‘দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজকে সংশোধন করা এবং সবচেয়ে সহজ কাজ হচ্ছে অন্যের সমালোচনা করা [হযরত আলী (রাঃ)]’ এই মহামূল্যবান উদ্ধৃতাংশটুকু আমাদের জীবনের নিরিখে নানাভাবে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সামাজিক প্রক্ষাপটে এটা স্পষ্ট যে আমরা নিজেরা যা করতে পারি না অন্যদের তা করতে উপদেশ দিতে পারি।
প্রবাসে বাংলা ভাষার প্রসার নিয়ে লেখার শুরুতেই হোঁচট খেতে হলো... মনে প্রশ্ন এলো, খোদ বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রসারইবা কতটুকু হয়েছে। বায়ান্নের পর থেকে ৬২ বছর গত হয়েছে, কিন্তু আজো জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। এখনো উচ্চ আদালতের নির্দেশনার মাধ্যমে দেশে বাংলা প্রচলনের দাবি আদায়ের প্রচেষ্টা নিতে হয়। এখনো দেশে বিদেশি চরেরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিতে তৎপর।
সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বেরই অংশ, তা সত্ত্বেও বর্তমান সময়ে এ দায়িত্ব পালনে স্থান, কাল ও পাত্র নির্বিশেষে এ পেশা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ দায়িত্বটুকু পালন করতে গিয়ে দেশে অনেক সাংবাদিককেই অকাতরে প্রাণ দিতে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে।
![](files/September_2014/September_13/Bangla_inner_2_583408008.jpg)
[গত একুশে ফেব্রুয়ারি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকুইনে বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড এথনিক সোসাইটি আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভাষা শহীদদের স্মরণে মৌন শ্রদ্ধা: বাঁ দিক থেকে সহযোগী মন্ত্রীনরেশ বারদওয়াজ, সোহেল কাদরী এমএলএ, সিটি কাউন্সিলর অমরজিত সুহি, ড. রীক লুইস, রাজশাহীর অন্যতম ভাষা সৈনিক মো. সিদ্দিক হুসাইন, ড. হাফিজুর রহমান, ড. নূরুল ইসলাম, সহিদ হাসান ও লেখক]
কানাডায় প্রবাসী সম্প্রদায়ের একজন নগণ্য প্রতিনিধি হিসেবে আমি বা আমার মতো যারা রয়েছেন তাদের ব্যর্থতাগুলো প্রথমে আলোকপাত করবো এবং এগুলো সংশোধনে সাংগঠনিক প্রচেষ্টার কিছু ইতিবৃত্ত তুলে ধরবো।
এডমনটনস্থ বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব অব আলবার্টা এর সভাপতি এবং মাহিনুর জাহিদ মেমোরিয়েল ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে গত এক বছরেরও অধিক সময় বাংলাদেশ ও কানাডীয়ান কমিউনিটির মূলধারার লোকদের নিয়ে নিবিড়ভাবে কিছু কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে উর্দ্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবে আমাদের মতো সংগঠনগুলোর সাধ ও সামর্থ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে সর্বাংশে সফল কিছু করার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এ বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে কানাডার এডমনটনে বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা, বাংলাদেশ কানাডা অ্যাসোসিয়েশন অব এডমন্টন, আলবার্টা বিশ্ববিদ্য্যালয়ের বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও অন্যন্য বাংলাদেশি সংগঠনগুলো নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলো।
কানাডার সন্মানিত প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হারপার, পিসি, এমপি, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ হেরিটেজ অ্যান্ড এথনিক সোসাইটি অব আলবার্টা’র কাছে একটি শুভেচ্ছাবার্তাও পাঠিয়ে ছিলেন। এছাড়াও আলবার্টা প্রদেশের তৎকালীন প্রিমিয়ার এলিসন রেডফোর্ড কিউসি, স্পিকার জেনে জুঝডেস্কি, কালচারাল মিনিস্টার হেদার ক্লিমচুক, সহযোগী মন্ত্রী নরেশ বারদওয়াজ, সোহেল কাদরী এমএলএ এবং ইউনিভার্সিটি অব ম্যাকুইনের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ডব্লিউ এটকিনশন, সিটি মেয়র জন ইভেশন দিবসটির উপর গুরুত্বারূপ করে বার্তা পাঠিয়েছেন, অর্থাৎ কানাডার সরকার প্রধান থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতারা পর্যন্ত প্রায় সবাইকে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মূলভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি।
