শিশুদের ক্ষুধা কিংবা অস্বস্তি অনুভবের ফলে কান্না পায়। সেই কান্নাটি একটি ভাষা।
গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের শোয়ার ঘরের নানান আকৃতির রঙ্গিন জিনিসপত্রের উপস্থিতি তাদের পরবর্তী একাডেমিক লাইফে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
নিজেদের সৃষ্ট শব্দের উপর শিশুদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কম থাকে। তবে কয়েক সপ্তাহ বয়সের শিশুরা মানব ভাষার বিভিন্ন শব্দের মধ্যকার সুক্ষ্ণ পার্থক্য বুঝতে পারে। যেমন ‘পা’ এবং ‘বা’ এর মধ্যকার পার্থক্য।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নবজাতকরা মাতৃভাষার জ্ঞান নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কারণ মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় মাতৃভাষার বিভিন্ন মেলোডি শুনতে পায়। আমাদের সারা জীবনে বিভিন্ন ভাষা শেখার ক্ষেত্রে এটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
শিশুরা ছয় মাস বয়সে অন্যান্য ভাষার শব্দের সাথে নিজেদের মাতৃভাষার শব্দের পার্থক্য সঠিকভাবে ধরতে পারে। একজন পূর্ণ বয়স্ক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ ক্রেডিট শেষ করেও সেই পার্থক্য নিরূপণের ক্ষমতা ভালভাবে অর্জন করতে পারে না। মাতৃভাষার শব্দের সাথে অন্যান্য ভাষার শব্দের পার্থক্য নিরূপণের ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী শিশুরা খুব অনুভুতিপ্রখর হয়। তাই তাদেরকে সর্বজনীন উচ্চারণ ধ্বনির বিশারদ বলা হয়।
সাত থেকে আট মাসের শিশুরা হঠাৎ করেই বা-বা-বা, নে-নে-নে এবং দে-দে-দে সিলেবলগুলি (এগুলিই প্রকৃত সিলেবল) হড় বড় করে বলতে থাকে। উল্লেখ্য, সকল ভাষায় সেই শব্দগুলি একই এবং বিশ্বের সকল ভাষাতে একই উচ্চারণ ধ্বনি রীতি দিয়ে এই সিলেবলগুলি গঠিত।
শিশুদের বয়স যখন এক বছরের কাছাকাছি, তারা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের শব্দ এক সাথে করে বাক্য সদৃশ্য নতুন কাঠামো গঠন করে। যেমন: নে-নী, দা-দী, মে-নে ইত্যাদি। শিশুদের এই বাক্য গঠন করাকে আমরা অর্থহীন আওয়াজ বলে থাকি। এই বয়সে শিশুদের ভাষার উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ার সাথে সাথে গ্রহণ করার ক্ষমতাও বেড়ে যায়। আমরা যখন আবার দেখা হবে বলি, শিশুরা হাত তুলে বিদায় জানায়। কোন মজার গেম খেলার সময় তারা করতালি দেয়। যখন কোন শিশুর খাবারের নাম বলা হয়, দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, যদি কোন শিশু হড় বড় করে কিছু বলতে না পারে, বুঝতে হবে শিশুটির বায়োলজিক্যাল সমস্যা আছে। এক্ষেত্রে অতি দ্রুত শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।
শিশুরা তাদের প্রথম জন্মদিনের আগেই কয়েকটি শব্দ বুঝতে পারে এবং বলতেও পারে। সেই সব শব্দগুলিকে শিশুরা ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাবে উচ্চারণ করে, যা বয়স্ক লোকেরা সহজেই বুঝতে পারে। শিশুদের এই পর্যায়কে এক-শাব্দিক পর্যায় বলা হয়। এই পর্যায়টি দুই মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
