আমরা আর বলবো না : ‘‘সত্যি সেলুকাস! কী বিচিত্র এদেশ’’!
এসব আমরা ঢের দেখেছি! এতোদিন যে মুখোশে নিজের আসল চেহারা ঢেকে রেখেছিলেন একে খন্দকার এবার তা বেরিয়ে পড়লো! দু:খ একটাই মুখোশটা ছিল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের, মুখোশের ভেতর থেকে বের হলো অন্য এক কদর্য মুখ।
বাংলাদেশ এভাবেই হয়ে উঠেছে এক মুখোশের দেশ। কাণ্ডজ্ঞান, বিবেক, শাশ্বত মূল্যবোধ, শুভবোধ আর নৈতিকতা বনবাসে যাচ্ছে। আর এসবের পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা ক্রিয়াশীল দেখেছি অর্থ ও ক্ষমতার মোহ। আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণের লোভে পড়ে নিজের অতীত গৌরব ও বীরত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে কতো মুক্তিযোদ্ধাকেই তো আমরা দেখলাম রাজাকারের সাথে এক পঙ্ক্তিতে বসতে, একই সুরে কথা বলতে।
নাট্যকার ও শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নামের একটা নাটক আছে। সেখানে একটা সংলাপ: ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়’। কেউ কেউ এভাবেই বদলে যান, সম্মানের বেদি থেকে নিজেকেই টেনে নামান ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে; দুদিনের জাগতিক মোহে বীরত্বের গৌরব ছুড়ে ফেলেন নর্দমায়। আর কোনো কোনো মতলববাজ পত্রিকা ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ বলে স্লোগান হাঁকে। মজার ব্যাপার বিতর্কিত অই পত্রিকারই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বের করেছে এ কে খন্দকারের এই বই। ‘দুইয়ে–দুইয়ে চার’ হিসাব মেলাতে আর কষ্ট হয় না আমাদের। এই পত্রিকাই গণজাগরণ মঞ্চ নিয়ে অশ্লীল গল্প লিখিয়েছিল হাসনাত আব্দুল হাই নামের সাবেক এক আমলাকে দিয়ে। পরে গল্পটি প্রত্যাহারও করতে বাধ্য হয় তারা। ‘হাই’ সাহেবও দেশবাসীর কাছে ‘লো’ হয়ে, ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন। কিন্তু লেখক হাসনাত সাহেবের অপমৃত্যুটাও ঘটে যায় ওই গল্পের সাথে সাথেই। ‘অতি লোভে (খ্যাতিলোভে) তাঁতী নষ্ট’ নাকি একেই বলে!
পরাজিত পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণকারী জেনারেল নিয়াজির প্রেস সেক্রেটারি সিদ্দিক সালিক পর্যন্ত 'উইটনেস টু সারেন্ডার' (Witness to Surrender) বইয়ে কবুল করেছেন (কম দু:খে কি আর কবুল করে!) ‘...The Shiekh proclaimed East Pakistan the Peoples Republic of Bangladesh.'’ আমাদের প্রশ্ন, এই প্রোক্লেমেশনটা বঙ্গবন্ধু তাহলে কোথায় কখন দিয়েছিলেন? আর যে ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ‘শত্রু’ বলে ঘোষণা করলেন, যাদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালিকে অস্ত্র হাতে তুলে নেবার নির্দেশ দিলেন, পাকিস্তান নামের বর্বর রাষ্ট্রযন্ত্রের সব কলকব্জা বন্ধ করে দিয়ে সারা পূর্ববাংলা অচল করে দেবার ডাক দিলেন, সেই বঙ্গবন্ধু ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলবেন? মানুষের স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান বলেও তো কিছু থাকে! একই ভাষণে তিনি পাকিস্তানকে বলবেন ‘শত্রু’ আবার ভাষণশেষে বলবেন ‘জিয়ে পাকিস্তান’?
তিনি কিছু (মন্ত্রিত্ব)পেতে চেয়েছিলেন অথচ তা পাননি বলে, অথবা যা তার ছিল (মন্ত্রিত্ব) তা তিনি হারিয়েছেন বলে এসব করেছেন---এমন সন্দেহ কি উড়িয়ে দেবো আমরা? মুক্তিযুদ্ধের আরেক সেক্টর কমাণ্ডার, ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’(A TALE OF MILLIONS) গ্রন্থের লেখক মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের ব্যক্তিত্ব, বক্তব্য ও সততা কখনোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। সেই রফিকুল ইসলাম মনে করেন, কোনো এক মহলের চাপে এ কে খন্দকার এসব লিখেছেন। তিনি তার দীর্ঘদিনের সুহৃদ এ কে খন্দকার সম্বন্ধে আরো যা যা বলেছেন তা আমাদের রীতিমতো ভাবিত-চিন্তিত করে। চাঁদপুরে এক অনুষ্ঠানে রফিকুল ইসলাম এ কে খন্দকারের সুবিধাবাদী চরিত্রের কথা তার তুলে ধরেছেন এভাবে:
‘‘১৯৭৫ সনের পর মোশতাক সাহেবের সঙ্গে শপথ, এইচ এম এরশাদের সরকারের মন্ত্রীত্ব, আওয়ামী লীগের আমলে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। তখনও তিনি এমন তথ্য বলেননি। এখন তিনি নতুন রুপে আবিষ্কার হলেন কেন? আমি দেশ স্বাধীনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। এখন স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্বও আমার। আর তা রক্ষা করা কঠিন। খন্দকার সাহেবের এই লেখা আর্ন্তজাতিক চক্রান্ত। ’’
মেজর রফিকের শেষ কথাটা খুবই উদ্বেগের। ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ কখনোই আমাদের জাতির পিছু ছাড়েনি। খন্দকার সাহেবও কি এরকমই কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ?
