শুক্রবার (০৭ নভেম্বর) বাংলানিউজে ‘এ চুমু বিপ্লবের নয়, হঠকারিতার’ শিরোনামের লেখাটি পড়ে মনে কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। প্রথমত, সম্মানীয় অতিথি লেখিকা মত প্রকাশ করেছেন, এই ‘চুমু বিপ্লব’ গ্রাম থেকে লড়াই করে শহরে পড়তে আসা মেয়েদের ঠেকিয়ে রাখবে।
প্রসঙ্গত, একটি ধারণা পরিষ্কার করা দরকার- পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শহরেই আসতে হবে পরিস্থিতি এমনটা নয়। পশ্চিমবঙ্গের ১৯টি জেলায় ১৮টি রাজ্যসরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এছাড়া, আছে একটি কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়। এগুলি ছাড়াও আছে ‘ডিমড ইউনিভার্সিটি’ এবং সরকার পরিচালিত বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়।
তাই গ্রামের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শহরেই পড়তে আসেন-এটা সঠিক ধারণা নয়। অবশ্যই বেশ কিছু পরিমাণ ছাত্রী শহরে পড়তে আসেন। কিন্তু ‘চুমু বিপ্লব’ গ্রামের ছাত্রীদের শহরে পড়তে আসার বাধা সৃষ্টি করবে বলে মনে করেছেন লেখিকা।
এখানে প্রশ্ন ওঠে, কেন? পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতে এর আগেও এই ধরনের অনেক আন্দোলন হয়েছে। নয়াদিল্লিতে ‘নির্ভয়া’ ধর্ষণ নিয়ে আন্দোলনের পর কি রাজধানী শহরে অন্যান্য জায়গা থেকে ছাত্রীরা আসা বন্ধ করে দিয়েছেন?
কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার পর কি পশ্চিমবঙ্গের মহিলারা পার্ক স্ট্রিট এড়িয়ে চলেন? নাকি এড়িয়ে চলার প্রবণতাকে সমর্থন করা উচিৎ? নাকি কলকাতায় ৭০ দশকের নকশাল আন্দোলনের ফলে গ্রাম থেকে শিক্ষার্থীরা কলকাতায় আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন?
কোনটাই নয়। বরং মানুষ ভরসা পেয়েছেন এই ভেবে যে, কলকাতা শহরের বিবেক এখনও জাগ্রত আছে। সেখানে অন্যায় হলে রাজনৈতিক দলগুলি ছাড়াও সাধারণ মানুষেরা প্রতিবাদে নামেন।
লেখিকা কন্যা ভ্রূণ হত্যার উদাহরণ সামনে এনেছেন। লিখেছেন, যে দেশে কন্যা ভ্রূণ হত্যা করা হয়, সেই দেশে এই ধরনের আন্দোলন সাধারণ মানুষের মতের প্রতিনিধিত্ব করে না। প্রসঙ্গত, ভারতের ১৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। তাই বলে কি ভারত আইটি শিল্পে উন্নতি করেনি। কোনো আন্দোলন সরাসরি প্রভাব বিস্তার না করলেও অপ্রত্যক্ষভাবে বিপুল পরিমাণ মানুষকে প্রভাবিত করে।
গত কয়েক দিন আগে তিউনিসিয়া নামক দেশটির ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে ‘আরব বসন্তের’ প্রভাবের কথা বুঝতে পারা যায়। আমরা দেখতে পাবো, কীভাবে তিউনিসিয়ার মানুষরা ধর্মকেন্দ্রিক একটি সরকারকে সরিয়ে প্রগতিশীল সরকারকে সমর্থন দিয়েছে।
ভুলে গেলে চলবে না-ভারতের তামিলনাড়ুর ২৪০টি গ্রামের মানুষেরাই মিলে এক বুক জলে দাঁড়িয়ে টানা ১৭দিন আন্দোলন করেছিলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। যা ‘জল সত্যাগ্রহ’ নামে গোটা বিশ্বে আলোড়ন ফেলেছিল। তেভাগা আন্দোলনের জন্ম কলকাতা শহরে হয়নি। হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে। তাই বৌদ্ধিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের গ্রামগুলি শহরের থেকে পিছিয়ে পড়া ভাবলে ভুল হবে।
লেখিকা জানিয়েছেন, আন্দোলন দিকভ্রষ্ট হয়েছে বলে খবর আসছে। খবরের ওপর ভরসা করে সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য থাকে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো-এই আন্দোলনের বিরোধিতা কলকাতায় ততটা চোখে পড়েনি, যতটা এর সমর্থন চোখে পড়েছে।