শত শত বছর ধরে বিজ্ঞানীরা তাদের শিশুদের প্রথম উচ্চারিত শব্দগুলি ডায়েরিতে লিখে রেখেছেন। অধিকাংশ শব্দই বিভিন্ন বস্তুর নাম। খাবারের মধ্যে জুস, কোকিস; শরীরের অঙ্গের মধ্যে চোখ, নাক; বস্ত্রের মধ্যে ডায়াপার, মোজা; যানবাহনের মধ্যে গাড়ি, নৌকা; খেলনার মধ্যে পুতুল, ব্লক; গৃহস্থালি বস্তুর মধ্যে বোতল, লাইট। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাণীর নামও শিশুরা উচ্চারণ করে। যেমন কুকুর, বিড়াল এবং মানুষের মধ্যে বাবা, মা, বেবি।
অনেক একশন/মশান শব্দও শিশুরা উচ্চারণ করে। যেমন ‘উপরে’, ‘বন্ধ’, ‘খোলা’ এবং ‘যাও’। বিশেষায়িত কারী কিছু শব্দও এক বছরের শিশুরা বেশি উচ্চারণ করে। যেমন, ‘গরম’, ‘ঠাণ্ডা’, ‘নোংরা’, ‘বেশি’ এবং ‘শেষ’। শিশুরা রুটিন শব্দগুলিও ব্যবহার করে। যেমন, ‘হ্যাঁ’, ‘না’, ‘চাই’। অনেক সময় এক-শাব্দিক পর্যায়ের শেষের দিকে ‘এদিকে থাকাও’ ও ‘এটি কি?’ ধরনের দ্বি-শাব্দিক পর্যায়ের প্রথম দিকের শব্দ গুচ্ছগুলি শিশুরা উচ্চারণ করে। যাকে আমরা telegraphic stage বলি।
আঠার মাস বয়স থেকেই শিশুরা প্রতি দুই ঘণ্টায় একটি করে শব্দ শিখতে থাকে। শব্দ শিক্ষার এই হার বয়ঃসন্ধি কাল পর্যন্ত চলতে থাকে। আঠার মাস বয়স থেকেই শিশুরা বাক্য গঠনও শুরু করে। সাধারণত বাক্যগুলি দুই শব্দের হওয়ার কারণে এদেরকে আমরা ‘telegraphic’ বাক্য বলে থাকি।
এই সময় শিশুরা বাক্যে ব্যাকরণগত শব্দগুলি (preposition, articles, auxiliary etc) ব্যবহার করে না। যেমন ‘মা পানি’ এবং ‘বাবা জুস’ এর ন্যায় telegraphic বাক্যগুলি তারা উচ্চারণ করে। শিশুদের চারপাশ থেকে যখন তাদের খেলনা জাতীয় বস্তু সরিয়ে নেওয়া হয়, কিংবা ফিরিয়ে আনা হয়, তখনই তারা প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে ব্যাকরণ-বিহীন বাক্য গঠন করে।
শিশুদের এই ক্ষুদ্র বাক্য গঠনের প্রচেষ্টাতে আমরা কিভাবে ভাষা অর্জন করি, তা প্রতিফলিত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, শিশুদের প্রায় পঁচানব্বই ভাগ দ্বি-শাব্দিক বাক্যে শব্দ স্থাপন পদ্ধতি সঠিক।
দুই বছর থেকে ত্রিশ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের কথোপকথনে ব্যাকরণের প্রয়োগ হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। এই হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঘটনাটি শিশু মনো-ভাষাবিজ্ঞানীদের অবাক করে দেয়। কেন বেড়ে যায় তা নির্ধারণ করার জন্য চলছে গবেষণা।
এই বয়সে শিশুদের বাক্য গঠনের সামর্থ্যের ব্যপ্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। ব্যাকরণ যে মানব জিনের মত একটি combinatorial পদ্ধতি অনুসরণ করে, শিশুদের এই ব্যপ্তিতা থেকেই তা বুঝা যায়। শিশুদের বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে বাক্যরীতির ভিন্নতাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পায় । প্রতি মাসেই বাক্যরীতির ভিন্নতা দ্বিগুণ হতে থাকে এবং তৃতীয় জন্ম দিনের আগ পর্যন্ত বাক্যরীতির ভিন্নতা প্রায় হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়।
