ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জটিল ভোটের অংক ও আগামী পাঁচ বছরের সহজ সমীকরণ

রাশেদ মেহেদী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৫
জটিল ভোটের অংক ও আগামী পাঁচ বছরের সহজ সমীকরণ

এক. একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের ভোটের অংক জটিল হয়ে উঠেছে। নির্বচানী প্রচার শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের সহজ জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল থাকলেও শেষ সপ্তাহে এসে সেই দলীয় সমর্থিত প্রার্থীদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে খোদ আওয়ামী লীগই।



খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে ধারাবাহিক হামলার ঘটনা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের বেশ কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নিবেদিত কর্মী-সমর্থকরাও বেশ হতাশ হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঘোর সন্দেহ, আওয়ামী লীগ পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পারলে ২৮ এপ্রিলের ভোটও অবাধ, সুষ্ঠু হবে না! সেক্ষেত্রে গায়ের জোরেই দল সমর্থিত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনবে সরকারি দল।  

অথচ গত তিন মাস ধরে পেট্রোল বোমায় মানুষ পুড়িযে মারার চরম নিমর্মতায় বিএনপিকে জনগণের ঘৃণার আগুনেই পুড়ছিল। এ নির্বাচনে সেই বর্বরতার ছবি ভোটারদের ঘরে আওয়ামী লীগ- ‍ৎযুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা যদি নিয়ে যেত, যদি ভোটারদের বার বার মনে করিয়ে দিত বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণাকাতর মুখচ্ছবিগুলোর কথা, তখন ভোটারদের সামনে একটা নৈতিক প্রশ্ন উঠত, বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিলে কি এই নিরপরাধ দ্বগ্ধ মানুষগুলোর সঙ্গে বেঈমানি করা হবে না?

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা সেই পথে যায়নি। কারণ ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়ার কাজটা বেশ কষ্টের। সকাল-সন্ধ্যা অনেক পরিশ্রম হয়। আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা এখন সেই পরিশ্রমের মানসিকতায় নেই। ক্ষমতার দম্ভে তারা গায়ের জোরেই সবকিছু করতে চায়। ক্ষমতার দাপটে রক্তে উত্তেজনা অস্বাভাবিক আছে বলেই খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারে নামলে বিএনপি সমর্থক প্রার্থীর ভোট বাড়তে পারে, এই আশংকায় আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতারা দ্রুত উত্তেজিত হলেন এবং স্নায়ু চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হলেন।

অতএব তারা হাতে লাঠি, হ্যামার, কোমরে পিস্তল গুঁজে প্রকাশ্যে রাজপথে নেমে বীরদর্পে খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরের গাড়ি ভেঙ্গে বিশাল বীরত্ব দেখাল! খুব সহজ কাজ, দিনের পর দিন ভোটারদের কাছে  গিয়ে খালেদা জিয়া কিংবা বিএনপি’র আসল চেহারা তুলে ধরতে হল না, এক বেলার তাণ্ডবেই খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচার বন্ধ! কিন্তু এই একবেলার হামলা খালেদা জিয়ার দশবেলার নির্বাচনী প্রচারের কাজটা করে দিল। এর ফলে পেট্রোল-বোমা আগুনের রাজনীতিতে যে বিএনপি নেতা-কর্মীদের জনগণের সামনে মুখ দেখানো লজ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারাই গলা উঁচু করে বলল, দেখেছেন আওয়ামী লীগের আসল চেহারা! ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীরা বিএনপি’র প্রকৃত ভয়ংকর চেহারা নিজেরাই মুখোশ হয়ে ঢেকে দিল, নির্বাচনে মাঠে এগিয়ে দিল বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের!

দুই.
এবারের সিটি নির্বাচনে ভোটের প্রচলিত হিসেবেই আওয়ামী লীগ সমর্থক মেয়র প্রার্থীরা এগিয়ে ছিলেন। ঢাকা উত্তরে ক্লিন ইমেজের ব্যবসায়ী এবং এক সময়ের জনপ্রিয় উপস্থাপক আনিসুল হককে প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন আওয়ামী লীগের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তই বলেই সবার কাছে বিবেচিত হয়েছে। বিপরীতে বিএনপি শুরু থেকেই প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে বেকায়দায় ছিল। ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল মিন্টু আর তার ছেলে একই সঙ্গে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার পর থেকে মিন্টুর মনোনয়ন বাতিল হওয়া পর্যন্ত বড় সংকট কাটাতে হয়েছে বিএনপিকে।

