নগর পরিকল্পনার ছাত্র হিসেবে সবসময় নগর সমস্যা নিয়ে গবেষণা ও কাজ করতে হয়। সারা পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নগরের জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এবং সেইসাথে নগরের সুযোগ সুবিধার উপর প্রচণ্ড চাপ বাড়ছে ।
এই প্রোগ্রামে প্রায় ২০ টি মেগাসিটির বিভিন্ন ইস্যুর উপর গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপিত হয় । যেমন, টোকিও, মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতা, ঢাকা, লন্ডন, প্যারিস, ম্যানিলা, নিউইয়র্ক, সানপাওলো, ওসাকা, কায়রো, বেইজিং, সিউল সহ আরও অন্যান্য মেগাসিটি থেকে প্রতিনিধিরা অংশ নেয়। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিল নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, নগর ব্যবস্থাপক, প্রকৌশলী, গবেষক, পিএইচডি প্রার্থী, অধ্যাপক ও নগর বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
যে সব ইস্যুর উপর গুরুত্বারোপ করা হয় সেগুলো হল; পরিবহন ব্যবস্থা, মেগাসিটির রূপান্তর, মেগাসিটির নাগরিক সমস্যা, বস্তি জীবন উন্নয়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, স্মার্ট সিটি, মেগাসিটির ভবিষ্যৎ। পাশাপাশি বয়স্কদের জন্য নাগরিক সুবিধা হাতের নাগালে পৌঁছানোসহ নানা বিষয়ের ওপর আলোচনা হয় ।
আমার গবেষণা পত্র ছিল যে “ঢাকা শহরের নাগরিক সমস্যা গুলো কিভাবে কমুনিটি বেসড অর্গানাইজেশন(সিবিও) গুলো সমাধান করে যাচ্ছে” তার উপর। এই গবেষণায় ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা, পানির সঙ্কট, ট্রাফিকজ্যাম নানা সমস্যা উঠে এসেছে এবং এইসব সমস্যা সমাধানে স্থানীয় কমুনিটি সংস্থাগুলো কাজ করে যাচ্ছে। কারণ ঢাকার নানান সমস্যা সমাধানে সিটি কর্পোরেশন তেমন কোন ভূমিকা রাখছে না এবং সেইসাথে তারা তাদের সমস্যা সমাধানে সরকারিভাবে কোন সাহায্য পান না । এইসব কমুনিটি বেসড অর্গানাইজেশন(সিবিও) গুলো নানা ধরনের কাজ করে আসছে ।
যেমন আমার গবেষণার এলাকার কমুনিটি বেসড অর্গানাইজেশনটি এলাকার রাতে নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ, আবর্জনা পরিষ্কার, আবর্জনা সংগ্রহ, রাস্তা সংস্কার, নলকূপ স্থাপন, পয়ঃনিষ্কাশন, বিনাখরচে শিক্ষাদান,সালিশ করে বিচার করা, কারিগরি শিক্ষা প্রদান, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান, বন্যা ও দূর্যোগে ত্রাণ বিতরণসহ নানা ধরনের সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে । আর সেই কমুনিটি বেসড অর্গানাইজেশন(সিবিও)টির নাম হোসনে দালান সমাজ কল্যাণ সংস্থা(পঞ্চায়েত নামেও পরিচিত), এটি প্রতিষ্ঠিত হয় পুরান ঢাকার হোসনে দালান এলাকায় ১৯৪০ সালে ।
এই সংস্থা হয়ত কাজ করে আসছে স্বেচ্ছায় কিন্তু ঢাকায় নাগরিক সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করছে প্রতিনিয়ত, কারণ ঢাকার নিস্ক্রিয় সিটি কর্পোরেশন, নেই কোন মেয়র, নেই কোন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফলে স্থানীয় সমস্যা দেখার কেউ নেই । এই যেন ঢাকায় বসবাসকারীদের জন্য এক অভিশাপ এবং অভিভাবকহীন ঢাকা শহর । যেখানে সারা দুনিয়াতে মেগাসিটিগুলোতে নগর ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতি বের করে নাগরিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে এবং নগরকে বসবাস উপযোগী করছে ।
