রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে শিক্ষককে কোপানো হয়েছিল, তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া গেলে হয়তো বাঁচানো যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রায় একইভাবে হামলার শিকার হয়েছিলেন শিক্ষক ও লেখক হুমায়ূন আজাদ।
হুমায়ূন আজাদের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় নিহত সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. সফিউল ইসলামের তুলনা করা ঠিক হবে না। তবে তিনি নিহত হওয়ার পর থেকেও ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে, সফিউল সাহেব জঙ্গি দ্বারাই আক্রান্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বলে কথিত শিবিরে বিভক্ত শিক্ষক সমাজের মধ্যে তিনি প্রথম পক্ষের লোক ছিলেন। নিজ বিভাগে ও ক্লাসে ছাত্রীদের পর্দা করে আসার প্রকাশ্য বিরোধিতা নাকি করতেন। দু’তিন বছর ধরে এ অধ্যাপক লালনভক্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। জীবনধারাও কিছুটা পাল্টে ফেলেছিলেন। প্রতি সপ্তায় নিজ বাসভবনে লালন গানের আসর বসাতেন আর তাতে ওই সংক্রান্ত আলোচনাও হতো। মনে করা হচ্ছে, এসব কারণেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন।
দিনেদুপুরে ওই শিক্ষকের বাসভবনের খুব কাছে ওভাবে হামলা চালিয়ে খুনিরা তার সমগোত্রীয়দের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। ঘটনাটি রাজনৈতিক চরিত্রসম্পন্ন হলে সেটা আলোচনায় আসবে বৈকি। একজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে যদি দশজনকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলা যায়, তাহলে হত্যাকারী ও তাদের নেপথ্য নায়কদের উদ্দেশ্য সাধন সহজ হয়ে পড়ে। ভিন্নমত অবলম্বন ও ভিন্ন জীবনধারা যারা অপছন্দ করে, জোর করে সবাইকে নিজেদের জীবনধারায় ঢোকাতে চায়, তাদেরকেই আমরা বলি মৌলবাদী। ধর্মকে অবলম্বন করে যারা এটা করতে চায়, তাদের বলা হয় ধর্মীয় মৌলবাদী বা জঙ্গি। অধ্যাপক সফিউলকে এদেরই কোনো অংশ খুন করে থাকলে অবাক হওয়া যাবে না। ফেসবুকে নতুন নাম ধারণ করা এমন একটি গোষ্ঠী সে রকম দাবি করেছে ইতোমধ্যে।
ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা পেশাগত কারণেও দু’চারজন লোক তাকে খুন করে এমন একটা ধূম্রজাল তৈরি করতে পারে। রাজধানীতে মিলকী নামে যুবলীগের এক নেতাকে রাস্তায় গুলি করে হত্যার সময় একই দলের অপর নেতা পাঞ্জাবি-টুপি পরে নিয়েছিল— যাতে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে, ওই রকম একটা লোককে তারা গুলি করতে দেখেছে। পুলিশও তাতে হয়তো বিভ্রান্ত হবে। ওই ঘটনায় দ্রুতই হত্যাকারী ধরা পড়েছিল অবশ্য এবং দুর্ভাগ্যজনক যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। মিলকী হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে ক্ষমতাসীন দলের লোকদেরই টানানো ব্যানার-পোস্টার দেখতে পাই আজও। কারণ সে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের বিচারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। মূল হত্যাকারী দ্রুত নিহত হয়ে পড়ায় মামলাটি দুর্বল হয়ে পড়েছে, এটা বোঝাই যায়। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষককে কুপিয়ে হত্যার মামলায় কী ঘটবে, আমরা জানি না। এ লেখা তৈরি পর্যন্ত কেবল এলোপাতাড়ি ধরপাকড়ের খবর পাচ্ছি।
