ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সংস্কৃতিমন্ত্রী সমীপে একটি নদী আবেদন ।। পাভেল পার্থ

পর্ব ১/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪
সংস্কৃতিমন্ত্রী সমীপে একটি নদী আবেদন ।। পাভেল পার্থ ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ নদীমাতৃক। বাংলাদেশের নদীপ্রণালী এক জটিল জলসার্কিট তৈরি করেছে যা দুনিয়ার অন্য কোনো নদীপ্রণালী দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়।

একটি নদী কেবল একটি জলধারা থেকেই সৃষ্টি হয় না। অসংখ্য ছোট ছোট জলধারা থেকেই একটি নদী নানান অঞ্চলে নানান নামে ও পরিচয়ে প্রবাহিত হয়। নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠে স্থানীয় জনজীবনের কৃত্য, পার্বণ, শিল্প-সাহিত্য, পেশা, জীবিকা, উৎসব, বিনোদন, অর্থনীতি, যোগাযোগ ও যাপিতজীবন। বাংলাদেশে কতগুলো নদী ছিল বা বর্তমানে কতগুলো নদী বহমান আছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কোথাও নেই। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ২৩০টি নদীর ভেতর ৫৭টি প্রধান নদীর উৎস সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চল। তবে এশিয়াটিক সোসাইটি-বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, ছোট বড় মিলিয়ে ৭০০ নদী বাংলাদেশে জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশের সামগ্রিক নদী অঞ্চলকে মোট ১৭টি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলে ভাগ করেছে।

বর্তমানে দেশের সব নদ-নদীই করুণ যন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। মৃত, মৃতপ্রায় ও মুমূর্ষু। বিস্ময়করভাবে দেশের নদীমানচিত্র থেকে অনেক নদী আজ নিখোঁজ। নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, দখল, দূষণ, নদীর উপর অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, নদীর তীর সংরক্ষণ না করা, নদীর জায়গা সঠিকভাবে চিহ্নিত না থাকা, উজানে বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ ও সামগ্রিকভাবে নদী সম্পর্কিত উদাসীনতাসহ সবকিছু মিলিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ আজ নদীহীন হয়ে পড়ছে। নদীর এ করুণ পরিণতি সরাসরি ও কখনো পরোক্ষভাবে আমাদের সামগ্রিক জীবনে বিরূপ প্রভাব তৈরি করছে। কৃষি থেকে শুরু করে নদীনির্ভর পেশাসমূহ আজ হুমকির সম্মুখীন। এককালের নদীনির্ভর যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও আজ ভেঙে পড়েছে। নদীসমূহের এ দুঃখজনক পরিণতির দায়ভার আমাদের সবাইকেই নিতে হবে। কারণ বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে নদীর স্রোতবাহিত পলিতে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে নদীসমূহ রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাই মুক্তিযুদ্ধে ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’ এই শ্লোগান হয়ে ওঠেছিল বাংলাদেশের আরেক পরিচয়। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, জীবনযাপন, উৎপাদন, সংস্কৃতিসহ আজ ও আগামী প্রজন্মের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যই নদ-নদীগুলোকে নিজস্ব গতিপ্রবাহে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। নদীধারা জন্ম দিয়েছে এই জনপদের দর্শন ও সংস্কৃতির ভ্রুণ। নদীই নিরন্তর গড়ে তুলছে জনপদের বৈচিত্র্যময় আত্মপরিচয়ের নির্মাণ ও বিনির্মাণ। দেশে নানা নদী ঘিরে নানা সমাজে নানা নদীকৃত্য ও নদী আচার আছে। দেশের নদ-নদী সমূহের করুণ মৃত্যুমিছিল সরাসরি জনপদের বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক বিকাশ রুদ্ধ করে দিয়েছে। অথচ এ বিষয়ে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয় এখনো নির্বিকার। নদীসংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার সুরক্ষায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কেও আজ পরানের গহীন থেকে ডাক দিতে হবে।