আঠার মাস থেকে দুই বছর বয়সের শিশুরা বাক্য গঠনের ক্ষেত্রে সে সব ব্যাকরণগত শব্দ ব্যবহার করে না, ত্রিশ মাস থেকে তিন বছর বয়সের শিশুদের প্রায় নব্বই শতাংশ বাক্যে সেই সব ব্যাকরণগত শব্দ ব্যবহার করতে দেখা যায়।
তিন বছর বয়স থেকেই শিশুরা কিভাবে ভাষার বিভিন্ন অংশ শিখবে তা খুব সহজেই হলফ করে বলা যায়। ভাষা শিখার প্রতিটি ধাপকে ভাষা উন্নয়নের ধাপ বলা হয়। ক্রমে ক্রমে শিশুদের ভাষা উন্নয়নের সিকোয়েন্সটি তাদের বোধশক্তির সাথে সম্পর্কিত। যেমন, তিন বছরের একটি শিশু কখনই সময় সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না। তাই তারা temporal adverbs ( উদাহরণ: আগামীকাল; গত সপ্তাহ) ব্যবহার করে না।
ভাষা উন্নয়নের পরম্পরার সাথে শিশুদের বোধশক্তি যে সম্পর্কিত তার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। শিশুরা বিশেষ্যের একবচন এবং বহুবচনের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে। তবে অপ্রতিসম (irregular) বহুবচনে দক্ষ হতে স্কুলে থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
তবে তিন বছর বয়সের বেশিরভাগ শিশুর বাক্যগুলি ব্যাকরণের নিয়মমাফিক হয়না। শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই men কে mens; went কে wents হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।
একটি গবেষণার দেখা যায় যে শিশুরা ব্যাকরণগত রূপমূল অর্জনের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স অনুসরণ করে। শিশুরা প্রথমেই সাহায্যকারী ক্রিয়ার ব্যবহার শিখে। দ্বিতীয় পর্যায়ে থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নম্বর, তৃতীয় পর্যায়ে নির্দেশক চিহ্ন, চতুর্থ পর্যায়ে ক্রিয়ার বিভিন্ন রূপ, পঞ্চম পর্যায়ে অধিকারসুচক শব্দ, ষষ্ঠ পর্যায়ে ক্রিয়ার বিভিন্ন অনিয়মিত অতীত রুপ, সপ্তম পর্যায়ে বহুবচন এবং অষ্টম পর্যায়ে বর্তমান চলমানের ব্যাকরণগত অংশটি আয়ত্ত করে।
যদি কোন শিশুর অষ্টম পর্যায়ে বর্তমান চলমানের ব্যাকরণগত অংশটি আয়ত্তে থাকে, এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রথম থেকে সপ্তম পর্যায়ের সকল ব্যাকরণগত রূপমূলগুলি তার আয়ত্তে আছে। তবে শিশুটির প্রথম পর্যায়ের সাহায্যকারী ক্রিয়ার ব্যবহার জানা থাকলেও বাকি ব্যাকরণগত রূপমূলগুলি ব্যবহার করতে পারবে কিংবা জানা আছে, তা ঠিক নয়।
শিশুরা প্রথমেই না-বোধক বাক্যের প্রয়োগ শিখে। তারপরে প্রশ্নবোধক বাক্য। তবে উভয় ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট সিকোয়েন্স অনুসরণ করে।
না-বোধক বাক্যের ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে শুধু ‘না’, অথবা ’না’ এর সাথে একটি বিশেষ্য যোগ করে। যেমন: ‘না’ অথবা ‘ভাত না’। পরের ধাপে শিশুরা সাধারণত বাক্যে কর্তা ব্যবহার করে। যেমন: ‘বাবা, ভাত না’। তৃতীয় ধাপে শিশুরা আরও জটিল না-বোধক বাক্য গঠন করে। যেমন ‘সে ইহা করতে পারে না’। এই পর্যায়ে কিছু ব্যাকরণগত ভুল পাওয়া যায়। তবে চতুর্থ ধাপে শিশুরা বিভিন্ন না-বোধক উপাদানকে সঠিকভাবে বাক্যে ব্যবহার করে। উদাহরণটি লক্ষ্য করুন ‘আমার বেশি মোমবাতি নেই’ ও ‘মা ভাল রান্না করতে পারে না’।