নিহত শিক্ষকের বাসায় তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকা তার বিভাগের এক ছাত্রীকেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। এ নিয়ে কিছু ‘গসিপ’ হয়েছে মিডিয়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়ও একই ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে বলে খবর মিলছে। নিহত শিক্ষক কয়টি বিয়ে করেছিলেন এবং শেষদিকে তিনি একা থাকতেন— প্রভৃতি খবরও গুরুত্ব পাচ্ছে অনেকের কাছে। তদন্তকারীরা স্বভাবতই তার নিহত হওয়ার ক্ষেত্রে সব সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখবেন। তবে এর সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাকেই তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন এখন পর্যন্ত। শিক্ষকের ব্যবহৃত সেলফোনের তথ্যগুলো তদন্তকে সহজ করে দিলেও দিতে পারে। এখন কথা হল, তিনি যে কারণেই খুন হয়ে থাকুন— এটি বড় ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, তার বাসভবনের খুব কাছে দুই খুনি একজন অধ্যাপককে কুপিয়ে ফেলে রেখে নির্বিঘ্নে চলে যাবে, এটা মেনে নেয়া যায় না। খুনিরা চলে যাওয়ার পরও নাকি লোকজন সেভাবে এগিয়ে আসেনি এলাকায় সুপরিচিত ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে। ‘ঝামেলা’য় জড়ানোর ভয়েই বোধহয় হাসপাতালের বদলে আগে তাকে নেয়া হয় নিকটস্থ র্যাব কার্যালয়ে। এসবে বোঝা যায়, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনপ্রতিরোধ ভেঙে পড়েছে এবং প্রশাসনের ভূমিকায় শান্তিপ্রিয় মানুষের আস্থা অপসৃত। সবাই তাই গা বাঁচিয়ে চলতে পছন্দ করছে। এতে সন্ত্রাসীদের বাড় আরও বাড়বে বলেই মনে হয়। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল এলাকায় সংঘটিত ন্যক্কারজনক ঘটনাও সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আরও দু’জন সিনিয়র শিক্ষক প্রায় একইভাবে নিহত হয়েছিলেন। তার একটিতে নিম্ন আদালত পর্যন্ত হওয়া বিচারে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। উচ্চ আদালতে সেটি কনফার্ম হয়ে এরই মধ্যে তাদের সাজা কার্যকর হয়ে গেলে ভালো হতো। সে খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে উল্টো তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়া যেত না-কি? অপর ঘটনা একই প্রকৃতির হলেও দেখা যাচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা খাটেনি। প্রাথমিক রায় অনুযায়ী, একই বিভাগের অন্য এক শিক্ষক প্রমোশন নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে হত্যা করান অধ্যাপক এস. তাহেরকে। এতে একজন ইসলামী ছাত্রশিবির নেতা জড়িত হলেও তেমন কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে এমন হীন মানসিকতাসম্পন্ন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের আর জানা নেই। জীবনের ছোটখাটো বিষয়ে বিরোধে জড়িয়ে খুন-খারাবি পর্যন্ত ভাবা এবং তা বাস্তবায়ন করাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যায়ে কতটা ন্যক্কারজনক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজে মূল্যবোধের ধস এ ধরনের ঘটনায় তীব্র ও বিশেষভাবে প্রকাশিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হত্যার লোমহর্ষক ঘটনায় যদি প্রাথমিক অনুমান ঠিক না হয়; যদি দেখা যায় রাজনীতি বা আদর্শ-সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনো কারণে তিনি নিহত হয়েছেন, তাহলে কি বলব— এটা নিয়ে হৈচৈ করে আমরা ভুল করেছিলাম? তা নয়, কেননা হত্যাকাণ্ড মাত্রই অপরাধ এবং এর পক্ষে কোনো অজুহাত খাড়া করা চলবে না। কথিত বহুগামিতা ঘিরেও অধ্যাপক যদি নিহত হয়ে থাকেন, তাহলেও তার হত্যাকারীদের ধরে উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। এ ধরনের আলোড়ন সৃষ্টিকারী হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুততার সঙ্গেও হওয়া দরকার। তার খবর ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়া প্রয়োজন। তাতে এসব ঘটনায় ভেঙে পড়া নিরাপত্তাবোধ কিছুটা হলেও ফিরে আসবে। আর এ ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা থাকলে তো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সেটার তদন্ত করতে হবে এবং এর নেপথ্যের লোকদেরও খুঁজে বের করা চাই। অধ্যাপক সফিউল যে মতধারার লোকই হোন, আইন মেনে সেটি চর্চা ও সে মতো জীবনযাত্রার অধিকার তিনি রাখেন। তার মতো মানুষ তো সমাজে আরও রয়েছেন ও থাকবেন। এদের সবার জন্য স্বস্তিকর হয়, এমন বার্তা দিতে হবে ঘটনাটি তদন্তে নিয়োজিতদের। বর্তমান শাসনামলে ধর্মীয় উগ্রবাদী বা জঙ্গিদের ‘দৌড়ের ওপর’ রাখা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। রাজশাহীর সর্বশেষ ঘটনায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে এলে কিন্তু বুঝতে হবে, তারা প্রত্যাঘাত শুরু করেছে। আমাদের মনে আছে, রাজশাহী বেল্টেই বেপরোয়া জঙ্গি সংগঠন জেএমবির উত্থান হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ঘটেছিল সেটা। শুরুতে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও পরে তাদেরই এর বিরুদ্ধে দমন অভিযান শুরু করতে হয়। কিন্তু তাতে কেউ ভুলে যায়নি এদের প্রশ্রয়দানে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের ভূমিকা।
অধ্যাপক সফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে রাজশাহী অঞ্চলে সক্রিয় জামায়াত-শিবিরকেও দায়ী করা হচ্ছে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের চলমান ঘটনায় এক ধরনের হতাশায়ও রয়েছে এরা। হতাশা থেকেও তাদের মধ্যে যে হঠকারিতার জন্ম হতে পারে না, তা নয়। তবে এদের চেয়েও উগ্রবাদী একাধিক গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে দেশে। এদের কোনো কোনোটিকে রীতিমতো নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আদর্শগতভাবে বিরোধী পক্ষের সোচ্চার লোকদের টার্গেট করে আঘাত হানা ও পরিকল্পিত হত্যায় তারা নেমেছে, এর প্রমাণ কম নেই। আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী নয় আর এতে অনেক গোলমালও হয়েছে। তবু যেটুকু গণতন্ত্র চর্চা আমরা করছি, তাতেও এমন অসহিষ্ণুতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বরদাস্ত করার কোনো সুযোগ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ শিক্ষক হত্যাকাণ্ডে যে অভিযোগ করছেন বিশেষত তার সহকর্মীরা, সেটি খতিয়ে দেখে তাদেরসহ আমাদের সবাইকে সরকার যেন যথেষ্টভাবে আশ্বস্ত করে। অধ্যাপক সফিউল হত্যার বিচার তো অবশ্যই চাইব এবং জানতে চাইব, কেন এমন একজন তরতাজা মানুষকে এত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল। আবারও বলছি, তিনি অন্য কারণেও খুন হয়ে থাকতে পারেন।
এটাও খতিয়ে দেখা দরকার, অন্য কারণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসলে কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীই তাকে হত্যা করেছে বা করিয়েছে কিনা। অধ্যাপক সফিউল জাতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তি না হলেও তাকে দিনেদুপুরে ও নৃশংসভাবে হত্যা করে হয়তো একটা মেসেজ দিতে চেয়েছে জঙ্গিরা। বহুত্ব যে একটি সমাজের শক্তি এবং বৈচিত্র্য যে এর সৌন্দর্য— এটা বুঝতে যারা অক্ষম, তাদের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। এরা অনেক সময় নিরীহ মানুষ খুন করে অর্থাৎ ‘সফ্ট টার্গেটে’ আঘাত হেনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজেদের লক্ষ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে চায়। অধ্যাপক সফিউল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে সেটা থাকতে পারে; নাও পারে। কোনো ‘ফিক্সড পারসেপশনে’ না থেকে আমি চাইব, এর তদন্ত সঠিক খাতে প্রবাহিত হোক আর আমরা যেন সত্যটা জানতে পারি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১৪