আর এইদিকে ঢাকা হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বসবাসের অনুপযোগী শহর অর্থাৎ নিকৃষ্ট শহর । ঢাকা বসবাসের উপযোগী করতে সরকারের তেমন কোন তদারকি নেই, ঢাকায় যতটুক পরিকল্পনা মাফিক হয় তা বেসরকারিভাবে। যেমন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা ঢাকায় একমাত্র পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা যেখানে নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান। এই পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার বিকল্প নেই ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে ।
এইবার আসি কলকাতা শহরের কথায়, কলকাতা বা কোলকাতা,ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বৃহত্তম শহরযা হুগলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এবং কলকাতার জনসংখ্যা ২ কোটির কাছাকাছি। এই জনসংখ্যার বিচারে কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ও দ্বিতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটান বা মহানগরীয় অঞ্চল এবং বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম মহানগর অঞ্চল ।
কলকাতা শহরের প্রসিদ্ধি এই শহরের বৈপ্লবিক আন্দোলন ও সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য এবং কলকাতা শহরে বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষদের শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় এই শহর। কলকাতার শহরে অনেক ভবন ও স্থাপনা গথিক, ব্যারোক, রোমান, প্রাচ্য, ও মুঘল স্থাপত্য সহ অন্যান্য ইন্দো-ইসলামীয় শৈলীর মোটিফ দ্বারা সজ্জিত। এই শহর রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ,রোনাল্ড রস, সুভাষচন্দ্র বসু, মাদার তেরেসা, সত্যজিৎ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সি ভি রামন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের কর্মভূমি কলকাতা মহানগরী তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য আজও অনেক পরিচিত যা রাস্তায় ঘুরলে বোঝা যায় ।
শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে বিধাননগর (অন্যনামে সল্টলেক বা লবনহ্রদ) কলকাতার একটি পরিকল্পিত স্যাটেলাইট টাউনশিপ গড়ে তুলেছে রাজ্য সরকার। জ্যোতি বসু নগর নামে আরও একটি পরিকল্পিত টাউনশিপও কলকাতার উত্তর-পূর্ব দিকে গড়ে উঠছে ।
কলকাতার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল শহরের ছোটো ছোটো অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পাড়া সংস্কৃতি। সাধারণত প্রত্যেক পাড়ায় একটি করে ক্লাবঘরসহ নিজস্ব সংঘ বা ক্লাব আছে। ক্লাবগুলোর নিজস্ব খেলার মাঠও আছে। পাড়ার বাসিন্দারা অভ্যাসগতভাবে এখানে এই সব ক্লাবঘরে আড্ডা দেন।
কলকাতার বাঙালিদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মাছের ঝোল এবং এর সঙ্গে রসগোল্লা ও সন্দেশ নামে দুই ধরনের মিষ্টি ও মিষ্টি দই বাঙালিরা বিশেষ পছন্দ করে। রাস্তার ফুটপাথের খাবারের মধ্যে বেগুনি, রোল (চিকেন, মাটন, এগ বা সবজি), ফুচকা বিশেষ জনপ্রিয়।
এইবার আসা যাক পরিবহনের কথায় , কলকাতায় একটা জিনিস ভাল লেগেছে তা হল ট্যাক্সি গুলো মিটার ধরে চলে এবং যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায়। বাস পরিবহন খুব ভাল এবং রাস্তায় তেমন হালকা জ্যাম থাকলেও সময় ধরে চলাচল করা যায় । নগরবাসীর জন্য আছে মেট্রো রেল যা মানুষের যাতায়াত করেছে খুব সহজতর। দিনের বেলায় শহরে অনেক ব্যস্ততা দেখা গেলেও ঠিক অফিস ছুটির পর কলকাতা শহর ফাঁকা হয়ে যায় ।
