ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

যুদ্ধের নামে ওবামা কী করছেন

এমি ডেভিডসন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭, ২০১৪
যুদ্ধের নামে ওবামা কী করছেন

১৯৫০ সালের ২৯ জুন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৩তম সাবেক প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে এক রিপোর্টার বলেছিলেন, ‘মি. প্রেসিডেন্ট, এই দেশের সবারই একটা প্রশ্ন—আমরা কি যুদ্ধের মধ্যে আছি না নাই?

সে সময় এই প্রশ্ন খুবই যৌক্তিক ছিল। কারণ এর দুদিন আগে খুব তাড়াহুড়া করে উত্তর কোরিয়ার মোকাবিলায় সেনা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র।

আকস্মিকভাবে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী সামনে আগায় যায়। এতে করে তখন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান দক্ষিণ কোরিয়ায় সেনা পাঠানোর তড়িঘড়ি আদেশ দেন।

ট্রুম্যান সাংবাদিকদের একটা জবাবও দেন। তবে তার জবাব হুবহু প্রকাশ করা হবে কিনা এ ব্যাপারেও তারা প্রেসিডেন্টের বক্তব্য জানতে চান। ওই সময় এ
ঘটনার বরাত দিয়ে ‘টাইম’ লিখেছে, ‘প্রধান নির্বাহী (প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান) জবাবে বলেছেন, তার উদ্ধৃতিগুলো হুবহু তুলে দিতে তিনি অনুমোদন দেবেন। ’ অবশ্য তখন অপর এক রিপোর্টার বলেছিলেন, যদি ‘পুলিশি অ্যাকশনে যুক্তরাষ্ট’ লেখা হয়, তবে এ বাক্য হবে আরো বেশি উপযুক্ত। কারণ ট্রুম্যান ঠিক এ কথাটাই বলেছিলেন। ট্রুম্যান এ কথা শুধু বলেনইনি। বরং দেখা গেল, উত্তর কোরিয়ায় হামলার জন্য মার্কিন সেনা পাঠানোর বিরোধিতাকারী বিভিন্ন বিক্ষোভ আন্দোলন দমনে অন্তত তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবলভাবে এই পুলিশি অ্যাকশন জারি ছিল।    

শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। যেটা হল, দক্ষিণ কোরিয়ায় সেই যে মার্কিন সেনা গেল, তারা আর দেশে ফিরে এলো না। এখনও সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী রয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে— যে প্রেসিডেন্টরা যুদ্ধের ডাক দিতে চায় না— তাদের অবসান ঘটল।  

বুধবার রাতে হোয়াইট হাউস থেকে এক টেলিভিশন ভাষণে ট্রুম্যানের কথাটাই একটু কৌশল করে অন্যভাবে বলেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড আল শাম কিংবা ‘আইসিসকে কিভাবে চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে দেয়া যায়’ সেই কথাটা তিনি একটু ঘুরিয়ে বললেন। ওবামা বললেন, ‘আমরা তো আবার আরেকটি স্থলযুদ্ধে যেতে পারব না। ’ তো তিনি স্থলযুদ্ধে গেলেন না, গেলেন আকাশযুদ্ধে। তার কথা তো ঠিকই, তিনি তো বলেননি যে, তিনি আর যুদ্ধে যাবেন না। বলেছেন স্থলযুদ্ধে যাবেন না। এখানে কিন্তু তার পরিকল্পনা বিশাল। শুধু এক দেশই না। একসঙ্গে দুইদেশে বিমান হামলা চালানো হবে— ইরাক এবং সিরিয়া।  

ইতিমধ্যে ইরাকে বহুজাতিক জোটবাহিনীসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পাঁচশ’ সেনার একটি ছোট্ট বাহিনী রয়েছে। ওবামা বলেছেন, এই বাহিনী ‘তারা কোনো ধরনের স্থল অভিযানে যাবে না। ’ তবে তারা ‘সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাবেন। ’    

প্রেসিডেন্টের কথা অনুযায়ী মনে হচ্ছে, এই প্রচারণা খুব ভালভাবেই জমে উঠবে। ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবে। তিনি অবশ্য আইসিস নিয়ে এই সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। ‘আইসিস একটি ক্ষুদ্র হত্যাকারী গ্রুপ’ বলে তিনি এই প্রচারণা শুরু করেছেন।

নিঃসন্দেহে তারা হত্যাকারী। তারা উত্তর ইরাক ও সিরিয়ায় এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এমনকি তারা দুই মার্কিন সাংবাদিককে শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করেছে।
তবে এই ‘ক্ষুদ্র’ কথাটার মধ্যেই কিন্তু রয়ে গেছে বিষয়পা। যেখানে এরকম একটি বাহিনীর বিশ হাজারেরও বেশি যোদ্ধা রয়েছে তাদেরকে বলা হল ক্ষুদ্র গ্রুপ। এতে খুবই কম বলা হল। অথচ এরইমধ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীকে আবারো ইরাকে জড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ওবামা। আইসিস যে হুমকি দিয়েছে সেটা একেবারে ‘ইউনিক’। এই যুক্তি দেখিয়ে এখন তিনি ইরাকে পুনরায় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি জোর দিয়ে বলছেন, নতুন কোনো কৌশলই বাস্তবে এতটা উদার কাজ হয় না। এধরনের অভিযানই আমাদের নিত্যদিনের নিয়মিত কাজ হয়ে গেছে। তার বক্তব্য হল, ‘আমরা তো সফলভাবেই ইয়েমেন ও সোমালিয়ায় বছরের পর বছর এই কাজটাই করে যেতে পেরেছি। ’  