সে সভায় কিশোর মির্জা নাবিদ আলম মাতৃভাষা শেখার নিরন্তর সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার উপর আলোকপাত করে হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য রাখেন এবং ভিন্ন ভাষাভাসী অভিভাবকদের তাদের শিশুদের কষ্টের বিষয়ে অতীব যত্নশীল হওয়ার পরামর্শ দেন ও আবেদন জানান। শিল্পী নাতাশার মোহনীয় সুরঅনুষ্ঠান উপস্থিত সবাইকে মুগ্ধ করেছিলো।
![](files/September_2014/September_13/Bangla_inner_1_787637569.jpg)
কানাডার প্রধানমন্ত্রী তার মূল্যবান এক বাণীতে বলেছিলেন যে, ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে- যা একটা বহুভাষাবাদ এবং বহু সংস্কৃতি প্রচারের উপলক্ষ। আমাদের অসাধারণ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে এ দিবসটি উদযাপন কানাডার জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়াও আমাদের দুটি দাপ্তরিক ভাষা এবং প্রথম জাতিসমূহ ও লাখ লাখ কানাডীয়ান গর্বিতভাবে দেশীয় ভাষা তাদের বাড়ি ও কমিউনিটিতে সংরক্ষণ করে। আমি কানাডায় বাংলাদেশ কমিউনিটির একুশে ফেব্রুয়ারি ছাড়াও ৪৩তম স্বাধীনতাবার্ষিকী পালন উপলক্ষে আপনাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং কানাডায় বহুজাতিক সমাজে আপনাদের অনবদ্য অবদানের জন্য কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
প্রবাসে বাংলা ভাষার প্রসারে প্রত্যেকটি বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে এখনই সুনির্দ্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সরকারের বাস্তবমুখী কোন গাইডলাইন বা নির্দেশনা আপাততঃ চোখে পড়ছে না, নেই সংগঠনগুলোর তেমন কোন সমন্বিত ও ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক প্রয়াস। তবে বিছিন্নভাবে আলবার্টায় বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দেয়ার কাজ শুরু হয়েছে,কিছু কিছু গবেষণা ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে। বাংলাদেশ হেরিটেজ সোসাইটি সংগঠন হিসেবে সীমিত পরিসরে হলেও কিছু কাজে সহায়তা শুরু করেছে। শিশুদের প্রাক স্কুল এর অভিজ্ঞতা এবং আচরণ, প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রকল্পের গবেষণায় অংশগ্রহণ করছে (প্রাক স্কুল-থেকে ২য় শ্রেণি) বাংলাদেশি কিছু শিশু কিশোর. ড. ওইন্ডি হুগলুন্ড, আলবার্টা বিশ্ববিদ্য্যালয় হতে পরিবার ও শিশুদের ১ম বছরগুলোর অভিজ্ঞতার উপর এবিসি হেডস্টার্ট এর সঙ্গে কাজ করছেন। এ গবেষণা পিতামাতা, শিক্ষাবিদ ও এবিসি হেডস্টার্ট এ অংশগ্রহণকারী পরিবার ও শিশুদের অভিজ্ঞতাগুলো ভালভাবে জানতে পারবে। এ ব্যাপারে মনোবিজ্ঞান বিভাগ, আলবার্টা বিশ্ববিদ্য্যালয়কে সহায়তার স্বীকৃতিস্বরূপ এ পত্র দিয়েছেবিশ্ববিদ্যালয়।
![](files/September_2014/September_13/Bangla_inner_113352666.jpg)
কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বহুভাষাবাদ এবং বহু সংস্কৃতি প্রচারের উপলক্ষ হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে উল্লেখ করার বিশেষ তাৎপর্য্য রয়েছে। ৪ নভেম্বর ১৯৬৪ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা,বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কো'র আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সহযোগিতার মূলনীতিকে কানাডা মেনে চলে। মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক সংহতির ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এদেশের আইন কানুন। সংবিধান ছাড়াও সংস্কৃতির ব্যাপক আশ্লেষ, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা এবং শান্তি, মানবতার শিক্ষা, মানুষের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা করা, সন্মান প্রদর্শনের অপরিহার্যতাকে তুলে ধরাসহ সমস্ত জাতির পারস্পরিক সহায়তা ও উদ্বেগের উপর গুরুত্বারূপ করা হয় এখানে। প্রতিটি সংস্কৃতির প্রতি সম্মান, তা সংরক্ষণ ও এর মর্যাদাকে মূল্য দেয়া, মানুষ এর সংস্কৃতির বিকাশে প্রবাসে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্ব সৃষ্টির জন্য দেশ ও জাতি হিসেবে আমরা কতটা প্রস্তুত।
আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধ বৈচিত্র্য, এসব বৈচিত্র্যের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে নানা বিষয়ে সংঘাতমুখিনতা রয়েছে যার কারণে সমন্বিত যে কোন উদ্যোগ দেশে-বিদেশে কখনো কখনো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। সংস্কৃতি বিকাশের বাধার সাথে এখন দেশে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস ও সহিংসতা। বাঙালির বহুভাষাবাদ এবং বহুসংস্কৃতির বিষয়ে ২১ এপ্রিল ২০০২ সালে লেখকের একটি সাক্ষাতকার স্পেনের প্রাচীনতম সংবাদপত্র ডিয়ারিওডেপন্টেভেডরায় ছাপা হয়। যাতে মুসলিম সংস্কৃতির বিপত্তি নিয়ে কিছু পর্যেবক্ষণ তুলে ধরা হয়।
প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রসারে সরকার ও আমাদের ব্যর্থতাগুলোকে চিহ্নিত করে এখনি নানাবিদ উদ্যোগ নেয়া উচিত। সমন্বিত প্রয়াসই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রবাসে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। জাতির প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং মানবজাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক অগ্রগতির মধ্যে একটি সুরেলা ভারসাম্য স্থাপন করা,সে হিসেবে যথাসম্ভব একযোগে সংস্কৃতির দিকে বিভিন্ন শাখা এবং এগুলো বিকাশের উদ্যোগ নিতে হবে।
সাংস্কৃতিক সহযোগিতা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত মেধা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সকল বৈশিষ্ট্য অবারিত করতে দূতাবাস ও কমিউনিটির মধ্যে লিয়োজো প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন,
দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক বিভিন্ন ফর্ম, আন্তর্জাতিক, সাংস্কৃতিক সহযোগিতার লক্ষ্যে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতে হবে।
প্রবাসে ভাষাজ্ঞান ছড়িয়ে প্রতিভা উদ্দীপিত ও সংস্কৃতির সমৃদ্ধি সাধন করতে হবে;
জনগণের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক এবং বন্ধুত্বের বিকাশ ও জীবনের একে অপরের ভাব ভাল করে বুঝতে সমর্থ হওয়ার প্রয়াসে দলীয় রাজনীতির চর্চাকে পরিশিলিত করতে হবে।
বাংলাদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে একটি সার্বজনীন নীতি থাকা আবশ্যক; সবাই জ্ঞানলাভে প্রবেশাধিকারের জন্য, সক্রিয়, সব মানুষেরচারু ও সাহিত্য ভোগ, দেশে বিদেশে বিজ্ঞানের তৈরি অগ্রগতি ভাগ করে এবং সাংস্কৃতিক জীবনের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখে; সব মানুষের আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত জীবনযাত্রাকে বাড়াতে আমাদের নিজ বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিকে প্রবাসে সক্রিয়ভাবে তুলে ধরতে হবে।
দেলোয়ার জাহিদ: প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময়: ১৭১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৪