ব্রিটিশদের পরিচালিত ট্রাম এখনও কলকাতা শহরে যাতায়াত করে। একজন পর্যটক খুব সহজেই ট্রামে করে ঘুরে কলকাতা দেখতে পারে। অর্থাৎ কলকাতায় বিভিন্ন রকমের গণপরিবহণ মাধ্যম সুলভ বলে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা অন্যান্য শহরের তুলনায় অল্প এবং সেই সাথে কলকাতা মেট্রোরেল এবং একাধিক নতুন রাস্তা ও উড়ালপুল শহরের যানজট সমস্যার সমাধানে অনেকটাই সাহায্য করছে।
ঘুরতে গিয়েছিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলে বা ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় অবস্থিত রানি ভিক্টোরিয়ার একটি স্মৃতিসৌধ। এটি বর্তমানে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধ একটি জাদুঘর এবং কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ। বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন। কলকাতা ময়দানের দক্ষিণ কোণে অবস্থিত এবং সুরম্য উদ্যান পরিবেষ্টিত শ্বেতপাথরে নির্মিত সুবৃহৎ ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নির্মাণকার্য শুরু হয় ১৯০৬ সালে।
আমার সুযোগ হয়েচিল সেই বিখ্যাত মান্নাদের কফি হাউসে যাওয়ার, উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট চত্বরে এটি অবস্থিত ও বাঙালির-আড্ডাস্থল । এইখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভীর করে এক কাপ কফি খাওয়া ও আড্ডা দেওয়ার জন্য। নিকটতম বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলির ছাত্রছাত্রীদের ভিড় করা ছাড়াও নামিদামী বুদ্ধিজীবী লেখক, সাহিত্যিক, গায়ক, রাজনিতীবিদ, পেশাদার, ব্যবসায়ী ও বিদেশি পর্যটকরা আসে আড্ডা দিতে। একটু সামনেও ছিল কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ যা ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি কলকাতায় হিন্দু কলেজ নামে স্থাপিত হয়।
কলকাতায় এসেছি ঠাকুরবাড়ি দেখব না তা তো হতে পারে না । সময় করে ঘুরতে গিয়েছিলাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে । এইখানেই রয়েছে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ।
এছাড়াও অনেক জায়গায় ঘুরেছি শহরকে দেখেছি কিভাবে তাদের শহরগুলো চলে এবং তাঁদের নগর ব্যবস্থাপনা । এক কথায় তাঁদের নেই কোন রাজনৈতিক অস্থিরতা, নেই কোন ভেদাভেদ। তাঁরা তাঁদের শহরকে বাসযোগ্য গড়ে তোলার জন্য সবাই একমত এবং সব কিছুর উর্ধে উঠে কাজ করছে। পরিকল্পনার কাজ পরিকল্পনাবিদ করছে, আর্কিটেক্ট এর কাজ আর্কিটেক্ট করছে, প্রকৌশলীর কাজ প্রকৌশলীরা করছে অর্থাৎ যার যে কাজ সে করছে কিন্তু আমাদের ঢাকায় সেই সব প্রতিষ্ঠানে সব পদে সেইসব টেকনিক্যাল লোক নেই, দেখা যায় একজন পরিসংখ্যান/ভূগোলবিদ করে নগর পরিকল্পনার কাজ, তাহলে এই শহরের সমস্যা কিভাবে দূর হবে ??
যার কাজ সে যদি না করতে পারে তাহলে এই শহর বাসযোগ্য হবে কিভাবে ?? আমাদের ঢাকাকে সামনে ৫০ বছর পর কেমন দেখতে চাই তা ভাবতে হবে। এখনি সময় ঢাকাকে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলার, শুধু পরিকল্পনা বানিয়ে রেখে দিলে হবে না প্রয়োজন পরিকল্পনার শতভাগ বাস্তবায়ন।
লেখক: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী।
ইমেইলঃ [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৮১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৩, ২০১৪