লেখিকা আরও জানিয়েছেন, বোরখার আড়াল মেনে নিয়ে তার ছাত্রীর পড়াশোনা চালাবার কথা। কিন্তু লেখিকা হয়তো ৯০ এর দশকের বিশ্বায়নের ফলে ভারতের সামাজিক পরিবর্তনের দিকটিকে নজর দেননি। বিশ্বায়ন ভারতের অর্থনীতিতে শুধুমাত্র প্রভাব বিস্তার করেছে-এমনটা নয়, ভারতের সামাজিক চরিত্রেও বড় পরিবর্তন এনেছে।
আর এই পরিবর্তনের ফলেই ভারতের সংখ্যালঘুদের বড় অংশ আধুনিক জীবনযাত্রাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন এবং তার সুফল ভোগ করছেন। ভারতের বড় অংশের মানুষ অনুভব করেছেন-অবগুণ্ঠন মুক্তির পথ নয়।
লেখিকা জানিয়েছেন, ‘আজকে গ্রামের মেয়েরা শহরে পড়াশুনা করতে আসছে’। কিন্তু এই আসাটা ‘আজকে’ নতুন নয়। এটা দীর্ঘদিন ধরেই ঘটে আসছে।
লেখিকা ইরানের প্রসঙ্গ হাজির করেছেন। কিন্তু ইরানের নারীদের অবস্থা দিয়ে ভারতের কোনো সামাজিক আন্দোলনকে বিচার করলে সঠিক হবে কি? কারণ সমাজে নারীদের সামগ্রিক অবস্থানের ক্ষেত্রে ভারত এবং ইরানকে একই সরল রেখায় রেখে বিচার করলে যথাহত ধারণা পাওয়া আদৌ সম্ভব কি?
প্রশ্ন আরও আসে। তালিবানি শাসনের বিরুদ্ধে আপোষ না করে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মালালা। নারীদের মুক্তির চিহ্ন হিসেবে কি আমরা তাকে বেছে নেবো। নাকি ইরানের নারীদের হিজাব পড়ে অলিম্পিকে দৌঁড়ান নিয়ে আমারা সন্তুষ্ট থাকবো?
এবার আসা যাক- কেন প্রকাশ্যে চুম্বনের কর্মসূচি নিলেন যাদবপুরের শিক্ষার্থীরা। কারণ, একটি রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে চুম্বনের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের কোচিতে ভাঙচুর চালানো হয়।
এই নীতিপুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এমন আন্দোলন। মনে রাখতে হবে, এই ভারতেই সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের আচরণের বিরুদ্ধে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মনিপুরের নারীরা। এখানে নগ্নতা শালীনতার মাত্রায় বিচার করলে ভুল হবে। এখানে নগ্নতা একটা প্রতিবাদের ভাষা।
১৯৬৩ সালে বিরমিনঘম জেল থেকে লেখা চিঠিতে মার্টিন লুথার কিং জুনিওর-এর একটি উক্তি এই প্রসঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক ‘The question is not if we will be extremists, but what kind of extremists we will be. The nation and the world are in dire need of creative extremists.’
এই ঘটনা শুধু যাদবপুরেই নয়, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা একটা কথাই বলতে চাইছেন, কোনো রাজনৈতিক দলের এই অধিকার নেই যে তারা কোনো নাগরিকের ব্যক্তি জীবনে নাক গলাবে।
তাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার। তারা জানাচ্ছেন ,রাজনৈতিক নেতাদের কথায় জনগণ চলবে না। বরং জনগণ তাদের নির্বাচিত করে পাঠিয়েছে। নেতারা জনগণের ইচ্ছাকে শেষ কথা বলে মান্য করবে।
এই আন্দোলনের মানে এই নয় যে শহরে প্রকাশ্যে চুম্বনের পক্ষে ওকালতি করছেন শিক্ষার্থীরা। এটি প্রতিবাদের একটি ভাষা এবং প্রতিবাদের এই ভাষা ভারতে বা পৃথিবীর বুকে প্রথম উচ্চারিত হচ্ছে না। সেটি একটু ভিন্ন ধরনের বলে হয়তো অনেকের গ্রহণ করতে সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু তাতে প্রতিবাদের যুক্তিটি বাতিল হয়ে যায় না।
লেখক
অরিন্দম চ্যাটার্জী
কলকাতা
** এই চুমু বিপ্লবের নয়, হঠকারিতার
বাংলাদেশ সময়: ২২০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৭, ২০১৪