ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

নভেম্বর বাঙালির গর্ব নয় কী?

তাওহীদ হাসান, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪
নভেম্বর বাঙালির গর্ব নয় কী? ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

নভেম্বর মাসকে কেন যেন কালের গর্ভ আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। ঘটনাবহুল মাস এটি।

২০০৭ সালের পর ২০১৪ সালকেও মানুষ সারাজীবন স্মরণ করবে হয়তো। দু’টি ঘটনার মধ্যেই মিল রয়েছে, রয়েছে বাঙালি বিপর্যয়, গর্ব।

আমার জীবনের অতি চমকপ্রদ বিষয়, ২০০৭ ও ২০১৪ সালের দু’টি ঘটনাই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বিচরণ করেছি ঘটনালব্ধ স্থানে। এবার জানা যাক ঘটনা দু’টি। ২০০৭ সালের আগে সাম্প্রতিক ঘটনা, ২০১৪ থেকেই ঘুরে আসি।

নভেম্বর ০১, ২০১৪। দিবসের প্রথম দিকে ঘটনাটি ঠাহর করতে পারিনি। ভেবেছিলাম রেগুলার মেইন্টেনেন্সের জন্যই লোডশেডিং। ধীরে ধীরে শুনতে পেলাম এক বিপর্যয়ের কথা। সেদিন মধ্যাহ্ন থেকে রজনী, রাস্তাতেই পার করতে হয়েছিল। প্রত্যক্ষ করেছি, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তায় নেমে আসা লাখো মানুষের মনোভাব। সেদিন আমাকে আবারও মনে করিয়ে দিয়েছে, আমরা আসলেই পৃথিবীর সেরা জাতি। স্বভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ রাস্তায় ছিল সেদিন। কই, কোথাওতো ছিনতাই-রাহাজানির বিস্ময়কর তথ্য পাই নি। আশুরার আগে বলে বেড়িয়ে এসেছিলাম মোহাম্মদপুর এলাকা থেকেও।

চলছিল আশুরার মহড়া। না, সেখানেও হয়নি কোনো বিশৃঙ্খলা। হঠাৎ করে এতো মোমবাতির যোগান না থাকাই অনেক বেশি স্বাভাবিক। তবে ব্যবসা চালিয়ে রাখার জন্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সামান্য মোমবাতি পর্যন্ত ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। কেউ নিজেরগুলো আগলে রাখেন নি।

অবশ্য মূল ঘটনা আমাদের সবারই জানা। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির ৫০০ মেগাওয়াট হাইভোল্টেজ ব্যাক টু ব্যাক ভেড়ামারা সাবস্টেশন বিকল হয়ে যায় সেদিন। এ সময় সারা দেশের সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র একযোগে ফেল করে। ধস নামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। ফলে জাতীয় গ্রিড লাইন ফেল করে দেখা দেয় চরম বিদ্যুৎ বিপর্যয়।

ঘটনাটির তুলনা করা যাক অন্য কোনো দেশের সঙ্গে, যেখানে বাংলাদেশের মতোই ঘটনা ঘটেছে। তাহলে সবচেয়ে আগে মনে পড়বে ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকার কথা।

জুলাই ১৩, ১৯৭৭। নিউইয়র্ক। এই সিটিতে এক নাগাড়ে ২৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বিভিন্ন স্থানে লুটতরাজ। রাস্তায় বন্দুকের দাগা। রাত যত বাড়তে থেকে অবস্থা হতে থেকে অধোগামী। ৮৯ বর্গ কিলোমিটারের এলাকা ম্যানহাটন হয়ে পড়লো সম্পূর্ণ অরক্ষিত। কারো জন্যই শহরটা নিরাপদ ছিল না সেদিন, তা পুলিশ অফিসারই হোক আর দমকল বাহিনী। গুলি ও ছুরিকাঘাতের ঘটনা সেদিন কোথায় ঘটেনি? বিজলিহীন নিউইয়র্কে এসব অরাজকতা হয়েছে মাত্র একদিনে। এমন বিদ্যুতহীনতা যদি শুধু নিউইয়ার্কে না হয়ে সমস্ত আমেরিকায় হতো? লুটপাট, অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো? নভেম্বর ১ এর পর থেকে আসলেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হয়। বাংলাদেশে জন্মে গর্ববোধ করি।

