১।
প্রতি বছর অক্টোবর মাসে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সময় সব থেকে বেশি আলোচনায় আসে যে ক্যাটাগরি, তা হলো শান্তি পুরস্কার।

নোবেল কমিটির চেয়ারম্যানের ভাষ্যমতে, “একজন হিন্দু, অন্যজন মুসলমান; একজন ভারতীয়, অন্যদিকে একজন পাকিস্তানি; একই লক্ষ্য নিয়ে, শিক্ষার অধিকারের দাবিতে এবং উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন-যা নোবেল কমিটির কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। ”
এবারের শান্তি পুরস্কার যেন, এক তীরে অনেকগুলো পাখি শিকারের মতই। এখানে নোবেল কমিটি একাধারে চিরশত্রু ভারত বনাম পাকিস্তান, হিন্দু বনাম মুসলিম, পুরুষ বনাম নারী, শিক্ষা বনাম উগ্রবাদ সবকিছুকেই টেনে এনেছেন। অথচ, যেসব বিষয় নোবেল কমিটি বিবেচনায় এনেছেন, শান্তির ক্ষেত্রে কোনটাতেই মালালা এবং কৈলাশের কোনো ভূমিকা নেই। এছাড়াও একজন হিন্দু, আরেকজন মুসলমান- ধর্মীয়ভাবে দুজনের পরিচয় আলাদাভাবে উল্লেখ করে যৌথভাবে পুরুস্কৃত করে, নোবেল কমিটি বিশ্ববাসীকে কি মেসেজ দিতে চাইছে সত্যি বোধগম্য নয়।
মালালার নোবেল প্রাপ্তি তেমন একটা বিস্মিত করেনি আমাদের অনেককেই। কারণ, বিগত কয়েক বছর ধরে মালালাকে পশ্চিমারা এজন্যই তৈরি করে নিচ্ছিল। গত বছরই পেয়ে যেত, নেহাতই বয়স কম বলে মিডিয়াগুলো শোরগোল তোলায় পুরস্কার ফসকে গিয়েছিল। তাই এবার আর মালালার পুরুস্কার প্রাপ্তি নিয়ে কোনো সন্দেহ কারোরই ছিল না।

অন্যদিকে মালালা যেমন প্রতি মুহূর্ত মিডিয়ার পাদপ্রদীপে ছিলেন, কৈলাশ ছিলেন তার বিপরীত। কৈলাশের কাজ নিয়ে তাদের মিডিয়াগুলোও ছিল অন্ধকারে। অথচ ৬০ বছর বয়সী কৈলাস গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছেন, গড়ে তুলেছেন ‘বাচপান বাঁচাও’ আন্দোলন। মিডিয়ার আড়ালেই কাজ করে গেছেন তিনি নীরবে। কৈলাসকে খোদ ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো পুরুস্কার দেয়া হয় নি, না পদ্মশ্রী, না পদ্মভূষণ কিংবা অন্য কিছু।
অথচ পাকিস্তানি মালালার সাথে ভারতের কৈলাশকে নোবেল পুরুস্কার দেয়া যেন অনেকটা ভারসাম্য রক্ষা করার মতই। ভবিষ্যত অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতকে পশ্চিমাদের নিজেদের তাঁবুতে রাখতেই কি না কে জানে, নিজেদের পাপেট মালালার পাশাপাশি অখ্যাত কৈলাশকেও শান্তি পুরস্কার দেয়া বিশ্ববাসীকে শান্তির নামে ধোঁকা দেয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।
২।

হেনরী কিসিঞ্জারের মত ঘৃণিত ব্যক্তিকে কি নোবেল কমিটি এর আগে নির্বাচিত করেনি? ইয়াসির আরাফাত, আইজ্যাক রবিন যখন শান্তি পুরুস্কার পান, তখন সত্যি অবাক হতে হয়। মায়ানমারের অং সাং সুকির মত যে ব্যক্তি নিজ দেশেই শান্তি আনয়নের জন্য ব্যর্থ, সে ব্যক্তি বিশ্বশান্তিতে কি অবদান রাখতে পেরেছিল, তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
২০০৭ সালে ক্লাইমেট চেইঞ্জ ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য বড় বড় বাণীর কথা বলা আল গোর যখন আইপিসির সাথে যুক্তভাবে পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন তিনি নিজেই ২০ কক্ষ বিশিষ্ট আলিশান প্রাসাদে গ্যাস ও বিদ্যুতের মাত্রাতিরিক্ত অপচয়ের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন।
২০১০ সালে নোবেল কমিটি চায়না থেকে অখ্যাত একজনকে মনোনীত করেছিলেন। কারাগারে বন্দি চায়নার লিউ শিয়াওবোকে বিশ্বশান্তির জন্য কেন পুরুস্কৃত করা হয়েছিল, সেটা বিশ্ববাসীর কাছে সে সময় দারুণ একটা ধাধার মতই ছিল। নির্ঝঞ্ঝাট চায়নায় শান্তির অভাব ছিল বলে তো কখনো শোনা যায় নি! তবে পরে জানা যায়, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকে শান্তির নামে আমেরিকার মাতব্বরিকে এই শান্তি পুরস্কার জয়ী আকন্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন। কাজেই পশ্চিমাদের তাবেদারির পুরস্কার হিসেবে জুটেছে নোবেল শান্তি পুরস্কার!!!

৩।
শান্তি পুরস্কার পাবার জন্য যে পশ্চিমা কানেকশন অবশ্য প্রয়োজনীয়, তা এখন আর বিশ্ববাসীর অজানা নয়। শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পুরস্কার পাবার আগেও যেমন বিশ্বশান্তিতে তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান খুঁজে পাওয়া যায় না, তেমনি পুরস্কার পাবার পরও পশ্চিমাদের লোভের আগুনে পুড়ে যাওয়া যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোর পক্ষেও এদের কোনো কথা বলতে আমরা দেখি না।
সব থেকে বড় কথা, শান্তি পুরস্কার জয়ীরা মুখে যা বলেন তারা নিজেরাই তা বিশ্বাস করেন না। কাজেই শান্তি পুরস্কার দেবার নামে বিশ্ববাসীর সাথে পশ্চিমাদের নির্লজ্জ্ব তামাশা বন্ধ করা হোক। শান্তি পুরস্কারের নাম বদলে বরং অন্য কিছু নাম দেয়া হোক। বিশ্ববাসীকে শান্তির নামে ধোঁকা দেয়া বন্ধ করা হোক।
ড. জিনিয়া জাহিদ : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৪