ডর্টমুন্ড (জার্মানি) থেকে: গত বছরের মাঝামাঝি সময়কার কথা। জার্মানির নর্থ রাইন-ওয়েস্টফেলিয়া রাজ্যের ছোট্ট এক শহরে থাকছি।
একদিন ডিনারের আগে গিয়ে দেখি, পঞ্চাশোর্ধ ওলা (অনুমতি না থাকায় পুরো নাম লিখছি না) কাঁদছেন। ওলা, হ্যোয়াট হ্যাপেন্ড? আমার এমন প্রশ্নে যেন তার কষ্ট যেন আরও বেড়ে গেলো।
‘ফিফি ইজ ডাইড। মাই বেবি ইজ ডাইড। ’ ও মাই গড! কখন-কীভাবে? তার বয়স কত হয়েছিল? ওলা জানালো, ১৬ বছর। আমি বললাম, এতো কম বয়সে কীভাবে মারা গেলো? কী অসুখ হয়েছিল? ডাক্তারের কাছে নাও নি? না, ইমার্জেন্সিতে কল দিয়েছিলাম। ডাক্তার জানিয়েছে, সে আর বাঁচবে না। বয়সও অনেক হয়েছে। বলে কি! ১৬ বছর অনেক বয়স? জিজ্ঞেস করলাম, লাশ কোথায়? এরপর ওলা বললেন, কিচেনের পেছনে। চলো তোমাকে দেখাই। এটা শুনে আমি আরও অবাক হলাম। লাশ কিচেনের পেছনে কেন? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই যখন কিচেনের পেছন দরজা দিয়ে বের হলাম, তখন আমার চোখ যেন ছানাবড়া! একটি বিড়াল পড়ে মরে আছে। আরও সিওর হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, ইজ সি ফিফি? চোখ মুছতে মুছতে ওলার ছোট্ট জবাব- ইয়া।
এরপর ওলা আমাকে বললো, সে এখন তার সৃষ্টিকর্তার কাছে ফিফির জন্য প্রার্থনা করবে। কাজ করার মনমানসিকতা নেই। আমিও যেন প্রার্থনা করি। আমি বললাম, কাল আমাদের ঈদ। ঈদের দিনে আল্লাহ দোয়া বেশি কবুল করে। আমি প্রার্থনা করবো। ওলা জানালো, ফিফির বাচ্চাও অসুস্থ। প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে তাকে নিয়ে হাসপাতালে যাবে। পারলে আমিও যেন তার সাথে যাই। আমি ওলার মনের অবস্থা দেখে এক বাক্যে বললাম, অবশ্যই যাবো। যা-ই হোক, শেষপর্যন্ত আমাকে আর যেতে হয় নি। কিন্তু সেদিনের এ ঘটনা দেখে আমি ওলাকে বললাম, তুমি জানো যে, আমি একজন সাংবাদিক। তোমার কোনো অসুবিধা না থাকলে আমি এটি আমাদের দেশের মিডিয়ায় লিখতে চাই। সে বললো, লিখতে পারো তবে আমার পুরো নাম দিও না। একটি সাধারণ প্রাণীর জন্য ওলার ভালোবাসা দেখে আমি তার কিছু ছবিও তুলে রাখলাম। তারও প্রায় একবছর পর দেখছি কুকুর-বিড়ালসহ প্রাণিকুল কিংবা প্রকৃতির প্রতি জার্মানদের কি অপরিসীম ভালোবাসা!
আমার তৎকালীন চাকরির বর্ণনা কিংবা জার্মানদের কুকুর-বিড়ালপ্রীতির গুণগান করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আসছি আসল কথায়। ইউরোপে এর আগের একাধিক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থাকলেও এবারেরটা অন্যরকম। জার্মানদের খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে কেবল এবারই। কঠোরভাবে নিয়ম মেনে চলা এ জাতির মানুষ যে কতটা মানবিক তা বলে বোঝানো যাবে না। তবে তাদের মানবিকতার বর্ণনাও এ লেখার উদ্দেশ্য নয়।
হাজার হাজার মাইল দূরে বসে আমার প্রিয় বাংলাদেশে যে অমানবিকতা দেখছি তার বিরুদ্ধে দুটি কথা বলবার জন্যই এতো বিশাল ভূমিকা। আপনারা জানেন কি-না জানি না, তবে আমি জানতাম না। মানুষ কোনো পশু-প্রাণিকে এতোটা ভালোবাসতে পারে। আর এর বিপরীতে আমরা ‘মানুষ’ হয়েও মানুষের ওপর পশুর নির্মম আচরণ করি। গরু-জবাইয়ের মতো করে মানুষ জবাই করি! জবাই করে মানুষ মারি। কুপিয়ে জখম করি। খাবলে মাংস তুলে নিই। হায়েনার মতো নারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি।
কেমন সমাজে আছি আমরা? আমাদের দেশেই কেবল পুড়িয়ে মানুষ মারা যায়! এসিড দিয়ে ঝলসে দেওয়া যায়! কিন্তু দোষীর বিচার হয় কদাচিৎ!
মাস দুয়েক আগে ব্লগার অভিজিৎকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। এর মাস যেতে না যেতেই আরেক ব্লগার ওয়াসিকুরকে একই স্টাইলে মারা হলো। কোনো ‘মানুষ’ কোনো মানুষকে এভাবে মারতে পারে তা পৃথিবীর অনেক দেশের মানুষই কল্পনা করতে ভয় পায়। কিন্তু একটি স্বাধীন আর গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকরা আমরা যখন প্রায়শই এমনটি ঘটাচ্ছি তখন তাকে আর সভ্য দেশ কি বলা যায়?
পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে ঘটনাটি ঘটানো হলো তা নিয়ে যে ‘নাটক’ এখনও চলছে তাতে ঘেন্নায় লাগে। রাগে-ক্ষোভে গা জ্বলে। দোষীদের আড়াল করতে নানান মহল নানান কথা বলছে, রঙ-চং মাখছে। কিন্তু যারা এমনটা করছেন, ঘটনা অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করছেন- তার স্ত্রী, কন্যা কিংবা বোনও যে আগামীকাল এমন ঘটনার শিকার হবেন না, তা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারছি না।
এ ধরনের ঘটনায় দুঃখ ও লজ্জা প্রকাশের ভাষা জানা নেই। বাংলাদেশের মানুষের জীবনের দাম কি এতোই কম! একই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে বাস করেও, একই রক্ত-মাংসের মানুষ হয়েও আমার দেশের লাখো-কোটি মানুষ পৃথিবীর অন্যপ্রান্তের তুলনায় কতটা নিগৃহীত! ভাবতেই অবাক লাগে, ওলার বিড়াল ফিফি কতটা সুন্দর জীবন কাটিয়েছে- আমার দেশের লাখো মানুষের চেয়ে!
লেখক: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৫
জেডএম/