সত্যি, ভিডিও ফুটেজটি খুব বেশি সময় নিয়ে দেখা যায় না। একদল ছেলেপেলে কৌশলে মেয়েদেরকে ঘিরে ধরেছে, রিকশা থেকে একটা মেয়েকে জোড় করে টেনে নামাচ্ছে।
কারা করছিল এই কাজটি? না, দৃশ্যটা ২৬ মার্চ ১৯৭১ এর নয়, এরা কেউ কোন পাকিস্তানি সেনাও নয় অথবা এরা কেউ তালেবানি কোন কট্টরবাদীও নয়। তাহলে এরা কারা? ভাবতেও লজ্জা লাগে, এরা আমার-আপনার মতই ভদ্রবেশি বাঙালি সমাজভুক্ত প্রাণী। এদের কারো পড়নে সুন্দর ফিনফিনে পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, কেউ পরে আছেন সুন্দর ফুলহাতা শার্ট—রীতিমত সাহেবি ভাবসাব। পোষাক-আশাক দেখে কল্পনা করতেও কষ্ট হয় যে এই ভদ্র পোষাকের নীচে কত কদর্যতার বাস। আশ্চর্য হই এই ভেবে, এরা আমাদের সমাজের সব জায়গায় কেমোফ্লাক্স হয়ে মিশে রয়েছে। আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, পহেলা বৈশাখে যে নেক্কারজনক ঘটনা ঘটলো তা ৭১-এর পাকিদের বর্বরতাকেও হার মানায়। পাকিতো পাকিই। এদের আবার জাত কী? কিন্তু আমরা? আমরা তো নিজেদের সভ্য বাঙালি বলে গর্ব করি। তাহলে ৭১-এর চেতনা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিলাম? দুঃখজনক যে আমরা আমাদের সন্তানদের কে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে বেড়ে উঠার মন্ত্র শেখাতে পারি নাই। আর সে কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের মত একটি জাতীয় উৎসবেও আজ আমার মা বোনরা নিরাপদ নয়। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এটি আমাদের জন্যে চরম লজ্জার আর বেদনার ছাড়া আর কিছুই নয়।
যে জাতি তার নৈতিক চরিত্র উন্নত করতে পারে না সে জাতির কপালে যে অপার দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের প্রজন্মদের কথাই ধরি। তারা কতটুকু বাঙালি হতে পারছে? তারা তাদের ছোট্ট ধমনীতে কতটুকু নিজ সংস্কৃতি লালন করে? ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশে এখন শুধু ইংরেজি মিডিয়াম, আর ইংরেজির চর্চার ছড়াছড়ি। ইংরেজি শিখতে আপত্তি নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের আত্মিক যোগাযোগ কতখানি তাওতো দেখার বিষয়! পাশাপাশি এ প্রশ্নও আসতে পারে, আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে কতটুকু নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারছি।
চারদিকে তো দেখতে পাই পশ্চিমের নগ্ন অনুকরণ। একটা উদাহরণ দিই—গত মাসে ছুটিতে ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে লিটল ইতালি নামে একটি পিৎজার দোকানে আমরা কয়েক বন্ধু পিৎজা খেতে গিয়ে ঘটলো ঘটনাটা। আমাদের ঠিক পাশের টেবিলে একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে পিৎজা খাচ্ছিল, সঙ্গে সম্ভবত তার মা। মেয়েটির পড়নে সালোয়ার কামিজ। না, ভাববেন না কোন রকম উগ্র পোষাক পরে সে বসেছিল। এমন সময় দেখতে পেলাম চার পাঁচজনের ছেলে-ছোকরার একটি দল হৈ হৈ করে রেস্তোঁরায় ঢুকে পড়ে। আমাদের অন্য পাশের টেবিল দখল করে উচ্চস্বরে তারা ভুল-ভাল ইংরেজিতে কথা বলছিল। এরা মোটামোটি সবাই পাশের টেবিলে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে আড়চোখে বিভিন্ন ভাষায় (শারিরিক ভাষা এবং মুখের ভাষা) মেয়েটি অত্যুক্তি করতে শুরু করে দিল। অবস্থা বেগতিক দেখে মা মেয়েকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন। এবার আমি ছেলেগুলোর দিকে ভালো করে তাকালাম। বুঝতে পারছিলাম, এরা হয়তো স্থানীয় কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-টাত্র হবে। এদের একজনের কান, চিবুক, ফোটা করে তামার রিং লাগানো। একজনের মাথায়, যুক্তরাষ্ট্রের তারকাখচিত রুমাল। এদের ভাষা শোনার জন্যে কান খাড়া করে রাখলাম। তাদের কথাবার্তা শুনে আমার কাছে এদের পরিচয় স্পষ্ট হলো না। এমনকী এদের অভিবাবকদের পরিচয় কি? তারা কি জানে তাদের সন্তানরা কোন নর্দমার পথ দিয়ে হাঁটছে?
এবারের পহেলা বৈশাখে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে যদি খুব জলদি এর অনুকরণীয় বিচার না হয়, তাহলে বুঝতে হবে এই জাতির সামনে আরো বিপদ অপেক্ষা করছে। মনে রাখতে হবে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, আইন প্রয়োগকারীদের কার্যক্ষমতা বাড়ানো, মানবাধিকার এবং সর্বোপরি মানুষের অধিকার এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিশ্চিত না করা গেলে আমরা সামনের দিকে এক পা-ও এগিয়ে যেতে পারবো না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি সেখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তাদের কাজ যথাযথভাবে করেন বলেই সেখানে সাধারণ মানুষ নিশ্চিত জীবনযাপন করতে পারেন। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। গোটা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টির খুব শিগগীরই একটি সুন্দর নিস্পত্তি করা। ভিডিও ফুটেজ ধরে ধরে অপরাধীরে সনাক্ত করা এবং দ্রুত বিচারের সম্মক্ষিন করা। আমরা বাংলাদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে বসে সেই বিচার দেখার আশায় উন্মোখ হয়ে বসে আছি।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী, লেখক, প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৫