নদীনির্ভর সংস্কৃতি এদেশের অনার্য নিম্নবর্গের আদি কৃত্যআচার। এখনও মুমূর্ষু ও মৃতপ্রায় নদ-নদীতে আয়োজিত হয় পুণ্যস্নান। গবেষক ডি ডি কোসাম্বীর মতে, পুণ্যস্নান ও বিসর্জন হলো নদীদেবীদের নিয়ে গড়ে ওঠা প্রাচীন ধর্মাচারের অবশেষ। কোসাম্বী ও আরেক সমাজবিজ্ঞানী পশিলুস্কির মতে এই জনপদে নদীপূজা মূলত অনার্য সংস্কৃতির অংশ। দেশের বৈচিত্র্যময় নদীসংস্কৃতির ব্যাকরণসমূহ একটু ঘাঁটাবাছা করলেই আমরা বিষয়টি স্পষ্ট ঠাহর করতে পারবো। সিলেট অঞ্চলের সুতাং, পিয়াইন, লংলা এরকম অভিন্ন আদি জলধারাগুলি সবই আদিবাসী খাসিদের অস্ট্রিক ভাষাজাত। ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ অন্যান্য ভাষাতত্ত্ববিদের মতে গঙ্গা শব্দটিও উৎপত্তি হয়েছে অস্ট্রিক ভাষা থেকে। ফরাসি পণ্ডিত জুল ব্লকের সাথে সহমত হয়ে তিনি বলেছেন, উম, অং, আং প্রভৃতি শব্দগুলো অস্ট্রিকভাষার জলবাচক শব্দ। উমিয়াম, উসমিয়াম শব্দগুলি যে সূত্র থেকে এসেছে গঙ্গা, গাঙ প্রভৃতিও একই সূত্র থেকে এসেছে। একইভাবে ইন্দোচীনের মেকংও এসেছে, যার অর্থ নদীমাতা। নদীদেবী ও নদীপূজা মূলত: অস্ট্রিকভাষী সংস্কৃতিরই একটি অংশ। বাংলাদেশে জলের দেবী হিসেবে গঙ্গা এবং পানির পীর হিসেবে খোয়াজ খিজির ও বদর গাজী এক নিম্নবর্গীয় সাংস্কৃতিক সমন্বয় তৈরি করেছে। পাশাপাশি আদিবাসী ত্রিপুরাদের তৈলুংমা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকার বুড়ারাই সকলেই নদীজীবনের উপাস্য।

বাংলাদেশের জেলেজীবনে জল ও মাছের রক্ষাকবচ গঙ্গা। গঙ্গার আরাধনায় গঙ্গা পূজা আয়োজিত হলেও বর্তমানে এই কৃত্য একেবারেই বিলীয়মান। এর অন্যতম কারণ নদীহীনতা। গঙ্গার আরাধনায় গড়ে ওঠেছে নদী অববাহিকায় নানান গীত। ঠিক যেমন খোয়াজখিজিরের মানতে আয়োজিত হয় বেড়া ভাসান উৎসব। কিন্তু নদীপ্রবাহের করুণ পরিণতিতে তাও আজ মৃত্যুর প্রহর গুণছে। নদীজীবনের সঙ্গে গড়ে ওঠা বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনী ও মনসার আখ্যান ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। নদীর প্রবাহ যেখানে গেছে, সেখানেই বাঁক নিয়েছে এই কাহিনী। মনসাকে কেন্দ্র করে শ্রাবণী পূজা, ভাসান, রয়্যানি কি পদ্মা পূজা সবই আজ বদলে যাচ্ছে। হাওরাঞ্চল ও টাঙ্গাইলে ভাসানযাত্রার আবহ ও আদল বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দেশের অনেক নদীতীর ও স্থল পবিত্র হিসেবে মান্য করা হয়। নদীকে ঘিরে আয়োজিত হয় অষ্টমী স্নান ও মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীর পুণ্যস্নান। চলমান নদীপ্রবাহের করুণ মৃত্যুতে ব্রহ্মপুত্র, যাদুকাটা, লাঙ্গলবন্ধের এসব পবিত্র নদীস্নান আজ কেবলি এক মুখস্থ আচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দূর্গোৎসব থেকে শুরু করে নানান পূজা-পার্বণের অন্যতম অনুষঙ্গ নদীতে প্রতিমা বিসর্জন। দেশের অধিকাংশস্থানে এই নিয়মটি বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে। নদ-নদী সমূহের মৃত্যু প্রতিমার বিসর্জনকৃত্যকে আজ পুকুর কি ভাগাড়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।

জলের দেশ, নাওয়ের দেশ হিসেবে এখন আর বাংলাদেশকে চেনার কোনো উপায় নেই। উন্নয়নের নামে ফালি ফালি করে কেটে চিরে হত্যা করা হয়েছে দেশের সকল আদি জলধারা। নদনদীর মৃত্যুর পাশাপাশি নিশ্চিহ্ন হয়েছে নদীপথ, জলকেন্দ্রিক জীবনসংস্কৃতি। হাওর-বিল-নদী নির্ভর জেলে, বেদে, মৌয়াল, বাওয়ালি, চুনারি, মাঝি, পাটনী জীবনযাপন যেমন বদলে যেতে বাধ্য হয়েছে তেমনি নিশ্চিহ্ন হয়েছে জলের জলযান নৌকা ঘিরে অন্যান্য ঐতিহাসিক উপস্থাপনা।

পাভেল পার্থ: গবেষক ও লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।