মেজর রফিক এ কে খন্দকারকে চ্যালেঞ্জও ছুড়েছেন: ‘এ কে খন্দকার সাহেব এই তথ্য কোথায়, কিভাবে পেলেন দ্রুত জবাব দেন? আপনার সঙ্গে জীবনে চলারপথে ২শ থেকে আড়াইশ বার বৈঠকে বসেছি। কখনও এ সব শুনিনি। নিশ্চয় টালমাটাল হয়ে এসব লিখেছেন। আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের মন্ত্রিত্বে রাখলে তিনি এসব বিভ্রান্তি ছড়াতেন না। কেউ না কেউ তাকে প্ররোচনা দিয়েছেন। অন্য কারো ইচ্ছায় তিনি জাতির পিতাকে ছোট করার জন্য এটা করেছেন। ’
আবুল মনসুর আহমদকে আর যাই হোক বঙ্গবন্ধুর ভক্তদের দলে ফেলা যায় না। তিনিও তার ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইয়ে লিখেছেন “এদিন মুজিব তাহার বক্তব্য শেষ করিলেন জয়বাংলা বলিয়া”।
সাংবাদিক আবেদ খানও মনে করেন: ‘এই বয়োবৃদ্ধ সেক্টর কমান্ডার কোনোভাবে বিভ্রান্ত হয়েছেন, কোনোভাবে প্রতারিত হয়েছেন, কোনোভাবে প্ররোচিত হয়েছেন। ’
পাশাপাশি আমাদের তিনি স্মরণ করিয়ে দেন: ‘অনেক বীর উত্তম কোনো না কোনোভাবে জামায়াতের হাতে ক্রীড়ণক হয়ে গেছেন। ...মন্ত্রি থাকাকালে তিনি কি এমন বলতেন’—এই প্রশ্নটা এখন মানুষ করতেই পারে তাকে। কিন্তু জবাব কি আছে তার? এ কে খন্দকারকেও তাই আমরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখতে পারি না।
এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার সেক্টর কমান্ডারস ফোরামেরও চেয়ারম্যান। তো তার নেতৃত্বাধীন ফোরামও তাকে দ্রতিতম সময়ের মধ্যে তার মিথ্যা থেকে সরে আসতে বলেছে: ‘সদ্য প্রকাশিত ‘১৯৭১: ভেতরে বাইরে’ বইটি একান্তভাবেই তার নিজস্ব, যার বক্তব্য ও মন্তব্যের সাথে ফোরামের নীতি, আদর্শ ও ঐতিহাসিক সত্য উপলব্ধির মিল নেই। ’
আর তিনিও নামকাওয়াস্তে বিবৃতি দিয়ে নিজের বক্তব্যের যে সংশোধনী দিয়েছেন সেটাও বেশ হাস্যকর। মানে কথা একই, তবে কিনা তা একটু ঘুরিয়ে বলা! মানেটা দাঁড়ায়, ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়!’
যাহোক, ইতিহাস কল্পনা বা অধ্যাস নয়...ইতিহাসের গায়ে মিথ্যার জোয়াল চাপালে সেই জোয়ালের নিচে চাপা পড়তে হয়। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী এ কে খন্দকার জীবনে যতো সুনাম ও খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন, তা যে আজ কর্পূরের মতো উবে যেতে বসেছে সেটা তিনি নিজে টের পাচ্ছেন হয়তো। কিন্তু এরই মধ্যে যে অনেক দেরি হয়ে গেছে তার। যা তিনি হারালেন তা কি আর ফিরে পাবেন? কিছু জিনিস একবার গেলে আর যে ফিরে আসে না! উচ্চারিত কথা আর ছুড়ে দেওয়া তীরও ফিরে আসে না আর! শয়তান মেফিস্টোফিলিসের কাছে আত্মা বিক্রি করে সাময়িক লাভ হয়তো মেলে কিন্তু মেফিস্টোফিলিসের হাত থেকে নিজের লাঞ্ছিত আত্মার মুক্তি যে আর মেলে না! জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি কি নিজেকে খুব নীচু স্বরে বিড়বিড় করে বলবেন, সব ঝুট হ্যায়! ষোল আনাই মিছে। জীবনের সব গৌরবগাথা যিনি নিজেই এক ফুৎকারে নিভিয়ে ফেলেন তার নাম পতিত নায়ক।
** ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ কে খন্দকারের নামে মামলা
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৪