২৯ অক্টোবর উদীচী তার ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছে। উদীচী পরিবার, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীদের জন্য এ দিনটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
উদীচীর পথ চলার শুরুতে আমার একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা থাকতে পারে বলে এ লেখার অবতারণা। গণসঙ্গীত নিয়ে শুরু হলেও এখন উদীচী কর্মকাণ্ডে ১০-১২টি বিভাগ নিয়ে ব্যাপৃত। অনেক তরুণ কর্মঠ সদস্যরা উদীচীকে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এবং বিভিন্ন কারণে দেশের দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিক জনগণের বৈষয়িক সহায়তায়ও তারা এগিয়ে এসেছেন। কোনো শিল্পী সংগঠনের এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেখা যায় না। বন্যা-খরা, মঙ্গা, রানা গার্মেন্টস, বোমা হামলায় আহত-নিহত, দুর্দশাগ্রস্ত বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা- এদের সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে উদীচী, এ একটি গৌরবের বিষয়।
সারাদেশে আজ উদীচীর কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে রয়েছে, গান-কবিতায়-মানবসেবায় তারা নিয়োজিত। ঢাকা শহরেই আজ তার ১২টি শাখা। শুরুতে ঢাকায় জন্ম নেয়া উদীচীর যে সংগঠনটি তাতে মাত্র পাঁচ-ছয়জন সদস্য ছিল। আদমজি থেকে আসতেন আ. খালেক, আ. মতিনসহ তিনজন, মেস সদস্য আজকের প্রখ্যাত সাংবাদিক এহিয়া বখ্ত, ছড়াকার আখতার হুসেন, প্রয়াত সাংবাদিক আব্দুল করিম। মেস মালিক ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী, বঙ্গবন্ধু শিল্পী পরিষদ-এর সভাপতি প্রয়াত সাইদুল ইসলাম। বাসাটি ছিল দক্ষিণ মৈশুন্ডি। সাইদুল ইসলামের সঙ্গীত চর্চার আড্ডার মাধ্যমেই তার সাথে আমার পরিচয়। এই পরিচয়ের সূত্র ছিল আব্দুল করিম (হেলেন করিম)। আমরা দু’জনই সদ্য ইউনিয়ন কর্মী। একদিকে ইউনিয়নের কাজ, অন্যদিকে সঙ্গীত চর্চার চেষ্টা। স্বাভাবিকভাবে আমরা দু’জন গণসঙ্গীত চর্চায় ব্যাপৃত থাকতাম। একসময় মোখলেসুর রহমান সিধু ভাইয়ের র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের বাসায় গণসঙ্গীত শিক্ষার আয়োজন হলে আমরা দু’জন শহীদ আলতাফ মাহমুদের নেতৃত্বে কয়েকটি গণসঙ্গীত আয়ত্ত করি। সঙ্গীতগুলোর মধ্যে আই.পি.টি.এ’র গানই ছিল বেশি। ওই সঙ্গীত চর্চায় লোহানী ভাইকেও দেখতাম। তখন তার ‘ক্রান্তি’ তৈরি হয়নি। তখন কোনো গানের অনুষ্ঠান তেমন হতো না ঢাকায়।
যুবলীগের (ইমাদুল্লাহ, মো. সুলতান) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এককভাবে খালি গলায় গান করেছিলাম মনে পড়ে। ৮১, নওয়াবপুর রোডে। সম্ভবত ৫৬ সালের কোনো সময়ে। তখন সাইদুল ইসলাম থাকতেন লালচান মকিম লেনের (রথখোলা) একটি পুরনো মেসে। সেখানেই আমরা গানের চর্চা করতাম। পাক-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির কোনো অনুষ্ঠানেও গলা দেয়ার কাজটি আমরা ছাড়তাম না। সাইদুল ইসলামের রাজনীতিতে কোনো আগ্রহ ছিল না, সে ব্যাপারে সঙ্গী হতেন আব্দুল করিম। করিম সত্যেন দার খুব প্রিয় ছিলেন। ন্যাপ গঠন, আইয়ুবের সামরিক শাসন, হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিন বছর পর ধরা পড়া, জেলে যাওয়া- এগুলো অপ-সময়ও পার করতে হয়েছে।
পাকিস্তানী আমলে সাধারণ মানুষের শোষণ বিরোধী কোনো বক্তব্য বা গান অপরাধ ছিল। সেই ভুক্তানি আমাকেও সহ্য করতে হয়েছে। ধরা পড়ার পর (১৯৬০) আমার বইয়ের সাথে সাথে গণসঙ্গীতের খাতাসহ আমার বাংলা ডিকশনারি ‘সংসদ’টিও নিয়ে যায় পুলিশের লোকেরা। গানের খাতায় লেখা একটি গণসঙ্গীতের জন্য আমাকে তাদের দৈহিক অত্যাচারও সহ্য করতে হয়।
