পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাস মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর ভাইরাসটি নিয়ে নানা ধরনের কল্পনা, মিথ ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ছে। এরকম পাঁচটি মিথ এখানে তুলে ধরা হলো।
ধনী দেশগুলোতে ইবোলো কখনো ছড়াবে না
ইবোলা নিয়ে সবচেয়ে অদ্ভুত কল্পনা ছিল, এই ভাইরাস কখনো ধনী ও উন্নত দেশগুলোতে ছড়ায় না এবং ছড়াবেও না। পশ্চিম আফ্রিকার মতো গরিব ও অনুন্নত দেশে এর উদ্ভব ও সংক্রমণের কথাই মোটামুটি সবাই জানে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হল, ভাইরাসটি এখন ধনী দেশগুলোতেও ছড়াচ্ছে।
প্রথমে ১৯৭৬ সালের দিকে সাহারা মরুভূমি কেন্দ্রিক পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা শনাক্ত হয়। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চে ভাইরাসটি আবারও আফ্রিকায় ধরা পড়ার পর এই কল্পনা আরো জোরালো হয়। কিন্তু বিস্ময়কর হল, গত ১৫ দিনের মধ্যে আফ্রিকার বাইরের বিভিন্ন উন্নত দেশে ইবোলার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। এ মাসের প্রথম দিকে স্পেনের মাদ্রিদের বসতি তেরেজা রোমেরো রেমোস নামের ৪৪ বছরের এক নার্স ইবোলায় আক্রান্ত হোন। একে একে দেখা গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাস, টেক্সাস, কানাডার টরন্টোর মতো দেশে এখন ইবোলার সংক্রমণ ঘটছে।
নয় এগারোর পর যুক্তরাষ্ট্রের জরুরি সতর্কতা
দুই হাজার এক সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর ব্যাপারে খুবই সতর্ক হয়ে যায়। একইসঙ্গে পোস্টখামে করে অ্যানথ্রাক্স ভাইরাসবাহী পাউডার ধরা পড়ার ঘটনায় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জৈবরাসায়নিক সন্ত্রাসের ব্যাপারেও কড়া সতর্কতা জারি করেন।
সেসময় বুশের মার্কিন প্রশাসন সিডিসি (সেন্টার্স ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন) ও প্রতিরক্ষা সদরদপ্তর থেকে শুরু করে গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিক, হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্স, জরুরি সেবা টিম, সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দরসহ সবখানে জৈবসন্ত্রাসী হামলার ব্যাপার সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করে। নিয়মিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি প্রাইভেট ক্লিনিক, হাসপাতাল, ফার্মেসি, সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য বিভাগে বাইরে থেকে আসতে পারে এমন সম্ভাব্য যেকোনো ধরনের সংক্রামক রোগের ব্যাপারে জরুরি তল্লাসি ব্যবস্থা জারি করা হয়। সেসময় এই সংক্রামক ভাইরাসের তালিকায় ইবোলাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত করা হয়।
ওই সময় মার্কিন প্রশাসন ইবোলা ও নানান রকম বার্ড ফ্লুসহ নানারকম ভাইরাস মোকাবেলায় ও নিয়ন্ত্রণে বিশেষজ্ঞ টিম গড়ে তোলায় লক্ষ লক্ষ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। এসব নানা কারণে এই ধারণা খুবই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে ইবোলা ছড়াবে না। কিন্তু এসব বিশেষজ্ঞ টিম থাকার পরও আফ্রিকা থেকে ইবোলা মোকাবেলায় সাহায্যের আবেদন আসায় যুক্তরাষ্ট্র এখন বলছে, তাদের দেশে ইবোলার মতো মহামারি মোকাবেলায় কোনো অভিজ্ঞ টিম নেই।
বাতাসে ওড়ে ইবোলা
ইবোলার সংক্রমণ ও ছড়ানো নিয়ে নানান রকম কথা চালু আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রবল হলো—এটি বাতাসে ওড়ে। ইবোলা বাতাসে ওড়ে এমন কথার চল থাকলেও বিজ্ঞান বলছে, না উড়লেও ইবোলা রূপান্তরশীল। বাতাসে উড়ে না বটে। কিন্তু শারীরিকভাবে এটি সংক্রমাক। ভাইরাস যখন বস্তুগতভাবেই রূপান্তর হয় তখন এটি ইতিবাচক নিঃসন্দেহে। ইতিমধ্যে ইবোলার তিনশটি রূপান্তর ঘটেছে বলে বিজ্ঞানীরা জানান। তারা বলেছেন, ইবোলা এমন একটি ভাইরাস যেটি অনেকগুলো রিসেপটোরের সঙ্গে যুক্ত। রিসেপ্টোর হল এমন একটি প্রোটিন মোলেকিউলার রাসায়নিক কোষ যেটি সাধারণত একটি কোষের প্লাজমা আবরণের বহিরাংশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। একইসঙ্গে এটি কোষের সারকিউলেটরি সিস্টেমের সঙ্গে সম্পৃক্ত অ্যান্ডোথেলিয়াল বাহ্যিক কোষ প্রবাহের সঙ্গেও যুক্ত থাকে। তবে ফুসফুসের এভিউলার কোষের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে এমন কোনো কোষে এই সারকিউলেটরি সিস্টেমে এর রূপান্তর ঘটে না।
