ঢাকা: প্রতি মিনিটে পৃথিবীতে দুই থেকে তিনজন মানুষ বিভিন্ন ধরনের কীটনাশকের মাধ্যমে আক্রান্ত হচ্ছে। মূলত কৃষি কাজে নিয়োজিত ও সরাসরি মাঠে কাজ করা কৃষকরাই কীটনাশকের ভয়াবহতার শিকার।
পরিবেশ এবং মানুষের শরীরে জন্য মারাত্মক বিভিন্ন কীটনাশকের বিষাক্ততা সম্পর্কে বিষদ জানার পর সমস্ত পৃথিবীতে এগুলো নিষিদ্ধ করে দেওয়া হলেও বাংলাদেশসহ আরও কিছু উন্নয়নশীল দেশে ক্ষতিকর কীটনাশকগুলো আশঙ্কাজনক হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য দিবসের এমন ক্ষণে সবার অক্লান্ত প্রচেষ্টা গণমানুষের সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করা এবং কৃষিতে কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশ, মানবদেহ ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিরুপ প্রভাব ফেলছে যার দিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত।
বাংলাদেশের ক্রম বর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে একদিকে যেমন ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে অন্যদিকে পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসল রক্ষায় বেড়েছে কীটনাশকের ব্যাবহারও। কিন্তু আশঙ্কাজনকভাবে ৯০ এর দশক থেকে বর্তমান সময়ে এসে দেশে কীটনাশকের ব্যাবহার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এর ফলে কৃষকরা তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেন না।
খুব সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের একটি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় সব কৃষক কীটনাশক স্প্রে করার সময় তাদের পা ঢাকার কোন কিছু ব্যবহার করে না, মাত্র ২% কৃষক হাত মোজা বা গ্লাভস ব্যবহার করেন, ৩% কৃষক নিরাপত্তার জন্য চশমা ব্যবহার করেন এবং ৬% কৃষক কাপড় দিয়ে নাক ঢেকে রাখেন।
কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহার করার বেশ কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা বলেন। যেমন মাথা বাথ্যা, মাথা ঘোরানো, চোখ ও শরীরে এলার্জি সৃষ্টি হওয়া, বমি বমি ভাব ইত্যাদি। দীর্ঘস্থায়ী পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে লিউকমিয়া, ফুসফুসের কান্সার, অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়া, হরমোনাল পরিবর্তন, ডি এন এ এর ক্ষতি, জন্মদান বিষয়ক জটিলতা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে কীটনাশকের বিষ নদী ও ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশে পানিকে বিষাক্ত করে । নদী, সমুদ্র ও সার্বিকভাবে পানির সাথে সংশ্লিষ্ট জীববৈচিত্রের জন্য কীটনাশকের ব্যবহার হুমকি তাই নীরব হুমকি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিষাক্ততা খাদ্য শৃঙ্খলে মিশে যাচ্ছে যেমন আর্কটিক মহাসাগরের প্রাণীদের খাদ্য শৃঙ্খলে বিষের মাত্রা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত শষ্যসমুহের মধ্যে বেগুন চাষে সবচেয়ে বেশি কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় এবং অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় কৃষক ও ভোক্তার কাছে সবজি হিসাবে বাংলাদেশে বেগুন চাষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফসলের রোগ ও কীটপতঙ্গ জনিত সংক্রমণে; আরও নির্দিষ্ট করে বললে শুট বোরার লার্ভার কারণে ৫০% শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। কীটনাশক ব্যাবহারের পরও এই ক্ষতির তীব্রতা দৃশ্যমান থাকে।
জরিপে দেখা গেছে কৃষকরা ফসল বড় হওয়ার সময় গড়ে প্রায় ১৫০ বার অর্থাৎ প্রতি দুই দিনে একবার বেগুন ক্ষেতে কিটনাশক প্রয়োগ করেন। আর গাছ থেকে বেগুন সংগ্রহের কাজে শিশুশ্রম এখনও প্রচলিত। এমন তথ্যও পাওয়া যায় যে, শিশুরা কীটনাশক মেশানোর জন্য ব্যবহৃত বালতির মধ্যেই বেগুন সংগ্রহ করে। সে অর্থে শিশুশ্রমিক এবং ক্ষেতে থেকে তোলা বেগুন পুরোপুরো কীটনাশকের সাথে মিশে যাচ্ছে।
বেগুন চাষে শুট বোরার এবং অন্যান্য ক্ষতি প্রতিরোধে কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। অরগানিক এবং “ইন্টিগ্রেটেড পেস্ট মেথড” অনেক আশাবাদের কথা বলছে ঠিকই কিন্তু জটিলতা ও দ্রুত কাজ করতে না পারার কারণে এটি ব্যাপকভাবে সফল হয়নি।
বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞগণ করনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে এবং ইউএসএইড এর অর্থায়নে একধরনের বেগুন উদ্ভাবন করেছে যার পাতায় ও ফলে প্রাকৃতিকভাবেই এক ধরনের বিটি প্রোটিন ধারণ করে। বেগুনের এই বিটি প্রোটিন ফসলের অন্যান্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ করতে সক্ষম।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বিটি বেগুন চাষে পূর্ণ অনুমোদন দিয়েছে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ২০ জন কৃষক পরীক্ষামূলক ভাবে বিটি বেগুনের আবাদ করে। আগামী মৌসুমের মধ্যেই ১০০ জন কৃষকদের হাতে এর চারা পৌঁছে যাবে।
