ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

আবারো জয়ী প্রান্তিক দর্শক

তুষার আবদুল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৪
আবারো জয়ী প্রান্তিক দর্শক ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

আফসোস, শাহজাহানপুরে গভীর নলকূপে জিহাদের পড়ে যাওয়া এবং তার মৃত্যুর ২৩ ঘণ্টায় ঢাকায় ছিলাম না। আবার সৌভাগ্যবানও মনে করছি, প্রথমবারের মতো দর্শকদের সঙ্গে বসে এমন একটি শ্বাসরুদ্ধকর ইভেণ্ট দেখার সুযোগ পাওয়ায়।

কুড়িগ্রামে ধরলা, ব্রহ্মপুত্রের বুকে জেগে ওঠা চরে বসে প্রথম খবর পাই-শাহজাহানপুরের রেলওয়ে কলোনিতে ওয়াসার তৈরি গভীর গর্তে পড়ে গেছে জিয়াদ/জিহাদ/জিয়া নামে একটি শিশু। গর্তটি কতো গভীর তাৎক্ষনিক ভাবে সে আন্দাজ না পাওয়া গেলেও প্রথমে শুনি গর্তটি তিনশ ফুট গভীর; ক্রমশ তা ছয়শ ফুটে পৌঁছে। এই সব খবর কেবল আমি যে টেলিভিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেটির মাধ্যমেই পাচ্ছিলাম তা নয়, সব চ্যানেলেই দেখেছি ঘুরে ঘুরে। চায়ের দোকান, প্রেসক্লাব,রেস্টুরেন্ট, আবাসিক হোটেল সর্বত্র দর্শকরা উৎকণ্ঠায় ছিলেন গর্তে পড়ে যাওয়া শিশুকে নিয়ে। ও বেঁচে আছে কিনা, দমকল বাহিনী ঐ রকম একটি গর্ত থেকে শিশুটিকে তুলে আনতে পারার সক্ষমতা রাখে কিনা, এমন একের পর এক প্রশ্ন উঠছে আমার আশপাশে। কুয়াশায় ডুবে যাওয়া কুড়িগ্রামের রাত যতো গভীর হয়েছে, ততোই জানা গেছে ওয়াসার পরিত্যক্ত গভীর নলকূপেই খেলতে গিয়ে পড়ে গেছে জিহাদ। তার নাম, বাবার পরিচয় জানা গেলেও পাইপের গভীরতা নিয়ে অঙ্কের গড়মিল ছিলই। জানিয়ে রাখছি, টেলিভিশনে চোখ রাখার পাশপাশি চোখ ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। সংবাদভিত্তিক চ্যানেলসহ বিভিন্ন চ্যানেল যখন সরাসরি শাহজাহানপুরে আছে, এবং সেখান থেকে রিপোর্টাররা উদ্ধারকাজের সর্বশেষ অবস্থা জানাচ্ছেন,তখন ফেইসবুকে দেখতে পাই একটি বড় অংশই এই লাইভ কভারেজ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ মন্তব্য দিয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।

লাইভ কভারেজকে বাড়াবাড়ি বলা থেকে শুরু করে অন্যায়ও বলেছেন কেউ কেউ। যাদের কথা বলছি হয়তো তারা সমাজের ভদ্রজন!কিন্তু কুড়িগ্রামের কৃষক, দিনমজুর, অটোচালকদের দেখলাম উল্টো প্রতিক্রিয়া-তারা চ্যানেল থেকে চ্যানেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দেখছেন কারা কোন তথ্যটি আগে দিচ্ছে, কে কেমন ছবি দেখাচ্ছে। দর্শকরা টেলিভিশনগুলোর ভুল যে ধরেননি তা নয়। গর্তের গভীরতা, উদ্ধার পদ্ধতি নিয়ে রিপোর্টারদের ধারা বর্ণনা শুনে তারা নিজেরাও বিতর্কে জড়িয়েছেন। তবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো লাইভ নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেননি। বরং তারা এই বিষয়ে সবাই একমত ছিলেন গণমাধ্যম ঘটনার সঙ্গে আছে বলেই সরকারি সংস্থাগুলো কাজে ফাঁকি দিতে পারবে না, ছেলেটিকে উদ্ধার না করে যাবার সুযোগ পাবে না। চরের মানুষেরা রানা প্লাজা এবং বিভিন্ন লঞ্চডুবির উদাহরণ টেনে এনে বললেন, রানা প্লাজায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো রাত-দিন ছিল বলেই উদ্ধার অভিযান থেকে সটকে পড়তে পারেনি কেউ।

