১৮ ফেব্রুয়ারি (২০১৫) অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় ম্যানুকা ওভালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-আফগানিস্তানের মধ্যকার ক্রিকেট ম্যাচে ধারাভাষ্যকার প্যানেলে ছিলেন- পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার রমিজ রাজা, ভারতের সুনীল গাভাস্কার, সৌরভ গাঙ্গুলী ও হারশা ভোগলে এবং অস্ট্রেলিয়ার ম্যাথু হেইডেন।
ধারাভাষ্যকারদের মধ্যে পাকিস্তানি রমিজ রাজার কথাবার্তা ছিল রীতিমত বাংলাদেশি খেলোয়াড়দের প্রতি অবহেলা, উন্নাসিকতা, জ্বালাধরা টাইপ এবং পক্ষপাতিত্বের দোষে দুষ্ট।
পক্ষান্তরে পাকিস্তানি কানঢাকা রমিজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে একাই লড়েছেন প্রিন্স অব কলকাতা সৌরভ গাঙ্গুলী।
টসে জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং বেছে নিল। যথারীতি মাঠে এবং মাঠের বাইরে সারা পৃথিবীর বাংলাদেশিরা গলা ফাটানো চীৎকারে উল্লাস প্রকাশ করছে। টিভি ক্যামেরা মাঠের দর্শকদের দিকে মনোযোগী হলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে। মাঠে উপস্থিত পনেরো ষোল হাজার দর্শকের মধ্যে ৮০% থেকে ৯০%ই বাংলাদেশি। গ্যালারি জুড়ে শুধু লাল-সবুজের উপস্থিতি।
অতঃপর টাইগারদের মতো করে বুকে হাত রেখে জাতীয় সংগীত গাইলো ষোল কোটি বাংলাদেশি। বলার অপেক্ষা রাখে না, ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশিদের জন্য মর্যাদার লড়াই। ভীষণ আবেগের দিন। কারণ একে তো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ, জয় দিয়ে একটি শুভ সূচনার প্রত্যাশার চাপ, তাছাড়া গত এশিয়া কাপে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আফগানিস্তানের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ স্পৃহা।
বাংলাদেশের খেলোয়াড়, দর্শক, সাংবাদিক সবার মধ্যে স্নায়ুবিক চাপ ছিল উল্লেখ করার মতো। মাঠের দর্শক মাঠে আর বাইরের দর্শক টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ, ধারাভাষ্য থেকে কান সরাতে পারেনি, এক মুহূর্তের জন্যও। আমি মাঠের বাইরের দর্শক, সিংগাপুর থেকে টেলিভিশনে খেলা দেখেছি।
যথাসময়ে তামিম ইকবাল এবং আনামুল হক বিজয় ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন। চারদিকটা আবার ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠলো। টেলিভিশনে তখন রমিজ রাজা ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। তিনি আফগানিস্তান টিমের প্রশংশায় যারপরনাই পঞ্চমুখ। তিনি আফগান ক্যাপটেন মোহাম্মদ নবী সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলতে বলতে আফগান টিমের প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলছেন, কিন্তু বাংলাদেশ সম্পর্কে লক্ষনীয় ভাবে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু বলেননি। ভাবখানা এমন যে, এই ম্যাচে আফগানিস্তানই বিরাট ফেবারিট।
সাকিব-তামিম বিহীন বাংলাদেশ দলের এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের কাছে হেরে যাওয়াটাই যেন কানঢাকা রমিজের কাছে এক বিরাট মওকা। বারবার এশিয়া কাপের কথা তুলে বাংলাদেশকে দুর্বল প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করাই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান।
হঠাৎ বাংলাদেশের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই তিনি বললেন, ‘ওহ! ঢাকায় ভয়ংকর ট্রাফিক জ্যাম, ম্যাচ শুরুর অনেক আগে মাঠে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দিতে হয়েছিল’ (ওহ! বাংলাদেশ, টেরিবল ট্রাফিজ জ্যাম ইন ঢাকা। উই হ্যাড টু স্টার্ট...’)।