পরে যখন একেবারে কম বয়সী, অনভিজ্ঞ তাবিথ আউয়ালকে সমর্থন দিল বিএনপি, তখন সাধারণের সামনে বেশ স্পষ্টই হয়ে গেল আনিসুল হকের ব্যক্তিত্বের কাছে শুরুতেই হাল ছেড়ে দিয়েছে বিএনপি। ঢাকা উত্তররের নির্বাচনী দৌড় থেকে বিএনপি সরে গেছে, খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে কারওয়ান বাজারে হামলার পূর্ব পর্যন্ত এমন ধারণাই জনমনে ছিল। আওয়ামী লীগই ধারণাটা পাল্টে দিল। এখন সামনে দাঁড়াল নতুন প্রশ্ন, নির্বাচনের আগেই যা দেখাচ্ছে যুবলীগ-ছাত্রলীগ, নির্বাচনের পরে তো ওদের দাপটে সাধারণ মানুষ নগর ভবনের ত্রি সীমানায় যেতে পারবে না!

এই হামলা দক্ষিণের প্রার্থী সাঈদ খোকনকেও বেকায়দায় ফেলেছে। খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার পর বিএনপি দক্ষিণের বিভিন্ন ওয়ার্ডে মেয়র মোহাম্মদ হানিফের আমলে নগর ভবনে প্রতিদিন সন্ত্রাস হয়েছে, তার পুত্র জিতলেই সেরকম হবে, সে প্রচার চালাচ্ছে। অথচ আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ কর্মীরা মীর্জা আব্বাসের ‘মি:টুয়েন্টি পার্সেন্ট’র ইতিহাস সামনে আনছে না। ‍

১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৪ সালে প্রথম ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের আগে মীর্জা আব্বাস তিন বছর সরকারের মনোনীত মেয়র ছিলেন। সে সময় তার পরিচিতি দাঁড়িয়েছিল ‘মি টুয়েন্টি পারসেন্ট’ নামে। তিনি ঠিকাদারি কাজে টুয়েন্টি পারসেন্ট কমিশন নিতেন বলে অসংখ্য প্রতিবেদন সে সময় সংবাদ মাধ্যমেও এসেছে। প্রবল প্রতাপশালী মীর্জা আব্বাসের রক্তচক্ষুর সামনে তার পছন্দের হাতে গোনা কয়েকজন ঠিকাদার ছাড়া অন্য কোন ঠিকাদার নগর ভবনের কাছাকাছিও ঘেঁষতে পারত না। ১৯৯৪ সালের সিটি নির্বাচনে ভোটাররা তাকে উচিত জবাব দিয়েছিল। সে সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফ প্রায় দ্বিগুণ ভোটের ব্যবধানে জিতেছিলেন। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফের পুত্র সাঈদ খোকনেরও ইমেজ সংকট নেই। অথচ সময়ের পরীক্ষিত ‘মি টুয়েন্টি পারসেন্ট’ সেই মীর্জা আব্বাসের সামনে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেলেন সাঈদ খোকন আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের বিচার-বিবেচনাহীন কর্মকাণ্ডের কারণেই!

তিন.
ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই নির্বাচনে কিছুটা অস্বস্তিতে থাকে। কারণ ক্ষমতার মেয়াদে দায়িত্বে থাকা জনপ্রতিনিধির অনেক কর্মকাণ্ড জনমনে বিরক্তি, প্রশ্নের উদ্রেক করে, যার সুযোগ নেয় বিরোধীপক্ষ। চট্টগ্রামে মনজুরুল আলম সিটিং মেয়র হিসেবে সেই বেকায়দায় ছিলেন। তার উপর ভোট হচ্ছে বর্ষা মৌসুমে। চট্টগ্রামের সেই বিখ্যাত জলাবদ্ধতাই মনজুরুল আলমের দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র হওয়ার স্বপ্ন ধুলিস্যাত করার জন্য যথেষ্ট ছিল। শুরুতে সেই সংকটে তিনি ছিলেনও। কিন্তু শেষের দিকে এসে নির্বাচনী প্রচারে দৃশ্যতই চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ফলে দল সমর্থিত প্রার্থীর কপালেও ভাঁজ বাড়ছে। তার উপর খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার পর সিটি নির্বাচনে স্থানীয় ইস্যুর পরিবর্তে জাতীয় ইস্যু বড় হয়ে উঠেছে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা যেভাবে করুণ সুরে সালাহউদ্দিন আহমেদের নিখোঁজ হওয়াসহ একাধিক নেতা-কর্মীর গুম-খুন হওয়ার অভিযোগ সামনে আনছে, সর্বশেষ খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার বিবরণ তুলে ধরছে, তার বিপরীতে বিএনপি’র পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের মর্মান্তিক চিত্র আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা তুলে ধরছে না।
বাঙালি দ্রুত ভুলে যায়। বিশেষ করে বিএনপি’র ভয়ংকর অপরাধ আর আওয়ামী লীগের বড় বড় সাফল্য, অবদানের কথা এ দেশের মানুষ দ্রুত ভুলে যায়।

নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এদেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে কোন অপপ্রচার হলে সেটা মানুষ সহজে অবিশ্বাস করতে চায় না, যেমন ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে হেফাজতের সমাবেশে আলেম হত্যার যে জঘন্য মিথ্যা ধর্মের দোহাই দিয়ে বিএনপি-জামায়াত প্রচার করেছে, তা মানুষ বিশ্বাস করেছে। আফগানিস্তান, পাকিস্তানে দাড়িওয়ালা মানুষের উপর সেখানকার পুলিশের লাঠিচার্জের ছবি ঢাকার ছবি বলে চালানো হয়েছে,, এমনকি মায়ানমারের একটি প্রদেশে অজানা রোগে কয়েক ডজন শুয়োর মরার ছবি ফটোশপে কিছুটা ধূসর করে সেই ছবিকে হেফাজতের সমাবেশে পুলিশের অভিযানের পরের ছবি বলে চালানো হয়েছে!
একটা প্রবাদ আছে, 'ভারতবর্ষে ভগবানের চেয়ে ভুতের ভয় বেশী'-এই প্রবাদ বাক্যকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে কদর্যভাবে ব্যবহার করছে বিএনপি। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি’র নোংরা রাজনৈতিক কৌশল। মানুষের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধর্মের অন্তর্নিহিত নৈতিকতা কিংবা আদর্শকে দূরে রেখে ধর্মের দোহাই দিয়ে কুসংস্কার আর অন্ধত্বকেই জনমনে উস্কে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তির ভেতরে রাখার নোংরা রাজনৈতিক কৌশল বিএনপি জন্মলগ্ন থেকেই ব্যবহার করে আসছে। এই কৌশলের কাছে আওয়ামী লীগ বার বার মার খায়, অথচ এর  বিরুদ্ধে কেন জানি আওয়ামী লীগ কখনই সত্যভাষণ নিয়ে শক্তভাবে দাঁড়ায় না, বরং বিএনপিকে নোংরা কৌশল বাস্তবায়নের সুযোগ আওয়ামী লীগই বার বার‌ দিয়ে এসেছে!
এবার পেট্রোল বোমা, আগুন সন্ত্রাসের রাজনীতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি'র ইমেজ যখন ‌'আল কায়দার মতই সন্ত্রাসী' হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে, তখণ বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা বিএনপিকে আবারো পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস আড়াল করার সুযোগ এনে দিল। পেট্রোল বোমার সন্ত্রাস আড়াল করতে সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাকে বড় উদাহারণ হিসেবে তুলে ধরে গুন-খুন-সন্ত্রাস সমান গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে এল বিএনপি। পরিস্থিতি এমন হল, পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের দায় যেমন বিএনপি'র এড়ানোর কোন সুযোগ নেই, সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হওয়ার দায় এড়ানোর সুযোগও সরকারের নেই। অতএব আবার জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমানে সমান! এবার খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠেও বিএনপিকে সুযোগ করে দিল! দলের ভেতরে বিভাজন আর অপপ্রচার মোকাবেলা করে চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রার্থী কতটা সফল হতে পারেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

চার.
সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে ঢাকাকে নিয়ে বড় বড় স্বপ্নের কথা শোনা যাচ্ছে। প্রবল কেন্দ্রীয় শাসন নির্ভর এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর সিটি কর্পোরেশনগুলোর বড় কিংবা ইতিবাচক পরিবর্তণ আসতে পারে, এমন শক্ত কাজ করা অসম্ভব। ফলে নির্বাচনে জেতার জন্য যতই প্রার্থীরা স্বপ্ন দেখান সেগুলো অর্থহীন। অতীতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারা মেয়র ছিলেন। তারা কি পরিবর্তন করেছেন, তা তো সবাই চোখের সামনেই দেখেছে। সেই দলগুলোর সমর্থন নিয়ে কোন প্রার্থী জিতলে বিশাল কিছু পরিবর্তন হবে, এটা আশা করা বোকামি।

এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশী আলোচনায় এসেছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এই সিটি কর্পোরেশনকেই উদাহরণ হিসেবে সামনে আনা যেতে পারে। জানা যায়, বহু বছর আগে এক দিন বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের দরজায় একটি ধাক্কার ঘটনায় আনিসুল হক সুপ্রসন্ন ভাগ্যের সন্ধান পেয়েছিলেন।