ওবামার যুক্তি অনুযায়ী পুরো ব্যাপারটার সঙ্গে শুধু সেনাবাহিনী জড়িত কিন্তু জনগণ জড়িত না। এরকম একটা যুক্তির প্রস্তাবকে আমরা ‘জনবিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনী’ বলে নাম দিতে পারি। ওবামা হামলা চালানোর যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে এই নামই হয়। যুদ্ধের ক্ষমতা বিষয়ক প্রস্তাবের বিধান অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু করার ছয় দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্টের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন জরুরি।

কংগ্রেসকে ওবামা এই প্রস্তাবে সমর্থন দেয়ার আহবানও জানিয়েছেন। আহবান জানিয়েছেন, আবার কংগ্রেসের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে যুদ্ধ শুরু করার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুমোদন জরুরি নয় বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘এই হুমকি মোকাবেলায় আমারই ক্ষমতা আছে। ’

আবার এরমধ্যে যুদ্ধ শুরু করার জন্য তিনি ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ এবং ‘আমাদের জনগণকে রক্ষার’ অজুহাতও তুলেছেন। এরকম একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তার এই বক্তব্য ভালই বটে। কিন্তু এই ‘জাতীয় নিরাপত্তা’কে ব্যাপকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হলে তাকে অবশ্যই কংগ্রেসের ভূমিকা অনুসরণ করতে হবে। যে ভূমিকা নিশ্চয়ই আমেরিকানদেরকে হুমকি ও ঝুঁকির মুখোমুখি করবে না।  

কিন্তু আমরা একেবারেই নিশ্চিত না যে, কারা আসলে জনগণ। সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর সুন্নিদের মতো আমাদের মিত্ররা যখন আইসিসকে টাকা দিচ্ছে, অস্ত্র দিচ্ছে তখন তাদেরকে আমরা কি জনগণ বলব? এর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের বিষয়টিও হিসাবনিকাশে রাখতে হবে। এসব নিছকই দলীয় প্রশ্ন না, বরং রাজনৈতিক প্রশ্ন।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর হোয়াইট হাউস একটি প্রস্তাব আনে। তাতে সামরিকবাহিনীকে ব্যবহারের অনুমোদনের বিষয়টি পাশ হয়, যেটা এখন পর্যন্ত বহাল আছে। কিন্তু এই পাশের নামে সামরিক বাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য হয়ে উঠেছে আল কায়েদা এবং তার মিত্র গ্রুপগুলো। আইসিস একসময় আল কায়েদা সমর্থিত বাহিনী ছিল। কিন্তু এখন তারা বিচ্ছিন্ন।

২০০২ সালেও ইরাকে হামলার অনুমোদন ছিল। কিন্তু সিরিয়া ঠিক ইরাক না। সিরিয়ায় যেখানে কয়েক বছরের গৃহযুদ্ধে কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। উদ্বাস্তু ও শরণার্থী হয়েছে লাখ লাখ নিরীহ সাধারণ মানুষ। তাহলে কিভাবে আমরা সিরিয়ায় আইসিস বিরোধী বিমান হামলা করতে গিয়ে বাসার আল আসাদকে সাহায্য করার কথা ভাবছি। আইসিস বিরোধী এই হামলা কি বাসার আল আসাদের সঙ্গে যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধের জালে আমাদের আটকে ফেলবে না?
ওবামা বলেছেন, ‘আমরা সেইসব জনগণের পাশে দাঁড়াব, যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। ’

এখানে আরো সমস্যা, আরো প্রশ্ন আছে। সোমালিয়া ও ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলার আইনি ভিত্তি নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এসব প্রশ্ন কখনো স্পষ্ট করা হয় না। এমনকি এসব দেশে যখন এ ধরনের হামলায় বিচারবহির্ভূতভাবে খোদ মার্কিন নাগরিকদেরকেও হত্যা করা হয় তারপরও কোনো প্রশ্ন নেই। হোয়াই হাউস এ ধরনের হত্যার বৈধতা নিয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। বরং বিচার বিভাগ ‘যুদ্ধ আইন’র বরাত দিয়ে ‘যুদ্ধ চালাতে সরকারের আগ্রহ’ এবং ‘যুদ্ধ পরিস্থিতি’ নামে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে।  

এমন অবস্থাতেই বুধবার প্রেসিডেন্ট ওবামা তার নেতৃত্বকে শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িত করে বললেন, ‘এটাই হল আমেরিকার শ্রেষ্ঠ নেতৃত্ব। ’ ওবামা আরো বলেছেন, ‘আমরা যখন দূর প্রবাসের কোনো উপত্যকায় আটকে পড়া নাগরিকদের হত্যা মোকাবেলায় সাহায্য করেছি তখন সেখনকার একজন (আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে) বললেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুদের কাছে আমাদের জীবনকে ঋণগ্রস্ত করলাম’।

যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতাকেই বলা হয় ‘মানবিক ত্রাণ তৎপরতা’। আসলে আমরা যুদ্ধ থেকে খুব বেশি দূরে নই।  

*লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘নিউ ইয়র্কার’-এ ২২ সেপ্টেম্বর ইস্যুতে প্রকাশিত

এ্যামি ডেভিডসন:  নিউ ইয়র্কার এর নির্বাহী সম্পাদক
অনুবাদক: শাহাদাৎ তৈয়ব

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫২ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৭,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।