আমার পাশে বসা এক দর্শক সাথে সাথে দিলেন এক গালি, ‘আরে ঐ হালার পুত, তোর কাছে কেউ ঢাকার ট্রাফিক জ্যাম কেমন, তা জিজ্ঞেস করছে? কাবুলে প্রতিদিন তালেবানরা কয়টা বোমা ফাটায়, তুই তা কইছোস? তোর দেশ পাকিস্তানে তো পৃথিবীর কোনো দেশের টিম এখন খেলতেই রাজি হয় না। একমাত্র তোরাই বিদেশি ক্রিকেটারদের উপর গুলি চালিয়েছিস। ’
সৌরভ গাঙ্গুলী অবশ্য সাথে সাথেই রমিজ রাজাকে মনে করিয়ে দেন, ঢাকার মিষ্টি বিকেল এবং উৎসবপ্রেমী মানুষের কথা।
কানঢাকা রমিজ রাজা তার ধারাভাষ্যের পুরো সময়টা যখন যেভাবে পেরেছেন, আফগানিদের হিরো বানিয়েছেন। বাংলাদেশিদের ব্যাপারে ছিলেন নেতিবাচক সমালোচনামুখর, উদাসীন, মাঝে মাঝে বাংলাদেশিদের ব্যাপারে অপ্রাসঙ্গিক কথাও বলেছেন। তার অপ্রাসঙ্গিকতার একটি উদাহরণ- বাংলাদেশের ওপেনার আনামুল হক এর নামে কেন আবার ‘বিজয়’ লাগানো? এ ধরনের ‘পেট নেইম’ নাকি শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায়।
এবার আমার পাশে বসা আরেকজন বললেন, ‘নামের ব্যাপারে তুই কি জানোস? তুই এখন যে মাঠে বসে আছিস, তার গ্যালারির একটা স্ট্যান্ডের নাম ‘বব হুক স্ট্যান্ড’। এই ‘বব’ মানে কি জানিস? ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতে রবার্টকে পেট নেইম হিসেবে ‘বব’ ডাকা হয়। ‘উইলিয়াম’কে ‘বিল’ ডাকা হয়, উইলিয়াম জেফারসন ক্লিনটনকে তাই সংক্ষেপে বিল ক্লিনটন বলা হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘ভিক্টরিয়া’ কে ডাকা হয় ‘ভিকি’। নেলসন ম্যান্ডেলার ডাক নাম ‘মাদিবা/মাডিবা’। আবারও সৌরভ গাঙ্গুলী সাথে সাথে রমিজ রাজাকে বুঝিয়ে দেন ‘বিজয়’ মানে ‘ভিক্টরি’।
আফগানিস্তান টিম সম্পর্কে এতো কথা বলার পর রমিজের ফেবারিট টিম ১০৫ রানের বিরাট ব্যবধানে বাংলাদেশের কাছে হেরে গেল। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চ প্রস্তুত। কানঢাকা রমিজ মঞ্চে হাজির। তিনি প্রথমেই ডাকলেন, আফগানিস্তানের অধিনায়ক মোহাম্মদ নবীকে।
রমিজ রাজা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার নবী একজন বিরাট ক্রিকেটার, বিরাট হিরো, বিরাট স্টার বলতে থাকলেন। কিন্তু নবীর মধ্যে তেমন কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। নবী মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলে এবার কানঢাকা রমিজ বললেন, ‘এখন আমার চাকরি বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তুজাকে ডাকা। ’ (নাউ ইটস মাই ডিউটি টু কল দি ক্যাপ্টেন অব বাংলাদেশ, মাশরাফি বিন মোর্তুজা)। ভাবখানা এমন যে, চাকরি করে বলে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের অধিনায়ককে ডাকতে হচ্ছে, নইলে জীবনেও ডাকত না। ’ যথারীতি আমার পাশের দর্শকরা গালি দিতে শুরু করেছেন, ‘তোরে চাকরি দিছে কোন শালায়? তোরে জানি আর না দেখি...। ’
উল্লেখ্য, ইতোপুর্বে ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটার নভোজ্যত সিং সিধু তার ধারাভাষ্যে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল। শাস্তিস্বরূপ তাকে ইএসপিএন ধারাভাষ্য প্যানেল থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। আইসিসি’র বর্তমান সভাপতি একজন বাংলাদেশি, জনাব লোটাস কামাল।
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের মাধ্যমে বাংলাদেশের লাখো কোটি মানুষের এই ক্ষোভের কথা কি তার কাছে পৌঁছুবে? উদ্ধ্যত এই ধারাভাষ্যকারের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা কানঢাকা পাকিস্তানি রমিজ রাজাকে বাংলাদেশের কোনো ম্যাচে ধারাভাষ্যকার হিসেবে দেখতে চাই না।
লেখকঃ কথাসাহিত্যিক, একাডেমিক, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৫