ধরা যাক, সেই আনিসুল হক মেয়র হলেন। কিন্তু বহু বছর ধরে নগর ভবনের প্রতিটি দরজায় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় যে মাস্তানতন্ত্র, দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশল চক্র বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, তার সঙ্গে ধাক্কাটা আনিসুল হকের জন্য নিশ্চিতভাবেই সুখকর হবে না। ঢাকার আজকের পরিণতির জন্য বড় কিছু ব্যবসায়ীর দুর্বৃত্তপণাও দায়ী। তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্যবসায়ী নেতা আনিসুল হক কতটা সফল মেয়র হবেন, সে প্রশ্নটাও খুবই গুরুত্বপুর্ণ। নগর সরকার ব্যবস্থা যেহেতু নেই, প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার মেয়রকে তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একজন সেকশন করুণাপ্রার্থীও হতে হবে। কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া তাই শুধু দৃঢ় ব্যক্তিত্ব দিয়ে বাধার এসব জগদ্দল পাথর অপসারণ আনিসুল হকের পক্ষে কি সম্ভব হবে?

বিএনপি সমর্থক প্রার্থী তাবিথ আউয়াল অনেকটাই অপরিপক্ক, অনভিজ্ঞ। তিনি নির্বাচিত হলে সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসনিক ভাষার অ আ ক খ শিখতেই তার পাঁচ বছর কেটে যাবে। একদিকে দলের নির্দেশনা, অন্যদিকে সরকারের চাপ কোনটা সামাল দিয়ে তিনি সফল মেয়র হবেন, সেটাও বড় প্রশ্ন।

মাহী বি চৌধুরী এই দুই দলের অন্ত:সারশূন্য প্রতিশ্রুতির বিপরীতে প্রজন্মের জন্য বিকল্প, নতুন স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে- তরুণ এই প্রার্থী নিজেও নির্বাচনের আগে বিএনপি’র সমর্থন চেয়েছিলেন করজোড়ে।

অর্থাৎ, বিএনপি করুণা করে ঠাঁই দিলে, বিকল্প প্রজন্ম উন্নয়ন চিন্তা-ভাবনা মুহূর্তেই বাদ দিয়ে জীবনের সব জয়গান বিএনপি’র সুরে গাইবেন মাহী বি চৌধুরী, এটা স্পষ্ট। অতএব এমন বিকল্প প্রার্থী নির্বাচিত হলেও যেই লাউ, সেই কদুই হবে।

এর বাইরে তরুনণ, পরিচ্ছন্ন প্রার্থী আছেন। তাদের রাজনৈতিক সততা প্রশ্নবিদ্ধ নয়, লড়াই করার সাহস, মানসিকতাও আছে। কিন্তু তারা টকশো’তে গ্রহণযোগ্য এবং সমঝদার ব্যক্তিত্ব হলেও দুই  বড় দলের  অর্থ,  পেশীশক্তি আর জৌলুসের সামনে নির্বাচনের মাঠে অনেক অনেক দূর পিছিয়ে।

তবু ঢাকা উত্তরে কমিউনিস্ট ঘরানার একজন প্রার্থী জোনায়েদ সাকী বেশ ভালভাবেই সাধারণ ভোটারদের নজর কেড়েছেন, কিন্তু এই নজর শেষ পর্যন্ত ভোটের বাক্স পর্যন্ত যাবে না, এটাই মাঠের বাস্তবতা। অনেককেই বলতে শুনি, ‘তিনি’ ভাল মানুষ, খুব যুক্তি দিয়ে কথা বলেন, জনগণের মনের কথা বলেন, কিন্তু তার তো আর ক্ষমতা নাই, তিনি তো জিতবেন না, অতএব তাকে ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করতে চাই না।

আমাদের দেশে বেশীরভাগ সাধারণ মানুষই ‘আমার ভোট আমি দেব, দেখে শুননে যোগ্য প্রার্থীকে দেব’ -এই ধারণায় বিশ্বাস করে না। অধিকাংশ ভোটারই ভোট দেন হয় অন্ধ দলীয় অবস্থান থেকে, অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অথবা অর্থ আর মস্তানির ক্ষমতায় কোন প্রার্থীর জেতার সম্ভাবনা বেশী তার বিবেচনা থেকে। অতএব স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে ভোটের অংক যতই জটিল হোক, ফলাফল এবং আগামী পাঁচ বছর তার প্রভাবের সমীকরণ একেবারেই সহজ। যেভাবেই ভোট হোক, বড় দুই দলের প্রার্থীদের মধ্যেই কেউ একজন জিতবেন।   দুই বড় দলের প্রার্থী যেই জিতুন না কেন, পাঁচ বছরে ঢাকা স্বাভাবিক গতিতেই বসবাসের অযোগ্য হওয়ার দিকে আরও এগিয়ে যাবে। পাঁচ বছর পর নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর আবারও ঢাকাকে বাঁচানোর সম্মিলিত করুণ আর্তি শোনা যাবে মাত্র তিন সপ্তাহের জন্য।   

রাশেদ মেহেদী: বিশেষ প্রতিনিধি, সমকাল

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৫, ২০১৫
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।