ধরলা, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসেই ওখানকার আমদর্শকরা বুঝতে পেরেছিলেন উদ্ধার কাজে জড়িত সংস্থাগুলো যা তথ্য দিচ্ছে, টেলিভিশনগুলো কেবল তা-ই জানাচ্ছে। আমি নিজেও এর বাইরে খুব একটা যেতে দেখিনি কোনো টেলিভিশন রিপোর্টারকে। সকল টেলিভিশনকে আরো একটি বাড়তি চাপ সামলাতে হয়েছে। দর্শকরা উদ্ধার পদ্ধতিতে সন্তুষ্ট না হতে পেরে সরাসরি টেলিভিশনগুলোতে ফোন করে জানাচ্ছিলেন-নিজ নিজ কৌশল বা পদ্ধতির কথা। উদ্বিগ্ন হয়ে পরামর্শ দেয়ার পেছনের যুক্তি ছিল, দুর্যোগে সাধারণ মানুষের চেষ্টা বা কৌশলই নাকি শেষ পর্যন্ত কাজে দেয়। রাত গড়িয়ে সকাল, দুপুর হতে হতে শিশু জিহাদ উদ্ধার অভিযান নানা দিকে বাঁক নিতে থাকে। দমকল বাহিনী, সিটি করপোরেশন এবং স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এক সুরে  পাইপের ভেতরে জিহাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বসলেন। জিহাদের বাবা’কে আটক করা হলো। এই সময়টা ফেইসবুক ‘ফানবুক’এ রূপ নেয়ার পথে। জিহাদের কণ্ঠ শোনা, জুস খাওয়া নিয়ে যেমন রঙ-তামাশা শুরু হয়ে গেলো, তেমনি জিহাদের অস্তিত্ব নিয়েও রাজনীতির নকশা তৈরির জাল বোনা শুরু হয়েছিল ফেইসবুকে। ওদিকে কুড়িগ্রামের চরের মানুষেরা বলে যাচ্ছেন- সাংবাদিকরা যেনো ঘটনাস্থল থেকে না সরেন। উদ্ধার অভিযান স্থগিত ঘোষণা করার পর তাদের আলোচনার বিষয় ছিল: ‘‘সাধারণ মানুষদের একবার চেষ্টা করে দেখার সুযোগ দিলে হয় না?’’ জিহাদ উদ্ধার অভিযানের ফলাফল এসেছে ঐ পথেই।

কুড়িগ্রাম থেকে শনিবার মধ্যরাতে ফেরার সময় দীর্ঘ যানজটে আটকা পড়ি যমুনাসেতুর উপর। দুই ঘণ্টার সেই যানজটে আটকে থাকা সময়ে আড্ডার সঙ্গী ছিলেন ট্রাকচালকরা। তাদের মুখে কথা একটিই--মিডিয়া লেগে ছিল বলেই, মৃত হলেও জিহাদকে উদ্ধার করা গেছে। না হলে ওয়াসা, দমকল পাইপের মুখ আটকে দিতো। জিহাদকেও পাওয়া যেতো না। ওর বাবাকে জেলেই হয়তো ঢুকিয়ে দেওয়া হতো। কুড়িগ্রাম থেকে যমুনাসেতু, আমি কেবলই শুনে গেছি। কোনো মন্তব্য প্রশ্ন করিনি কাউকে। এখন করতে চাই, করবো?করেই ফেলি: ‘গণমাধ্যমের প্রান্তিক দর্শকদের থেকে আর কতো পিছিয়ে পড়বেন নগরের চিন্তামনস্ক দর্শকেরা? সরকারের সেবা সংস্থাগুলোতে দক্ষতা ও ভাবনারও রাজনীতিকরণ হয়েছে, তেমনি নগর দর্শকদের চিন্তার জায়গাটিতেও রাজনৈতিক বিভাজন ঘটে গেছে। যেই বিভাজন থেকে এখনো নিরাপদ দূরত্বে প্রান্তিক দর্শকেরা। সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করে যাওয়ার ভরসার জায়গা এখানেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।