বিজ্ঞানীরা জানান, সাধারণত দুই কারণে ভাইরাসের রূপান্তর ঘটে। প্রথমত এলোপাতাড়ি ভুল, দ্বিতীয়ত প্রাকৃতিক মনোনয়নের কারণে। একটি ভাইরাস থেকে যে এলোপাতাড়ি পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটে সেটি সংক্রমিত কোষগুলোর সঙ্গে এমনভাবে খাপ খাইয়ে যায়। যাতে রক্তবাহিকাগুলো অপর একটি রক্তকোষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে যুক্ত হয়ে পড়ার ফলে ফুসফুসের চারদিকে থাকা বিভিন্ন শ্রেণির প্রোটিনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। তবে যখন প্রাকৃতিক কারণে রূপান্তর ঘটে। অর্থাৎ যখন ভাইরালের সংখ্যা ও মাত্রার উপর ব্যাপকভাবে চাপ তৈরি হয়, তখন এই মারাত্মক অবস্থাকে অতিক্রম করে যেতে পারে ভাইরাসের প্রাকৃতিক রূপান্তর।
কিন্তু লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন, গিনিতে ইবোলা ভাইরাসের উপর এমন প্রবল চাপ তৈরি না হওয়ায় সেখানকার এই মহামারি ভাইরাসটির কোনো রূপান্তর ত্বরান্বিত হয়নি। ফলে যেকারণে এটি সেখানে ক্রমাগতভাবে ছড়িয়ে পড়ছে।
ভ্রমণ নিষিদ্ধ করলেই ইবোলার সংক্রমণ ঠেকানো যাবে?
ইবোলাবাহী বা সংক্রমিত এলাকার লোকজনের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করলেই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানো যায়। এটিও ধারণা ছাড়া কিছুই নয়। কারণ এ পর্যন্ত পুরো বিশ্বে একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রবলভাবে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেও ভাইরাস ঠেকাতে পারেনি। নয় এগারোর সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটি স্মরণকালের ভয়াবহ সতর্কতা জারি করে বিমান ফ্লাইট পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে দেয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের সবকটি বিমানবন্দরই দিনের পর দিন বন্ধ ছিল। অভ্যন্তরীণভাবে গুটিকয়েক মার্কিন কয়েক সপ্তাহর জন্য ভ্রমণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু এত কড়াকড়ির পরও বার্ডফ্লু ঢুকে পড়েছিল।
পরে যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি আরো বেশ কয়েকটি দেশেও বার্ড ফ্লু ও অন্যান্য ভাইরাসের প্রবেশ ঠেকাতে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে। বিশেষত সোয়াইন ফ্লু নিয়ে ফ্লাইট বন্ধ করা হয়। কিন্তু এই বন্ধ বা নিষেধাজ্ঞা কার্যকর ও ফলদায়ক হয়নি। ভাইরাস ঢুকে পড়ে।
ভ্যাকসিন কি ইবোলা থেকে রক্ষা করতে পারবে?
অনেকে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টাকেও মিথ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলেও এখনো এটি গবেষণার খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার একটি বৈজ্ঞানিক প্যানেল থেকে ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে একটি সবুজ সংকেত আসে। এরপরই ভ্যাকসিনকে সম্ভাব্য প্রতিরোধক হিসেবে ধারনা করা হচ্ছে।
কিন্তু ভ্যাকসিন তৈরিতে নানানরকম বিপদ ও ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হল ভ্যাকসিনের পরীক্ষা। সাধারণত আক্রান্ত কারো ওপর ভ্যাকসিনের নিরীক্ষা করা হয়। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবীদের উপর ভ্যাকসিন পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এটাকে অনেকে অন্যায় ও নিপীড়ন হিসেবে বিবেচনা করছেন। ২০১৫ সালের বসন্তের মধ্যে ভাইরাসটির চূড়ান্ত পরীক্ষা শেষ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলে হয়ত লাইবেরিয়া, সিয়েরালিওন ও গিনির বিপুল আক্রান্ত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ইবোলা থেকে রক্ষা পাবে।
উল্লেখ্য, ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার পর এখন পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ইবোলা আক্রান্ত হয়ে ৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তারা মনে করছেন, মৃত্যুর সংখ্যা এর চেয়ে বহুগুণ বেশি হবে।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট
লরিয়ে গ্যারেট: মার্কিন নীতি বিষয়ক প্রভাবশালী সাময়িকী কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশন্স এর সিনিয়র গবেষক
অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৪