কিছু কিছু এনজিও দাবি করছে বিটি বেগুনের প্রতিক্রিয়া এখনও সম্পূর্ণ ভাবে পর্যালোচনা করা হয়নি এমনটা বলে। এনজিওগুলোর এই দাবী করছে সত্য নয়।
বিটি প্রোটিন এক যুগেরও বেশি সময়কাল ব্যাপী খাদ্যজাত বিভিন্ন পন্য ও ফসলে ব্যবহৃত হয়ে আসছে যার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ভুট্টা এবং কৃষি কাজে বিটি প্রোটিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার করা হয়।
বৈজ্ঞানিকদের কাছে বিটি প্রোটিন ক্রাই-১ নামে পরিচিত যা মূলত ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের জন্য বিষাক্ত কিন্তু মানুষ ও কীটপতঙ্গ বৈশিষ্ট সম্পন্ন নয় এমন প্রজাতির জন্য এটি মোটেও বিষাক্ত নয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মাঠ পর্যায়ে কিছু পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে বিটি প্রোটিন বেগুন গাছের ফল (বেগুন) ও শুট বোরার নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১০০ ভাগ ফলপ্রসূ ও নিরাপদ।
বাংলাদেশের কৃষকরা একবার এই বিটি বেগুনের চাষ শুরু করতে পারলে তাদের কোন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করার প্রয়োজন হবেনা। সার্বিকভাবে আশা করা যায় কীটনাশকের ব্যবহার ৭০%- ৯০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং নুন্যতম বিনিয়োগ করে সর্বাধিক উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষকরা এই ফসলজাত আয় ১০০% পর্যন্ত বাড়াতে পারবেন।
বাংলাদেশের কৃষক বিটি বেগুন চাষ করে প্রতি হেক্টর থেকে ১৪৪০০০ টাকা (১৮০০ মার্কিন ডলার) আয় করতে পারবেন যার ফলে ক্রেতার কাছে এই সবজিটি আরও সহজলভ্য হবে। যে ২০জন কৃষক বিটি বেগুনের চাষ করে তারা কীটনাশক ব্যবহার করেনি বলে ১০০% নিশ্চিত করেছে এবং উৎপাদিত বেগুন ’কীটনাশকমুক্ত’ হিসাবে বাজারজাত করা হয়েছে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু এনজিও সব ধরনের জেনেটিক মোডিফাইড ফসলের বিরোধিতা করে চলেছে। বিটি বেগুনের পরিচিতি এবং বিস্তৃতির বিরুদ্ধে তাদের এই অবস্থান কীটনাশক কম্পানিগুলোর মতাদর্শের সাথে তাদের একমত পোষন করাকে ইঙ্গিত করে। ভারত ও ফিলিপাইনে তারা এমনভাবে বিষয়টিকে উত্থাপন করেছেন যে সেসব দেশে কৃষকের হাতে বিটি বেগুনের বীজ তুলে দেওয়া এখন দুরুহ ব্যাপার।
অথচ এই বিটি বেগুন সেসব দেশে কীটনাশকের ব্যবহার বহুগুণ কমিয়ে আনতে পারতো। বাংলাদেশে কৃষকের বর্ধিত চাহিদা বিশেষজ্ঞ এবং সরকারকে এই প্রযুক্তি এতদুর নিয়ে আসতে প্রবলভাবে ত্বরান্বিত করেছে।
বিটি বেগুন প্রযুক্তি বিরোধীরা অলীক সব গল্প ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, বলছেন কৃষক বিটি বেগুনের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবে না এবং বহুজাতিক কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে এবং এর ফলে স্থানীয় সব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই অভিযোগগুলো সত্য নয়: কৃষকরা বিটি বেগুনের বীজ সংরক্ষণ করতে পারবে এবং বীজ সংরক্ষণে তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা দেশের মানুষের জন্য সম্পূর্ন অলাভজনক উদ্দেশ্য নিয়ে বিটি বেগুনের বিস্তারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন, কোন বাক্তিগত বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ পূরণের জন্য নয়। বেগুন চাষের ক্ষেত্রে দূরত্ব একটু বেশী হলে বেগুনের পরাগায়ন হয়না। কাজেই কেউ বিটি বেগুনের পাশে দেশি ও অন্যান্য জাতের বেগুনের বা অন্য ফসল চাষ করতে পারবেন যাতে প্রজাতির জীনগত কোন পরিবর্তন হবেনা।
সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের দুটি পথ খোলা রয়েছে। প্রথমটি, জেনেটিকালি মোডিফাইড বিটি বেগুনের পূর্ণ ব্যবহার করে কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধের মাধ্যমে মানুষের সুস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা।
দ্বিতীয়টি, কীটনাশকের পূর্ণ ব্যবহার করে ভোক্তা ও কৃষক উভয়েকেই মারাত্মক ক্ষতির দিকে ঠেলে দেওয়া। বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল যারা জিএমও এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন তাদের সাথে সহমত পোষণের অর্থ দ্বিতীয় পথ বেছে নেয়া অর্থাৎ ধারাবাহিক কীটনাশক ব্যবহার, ক্যান্সার ও পরিবেশদূষণ। বিশ্ব খাদ্য দিবসে খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যত নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী।
• মো: আরিফ হোসেন, করনেল এলায়েন্স ফর সায়েন্স, করনেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইথাকা, নিউইর্য়ক।
বাংলাদেশ সময়: ১২২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৪