দুই সন্তানহারা জয়শ্রীর নামে কুৎসা লিখবেন না প্লিজ। দু’ দিন ধরে দুঃসহ সময় পার করছি আমরা।
জয়শ্রী ও আলীমুলের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে বেশ ক’বছর আগে। তাদের দুই সন্তানের একসঙ্গে আত্মহত্যার ঘটনাটি বাবা-মায়ের বন্ধন অটুট না থাকলে যে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে, সেই নির্মম সত্যটাই প্রমাণ করে দিয়েছে। অথচ এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বদলে আমরা মেতে উঠেছি কুৎসিত সাংবাদিকতায়।
নারীর চরিত্র হননে নেমে পড়েছে আমাদের গণমাধ্যমের একটি অংশ। কয়েকটি পত্রিকায় এই ঘটনায় আঙ্গুল তোলা হয়েছে জয়শ্রী জামানের দিকে, যা আমাদের ভীষণভাবে মর্মাহত করেছে।
একইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। সাংবাদিকতার নীতির বাইরে গিয়ে কল্পিত গল্পগাথা যে সমাজকে বিভ্রান্ত করতে পারে সে কথাটাও আমরা ভুলে গেছি।
২০১১ সালে স্বামীর নির্যাতনের শিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোমানা মঞ্জুরের কথা আমরা এখনো ভুলে যাইনি। রোমানার স্বামী হাসান সাইদ মারা যাবার পর পুরো পরিস্থিতিই বদলে গেল। রোমানার ওপর হওয়া অত্যাচারের কথা সমাজ, গণমাধ্যম ভুলে গেল। তখন প্রকাশিত হতে থাকলো কথিত 'ইরানি বন্ধুর' সঙ্গে রোমানা মঞ্জুরের ছবি আর সূত্রবিহীন মেইল। রোমানা দেশের বাইরে পড়াশুনা করছিলেন। সেখানে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে পারে। তাতে তার উপর অত্যাচার-নির্যাতন নেমে আসতে পারে না।
আমরা ভুলে যাই নি ২০১০ সালে জুরাইনে দুই সন্তান নিয়ে মায়ের আত্মহত্যার কথা। সেখানেও একজন নারী সাংবাদিককে নিয়ে বিস্তর লিখেছে গণমাধ্যম। কয়েকটা দিন যাওয়ার পর দেখা যায়, মূল ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে দেদারসে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে লেখা হচ্ছে সেই নারী সাংবাদিককে নিয়ে। আত্মহত্যার মূল ঘটনাটি লিখতে মজা না পেয়ে নারী সহকর্মীকে নিয়ে হলুদ সাংবাদিকতাতেই বিকৃত আনন্দ ছিলো অনেকের। সমুদ্র সৈকতে কিংবা ঘরের ভেতরে তোলা টিশার্ট পরা ছবি দিয়ে সেই ঘটনার আপডেট জানানো হয়েছে বহুদিন।
ঐশীর ঘটনাটিও আমাদের সমাজকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াটাই যেন একমাত্র কারণ ছিলো কিংবা জিন্স-টিশার্ট। ঘটনার মূলে যাওয়ার চেয়ে ঐশীকে নিয়ে লেখালেখিই আনন্দের বিষয় ছিলো অনেকের।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি নিহত হওয়ার পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আমাদের প্রিয় বন্ধু-সহকর্মী রুনির মৃত্যুর পর কতো কথা শুনেছি। হ্যা...সব কথাই হয়েছে রুনিকে নিয়ে (প্রিয় বন্ধু সাগরকে নিয়ে বললেও সেটা সুখকর হতো না আমাদের কাছে)। রিপোর্টের লাইনে লাইনে রুনির চরিত্র হনন করা হয়েছে নানাভাবে। যে কারণে এখনো আমরা সাগর-রুনি হত্যারহস্য জানতে পারি নি।
রুনির বেলায়ও আমরা রুনির বন্ধু-সহকর্মী ও স্বজনেরা প্রতিবাদ করেছিলাম। জয়শ্রী জামানকে নিয়ে লেখা সংবাদগুলোর বেলায়ও আমরা একযোগে প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
