মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আসসালাম ওয়ালাইকুম। আশাকরি আপনি সর্বাঙ্গীণ কুশলে ও মঙ্গলে আছেন।
অভিজিৎ রায়ের হত্যার আজ প্রায় পঁচিশ দিন পার হয়ে গেলো। খুনিরা ধরা পড়লো না, এমনকি কারা খুন করেছে তাদের নামও জানা গেলো না। আমাদের এতো দক্ষ পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী থাকা সত্ত্বেও একের পর এক হত্যাগুলো এমনি সমাধান না-হয়ে রহস্যের জালে আটকা পড়ে এক সময় নিভৃতে চলে যায় আর রচনা করে নতুন আর একটি হত্যার ক্ষেত্র। সাগর-রুনী, আহমেদ রাজীব হায়দার, ত্বকী, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস, আশরাফুল আলম, আরিফ রায়হান দ্বীপ ...।
যে-দেশের জনতার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্যে তিরিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে সে-দেশের মানুষ বলে কি এটাই তাহলে নিয়তি বলে ধরে নিতে হবে আমাদের? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এসব কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আপনার কি মনে হয় না, বুদ্ধিজীবী হত্যার যে-পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল একাত্তরে, এগুলো তারই অংশ? সুপরিকল্পিতভাবে দেশ থেকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার, প্রতিবাদ করার কণ্ঠ বিলুপ্ত করে দেয়ার যে-চেষ্টা একাত্তরে শুরু হয়েছিল, সেই একই লোকজন একই কাজ আবার এই স্বাধীন বাংলায় চালিয়ে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয় না, একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা না-হলে হয়তো পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা এতো সহজ হতো না? বঙ্গবন্ধু হত্যার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন তাঁরা করতে পারতেন এবং তাঁর বিচার আরো ত্বরান্বিত হত? একাত্তরের পরাজিত শক্তি এতোদিন বাংলাদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারতো না।
যারা একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে তাদেরই নীল নকশায় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। বেঁচে থাকে নি আপনার ছোট্ট ভাই রাসেলও। তাদেরই একাংশ আপনার ওপর একুশে আগস্ট গ্রেনেড ছুঁড়েছে এবং এখন আপনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে ক্ষতি করার পরিকল্পনা করছে। সব একই সূতোয় গাঁথা। বারে বারে তারা আঘাত করছে কারণ তারা হত্যায় বিশ্বাসী এবং মুক্তচিন্তা আর মুক্তবুদ্ধির মানুষকে তারা তাদের পথের কাঁটা মনে করে। তারা হুমায়ূন আজাদকে কুপিয়েছে, আহমেদ রাজীব হায়দারকে মেরেছে, তারা অভিজিৎ রায়কে খুন করেছে কারণ তারা প্রগতিশীল, মুক্তকণ্ঠ রোধ করে দিতে চায়। তারা এখানেই থেমে থাকবে না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তারা আস্তে আস্তে আরো সামনে অগ্রসর হবে। দেশের জনগণ যেমন নিরাপদ নয় তাদের হাত থেকে, তেমনি নিরাপদ নন আপনি কিংবা আপনার পরিবার।
আপনি উগ্র মৌলবাদীদের সাথে আপোষকামী বা ধীরে চলার যে-নীতি হয়তো গ্রহণ করেছেন, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জনগণ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আপনি এবং হয়তো তাদের পরবর্তী টার্গেট আপনার পরিবারও। একটার পর একটা অন্যায়ের সাফল্য তাদের পরবর্তী অন্যায়ের পরিকল্পনা করতে দ্বিগুণ উৎসাহ যোগাবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তিতে অত্যন্ত ধীরে চলা নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, চুয়াল্লিশ বছর যারা অপেক্ষা করছে তারা আর কতো কাল অপেক্ষা করবে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়া অন্যায়ের শাস্তি পেতে! যে-সন্তান একাত্তরে ভূমিষ্ঠ হয় নি সে এখন চল্লিশ পার করা তরুণ, অপেক্ষায় আছে স্বাধীন দেশে তার বাবার হত্যাকারীর শাস্তি দেখার। চুয়াল্লিশ বছরের অপেক্ষা কী যথেষ্ট নয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
তেমনি অপেক্ষায় আছে সাগর-রুনীর ছেলে মেঘ, অভিজিৎ রায়-এর পরিবার আর তার সাথীরা, রাজীবের পরিবার ও বন্ধুরা, অধ্যাপক এম তাহের, প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া, জগৎজ্যোতি তালুকদার সর্বোপরি দেশের ষোল কোটি জনতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, করজোরে প্রার্থনা আপনার দরবারে, আমাদের নিরাশ করবেন না। জনগণের পাশে দাঁড়ান। একবার অন্তত প্রমাণ করুন, জনগণের জন্যে রাজনীতি, রাজনীতির জন্যে জনগণ নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদেশ দিন তাদের দায়িত্ব পালন করতে, জনগণের করের টাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে। ভারতের দিল্লিতে ধর্ষিতা হওয়া জ্যোতির অপরাধীদের ধরতে দিল্লি পুলিশের সময় লেগেছিলো মাত্র দু’দিন। অভিজিৎ রায়ের হত্যার আজ কুড়ি দিন অতিবাহিত হচ্ছে। এ-ব্যর্থতার লজ্জা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শুধু একার নয়, এ লজ্জা আমার, আপনার, পুরো বাংলার জনগণের।
আপনি নিরাপদে থাকুন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আপনিই আমাদের শেষ আশা। আপনার সর্বাত্মক সৌভাগ্য ও নির্বিঘ্ন নিরাপত্তা কামনা করছি।
তানবীরা তালুকদার, নেদারল্যান্ডস প্রবাসী, বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় [email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৫৫১ ঘণ্টা, মার্চ ২১, ২০১৫