আসুন এবার সংক্ষিপ্ত বচনে শেষ করি ২০০৭ এর কথা।

নভেম্বর ১৫, ২০০৭ (রাত ১২টার পর তাই, নভেম্বর ১৫ হয়ে গেছে)। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হবে এমন সংবাদ আগে থেকে থাকলেও তার ভয়াবহতা যে এতো প্রকট তা কল্পণাতীত বৈ কি! সিডরের কবলে শুধু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ পড়লেও লোডশেডিং বরদাস্ত করতে হয়েছিল সারা দেশের মানুষকে।

অনেক দিন পর সারা দেশের মানুষ একসঙ্গে অন্ধকারে সময় কাটায় সিডরের কারণে। পরে যতদূর শুনেছি, খোদ জাতীয় গ্রিড নাকি ফেল করেছিল সেদিন!

আমার পাশের বাসা টিনেসেড হওয়ার পরও মানুষজন মাত্র ৬০ সেকেন্ডের পথ হেঁটে আমাদের দালানে আশ্রয় নিতে আসতে পারছিলেন না। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল। বীভৎস সে মুহূর্ততের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করা, লায়েক নয়। পরে শুনেছিলাম তারা রাতে ঘরের চাল দড়ি দিয়ে বেঁধে সবাই মিলে বসেছিল, উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রকট ছিল বলে। আমাদের বাড়িরও বেশ কয়েকটি গাছ সকালে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল।

সে ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যার বাস্তবতা হয়তো আরও সুদূর প্রসারী। ঝড়ের প্রভাবে প্রায় দশ লাখ ঘরবাড়ির কম ধ্বংস  হয়নি, ফসল নষ্ট হয়েছে কম করে হলেও একুশ হাজার হেক্টর। এক হিসাব অনুযায়ী, কেবল গবাদিপশু প্রাণ হারিয়েছে প্রায় তিন লাখের মতো। হিসাব মিলিয়ে হয়তো দেখা যাবে ক্ষয়-ক্ষতির বাস্তব চিত্র আরও একটু করুণ।

স্থানীয়রাই সর্বপ্রথম নিজেদের উদ্ধারে নিজেরাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। বেলা বাড়লে পরবর্তীতে যোগ হয় আশপাশের এলাকার লোকজন। সারা দেশ দুর্যোগের প্রস্তুতি নিয়েছিল বলে সরকারি সহায়তা পেতেও সময় লাগে নি। ঝড়ের পরেই বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৫টি জাহাজ ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকায় পৌছে যায়। সংবাদকর্মীরা নিরলস কাজ করেছেন, বিশ্ব অবয়বকে তাৎক্ষণিক ঘটনা জানানোর জন্য। এতো দিনে এ ক্ষতচিহ্ন একেবারেই মুছে যায় নি। প্রমাণ মিলবে, দক্ষিণাঞ্চল অভিমুখে যাত্রা করলেই। চারদিকের প্রকৃতিই দাঁড়িয়ে আছে সেই নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে।

আজ, ২০১৪। আবারও একবার স্মরণ করতে হবে, বাংলাদেশের মানুষের কথা। কোনো কিছুর অপেক্ষা না করে, প্রতিবেশীরাই যে সবার আগে এগিয়ে এসেছিল। এমন ঘটনাইতো ভুবনময় পাওয়াই বিরল! অহংকার বা দম্ভ করার মতো অনেক উপাত্ত রয়েছে আমাদের ঝুলিতে। অনেক কিছুই আমাদের অন্যদের চেয়ে স্বকীয় করেছে। পরিশ্রম আর মেধাতে আমরা বিশ্ব প্রসিদ্ধ অনেক আগে থেকেই। এখন শুধু অপেক্ষা, সততা আর নিষ্ঠা দিয়ে উন্নতির শীর্ষে আরোহণের। মনে বলছে, আমরা পারবই।

তাওহীদ হাসান
[email protected]


বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।