জয়শ্রীর দুই সন্তানের আত্মহত্যার ঘটনা তো প্রতিটি অভিভাবকের বিবেককে জাগিয়ে তোলার কথা। নিজের সন্তানের নিরাপদ জীবনের জন্য সচেতন হয়ে ওঠার কথা। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাচ্চা দুটি ছিল জয়শ্রী জামানের প্রাণ। এই দুই সন্তানের জন্যই জয়শ্রী জামানকে ছুটে বেড়াতে হতো রাজধানীর এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
ছেলে-মেয়েকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিলেন জয়শ্রী। আজ যখন ওরাও চলে গেলো তখন তার আর তো হারাবারও কিছু থাকলো না। তবুও নি:স্ব জয়শ্রীকে আমরা বাঁচতে দিচ্ছি না। একজন সন্তানহারা মায়ের আর্তচিৎকার আমাদের কানে পৌঁছে না। আমরা মানবিকতার হাত বাড়িয়ে তার পাশে দাঁড়াইনি। বরং কিভাবে তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল ‘সম্মানটুকু’ ধুলিসাৎ করা যায় সেজন্য যেনো কেউ কেউ আদাজল খেয়ে লেগেছে।
যার সব হারিয়েছে তাকেই দায়ী করা হচ্ছে কারণ হিসেবে। হায়রে সাংবাদিকতা! অত্যন্ত মেধাবী চিরশ্রী ও আলীমকে নিয়েই দু চোখে রঙিন স্বপ্ন ছিল জয়শ্রীর। মেয়েটি চার বিষয়ে স্টার মাকর্সসহ ‘এ’ গ্রেড পেয়েছিল ‘ও’ লেভেলে। গিটার বাজাতো। জাপানী ভাষা জানতো। মায়ের মতোই বিনয়ী ও ভদ্র ছিল। অথচ ওই দুটি বাচ্চাকে মাদকাসক্ত বানানোরও অপচেষ্টা হয়েছে।
বুধবার কয়েকটি পত্রিকা লিখেছে,“বাবা তাদের জীবন থেকে আগেই চলে গেছেন। মাও সে পথেই হাঁটছেন। ” মা যে সে পথে হাটঁছেন এটা কিসের ভিত্তিতে বলছে পত্রিকাগুলো? অথচ কম্যুনিটির প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে দূরে সরে না থেকে আমরা যদি জয়শ্রী-আলীমুলের সাজানো সংসারটি ধরে রাখার চেষ্টা করতে পারতাম তা হলে হয়তো আজ দুটি মেধাবী শিশুকে অকালে ঝড়ে যেতে হতো না।
আমরা যদি মেধাবী মেয়েটির জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে পারতাম তা হলে হয় তো সন্তান দুটিকে নিয়ে আরেকটু ভালোভাবে থাকতে পারতেন জয়শ্রী। আমাদের মধ্যে অনুতাপ তো নেই-ই, কেউ কেউ দু:খজনক বিষয়টিকেও মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ‘সংবাদ পণ্য’ করার চেষ্টা করছেন। সমাজের বিবেক, সমাজের দর্পণ হিসেবে যারা কাজ করছেন, তারা কি দয়া করে একবার ভেবে দেখবেন বিষয়গুলো?
আমরা জয়শ্রী জামানের বন্ধু ও সহকর্মীরা:- দিল মনোয়ারা মনু, ইখতিয়ারউদ্দিন, মাহমুদ হাফিজ, ফরিদা ইয়াসমিন, সুপ্রীতি ধর, পারভীন সুলতানা ঝুমা, জাহিদ নেওয়াজ খান, শারমিন রিনভী, প্রভাষ আমিন, ইলিয়াস খান, রানা হাসান, অঞ্জন রায়, মানস ঘোষ, ফজলুল বারী, শাহনাজ গাজী, ফাতেমা জোহরা হক কাকলী, সুমি খান, গোধূলী খান, জুলহাস আলম, রোজিনা ইসলাম, জাহানারা পারভীন, নাদিরা কিরণ, জাকিয়া আহমেদ, ইশরাত জাহান ঊর্মি, সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী, তানবীর সিদ্দিকী, শাহেদা ফেরদৌসী, ফারহানা লাকি, মুনমুন শারমীন শামস্, জেসমিন পাপঁড়ি, সাজু রহমান, লীনা পারভীন, মোরসালিন মিজান, তাসকিনা ইয়াসমিন, লাবনী গুহ রায়, দৌলত আক্তার মালা, শামীম আরা শিউলি, সুলতানা রহমান, ফারহানা মিলি, সেবিকা দেবনাথ, রুখসানা ইয়াসমিন, আঙ্গুর নাহার মন্টি ও ঝর্ণামনি।
বাংলাদেশ সময় ২২৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৪