প্রশ্নবোধক বাক্য গঠনের ক্ষেত্রেও শিশুরা বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করে। এমনকি wh-শব্দগুলি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একটি সিকোয়েন্স মেনে চলে। প্রথমেই তারা ‘কি’ (এটা কি?; এইগুলি কি?) শব্দটি প্রয়োগ করে। ‘কি’ প্রশ্নবোধক চিহ্ন ব্যবহার করার সামর্থ্য অর্জন করার পরপরই দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘কোথায়’ (দুধ কোথায়?) এবং ‘কে’ (সে কে?) ব্যবহার করে। তবে কোনটি আগে ব্যবহার করে তা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি।
তারপর শিখে ‘কেন’ (আমটি কেন সবুজ?) এর ব্যবহার এবং ‘কেন’ এর ব্যবহারের ফ্রিকোয়েন্সি খুব বেশি হয়। শিশুরা অসংখ্য প্রশ্ন করতে থাকে ‘কেন’ ব্যবহার করে। সর্বশেষ শিশুরা manner এবং time সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। তারা ‘কিভাবে/কেমন’ (কিভাবে ঘটল?/ইহা কেমন?) এবং কখন (কখন আসবে?) দ্বারা প্রশ্ন করতে শুরু করে। এখানে উল্লেখ্য যে ‘কিভাবে/কেমন’ এবং ‘কখন’ দ্বারা প্রশ্নবোধক বাক্য গঠন করার সামর্থ্য শিশুরা চার থেকে পাঁচ বছর বয়সে অর্জন করে।
এবার আসুন দেখি কিভাবে শিশুরা বিভিন্ন ধাপে প্রশ্নবোধক বাক্য গঠন করার সামর্থ্য আয়ত্ত করে। প্রথম ধাপে এক শাব্দিক, দ্বি-শাব্দিক অথবা ত্রি-শাব্দিক প্রশ্নবোধক বাক্য গঠন করে। যেমন: ‘দুধ? মা দুধ? মা দুধ কোথায়?’। দ্বিতীয় ধাপে declarative বাক্যের শেষে intonation বাড়িয়ে প্রশ্নবোধক বাক্য গঠন করে। যেমন: ‘তোমার কাছে আম আছে?’; ‘তুমি ক্রিকেট খেল?’।
তৃতীয় ধাপে শিশুরা সাহায্যকারী ক্রিয়াগুলিকে কর্তার সামনে বসিয়ে প্রশ্নবোধক বাক্য গঠন করে। যেমন: Are you angry? Can I help you? পরের ধাপে প্রশ্নবোধক বাক্য গঠনের সামর্থ্য তৃতীয় ধাপের মত হলেও বাক্যের দৈর্ঘ্য বেড়ে যায়। নিচের উদাহরণটি দেখুন। Is she going to sing a song?
পঞ্চম ধাপে এসে শিশুরা wh-এবং ‘হ্যাঁ-না’ প্রশ্নগুলি সঠিকভাবে গঠন করে। যেমন: Does she love me? When did they play cricket with your team? চূড়ান্ত ধাপে এসে শিশুরা না-বোধক এবং জটিল ধরনের প্রশ্নবোধক বাক্য গঠনে দক্ষতার পরিচয় দেয়।
মনে রাখা দরকার যে শিশুদের ভাষা শিখার মূল উৎস হল পরিবেশ। বিশেষ করে পারিবারিক পরিবেশ যদি বন্ধুত্বপূর্ণ না হয়, পরিপূর্ণ বয়সে বিভিন্ন ধরনের ভাষাভিত্তিক বৈকল্য দেখা দিতে পারে। তাই শিশুরা যেন বেশি করে receptive এবং productive task সম্পন্ন করতে পারে, সেইটির নিশ্চয়তা করতে হবে পরিবার থেকেই।
ডঃ বিজন সরকার, বিদেশি ভাষা গবেষক ও কলাম লেখক, চন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউথ কোরিয়া, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৪