এহেন স্বৈরাচারী পাকিস্তানী আমলে ১৯৬৮ সালের এই দিনে আমরা উদীচী গড়ে তুলি। তখন ঢাকা শহরে সংস্কৃতি চর্চার তেমন কোনো প্রতিষ্ঠান দেখা যায়নি। তখন বিশেষ করে শ্রদ্ধেয় শেখ লুৎফর রহমানকে কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইতে দেখা যেত। সত্যেন দা তখন বাইরে। সংবাদ-এ বসেন। মস্কো-পিকিং ডামাডোলে আমরা তখন জেরবার। ঢাকায় লোহানী ভাইদের প্রচেষ্টায় তখন ‘ক্রান্তি’ শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র। দক্ষিণ মৈশুন্ডির সাইদুল ইসলামের বাসায় আমরা ক’জন বসি। তার হারমোনিয়াম ছিল। সেখানে একটি গানের আড্ডা ছিল মাত্র। কখনো সুযোগ হলে কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া যেতো। বিশেষ করে প্রেস শ্রমিকদের অনুষ্ঠানে। ১৯৬৭-৬৮ সাল। আমরা তখন সত্যেনদার প্রেরণা পেতে থাকি। তার লেখা গানও রপ্ত করি এবং সুযোগ পেলে অনুষ্ঠানও করতে থাকি।
তখন আমাদের সহযোগীদের মধ্যে আদমজীর তিনজন এবং রাজিয়া ছিলেন। টিম টিম করে ছোট্ট এ গ্রুপটি চলছিল। এর কিছুদিন পরই কয়েকজন ছাত্র এসে যোগ দেয়ার সাথে সাথে গ্রুপটি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তখন যোগদানকারীরা কেউ গানের লোক ছিলেন না। কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা ছিল তারা। তারা সবাই মনোযোগ দিয়ে যেমন গান শিখছিলেন তেমন গ্রুপটিকে দলে পরিণত করার প্রচেষ্টাও তারা নিয়েছেন। এ প্রেরণা এবং প্রচেষ্টার মূলেই ছিলেন সত্যেন দা। ছাত্রদের মধ্যে প্রথমে ছিলেন কামরুল বদরুল দুই ভাই। তাদের পথ ধরে পরবর্তীকালে আসেন মোস্তফা ওয়াহিদ খান, ইকরাম আহমদ, তাজিম সুলতানা, তিথী ও বোনরা। এরপর রিহার্সেলের স্থান বদল চলতে থাকে। আজ এ বাড়ি, কাল ও বাড়ি করে। অনেক আনকোরা শিল্পীর আগমনও ঘটতে থাকে, অনেক সখের গায়করাও এসে উদীচীকে সমৃদ্ধ করে তোলে। আজ তারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ পদের কর্মকর্তা, অবসর জীবন যাপনকারী। অথচ আড্ডায় বসলে হারমোনিয়াম না ধরে পারেন না। বৃদ্ধ বয়সে সত্যেন দাও আমাদের দলে পেছনে দাঁড়িয়ে কোরাস ধরতেন।
আজ ৪৬ বছর পর সারাদেশে উদীচীর গানের দল প্রতিটি জেলায় বিরাজ করছে দেখে আনন্দ বোধ করতেই পারি এজন্য যে, সত্যেন দার আদর্শে সম্পৃক্ত হয়ে উদীচী এখনো সজীব। উদীচী পথ হারায়নি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আমাদের কোনো দফতর ছিল না। গোপিবাগে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করে সঙ্গীত রপ্ত করতে হতো। তারপরই অনুষ্ঠান করতে পারতাম। শাসুন্নাহারের মদতে প্রথমে শিল্পী হাসেম খান, এরপর সাহেদ আলি, এম.পি মিজানুদ্দিন প্রমুখদের বাসায় ঠাঁই পাই। তখন অনেক ছাত্রকর্মী উদীচীতে যোগ দেন। তাদের মধ্যে সেন্টু রায়, গাজীপুরের হাবিব, জগলুল, মুনির, নার্গিস আরো ক’জন ছিলেন।
১৯৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর নিকট উদীচীর অফিস করার জন্য সত্যেন দা একটি বাড়ির জন্য গিয়েছিলেন। সত্যেন দার কথা শুনে বঙ্গবন্ধু নিজেই তাকে এগিয়ে নিতে এসেছিলেন। বলেছিলেন, আমাকে জানালেই তো হতো, আপনি কষ্ট করে না এলেই পারতেন। একেক করে কয়েকটি পরিত্যক্ত বাড়ি আমরা পেয়েছিলাম। অনুপযুক্ত বলে সেগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায়নি। আমরা শেষে স্থিত হয়েছি যেখানে আছি সেখানে। এটিও সরকারি বাড়ি। এখানে আমরা স্থান সংকুলানে হিমশিম হলেও ব্যাপারটি আমাদের নিজস্ব।
শিল্পকলা ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে অনন্য অবদানের জন্য উদীচী ২০১৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছে। এই বিরল সম্মানের অধিকারী হয়েছে দেশে এবং বিদেশে অবস্থিত উদীচী কর্মীরা। এই অনন্য সম্মান প্রদানের জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
গোলাম মোহাম্মদ ইদু: প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০১৪