আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল আজ যেন যুদ্ধ বিধ্বস্ত কোন রাষ্ট্র। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্পের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত ও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে নেপাল।
এই কান্নার শেষ হয়তো কারো জানা নেই। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এটা সর্বমোট কিংবা সর্বশেষ সংখ্যা নয়, এটা উদ্ধার হওয়া মৃতের সংখ্যা মাত্র। রাজধানী কাঠমান্ডুতে উদ্ধার কাজ চললেও গ্রামাঞ্চলে উদ্ধার কাজ গতি পায়নি। সে দেশের সরকার বলছে এখন আর কাউকে জীবিত পাওয়া সম্ভব নয়।
তবে ঘটনার ১৩ দিন পর গত ৮ মে ১০৫ বছরের একজন বৃদ্ধকে জীবিত উদ্ধার করার ঘটনা বিশ্ববাসীকে অবাক করেছে। ২০১৩ সালে রানাপ্লাজা ধসে পড়ার ঘটনার ১৭ দিন পর রেশমাকে জীবিত উদ্ধারের ঘটনায় সেদিন আমরাও কম খুশি হইনি। যখন মৃত্যুর মিছিলে লাশের ছড়াছড়ি তখন কাউকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আনন্দ অন্যসব আনন্দকে ছাপিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
নেপালে প্রায় ৮০ লাখ মানুষ আক্রান্ত হবার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় দশ লাখ শিশু রয়েছে। আক্রান্তদের অনেকে মৃতের মোট সংখ্যার তালিকার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। খাদ্য, বস্ত্র, পানীয় জল, ঔষধ, চিকিৎসা এবং আশ্রয়ের জন্য হাহাকার করছে ভূমিকম্প বিপর্যয়ের শিকার নেপালিরা। নেপালের এই দুর্দিনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং ভূখণ্ডগত প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সবাই নেপালে ছুটছেন তাদের পাশে দাঁড়াবেন বলে। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, তিব্বত এবং জাতিসংঘ কেউ বসে নেই। বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত চাল, পানীয় জল, উদ্ধারকর্মী, ওষুধ, খাদ্য, চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন সহযোগিতা গেছে এবং এই সহযোগিতা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
ফেসবুকে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন- ‘আমাদের দেশে এখনও অসংখ্য মানুষ ফুটপাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, দু’বেলা খেতে পাচ্ছে না, কিন্তু নেপালের জন্য এত দরদ দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ’
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে কারো উপকার করতে চাইলে বেশি সম্পদের প্রয়োজন নেই। একটি উন্নত মন, মানবিক চেতনাই যথেষ্ট। আমাদের দেশে যখন কোন বিপর্যয় ঘটে তখন সবাই সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমাদের ব্যক্তিগত অনেক সমস্যা, অনেক অভাব-অভিযোগ থাকে। তবুও আমরা নিজেরটাকে একপাশে রেখে অপরের দুর্দিনে পাশে দাঁড়াই। এটাই মানবিকতা। এই মানবিক সত্ত্বাটা এদেশের মানুষের মধ্যে আছে। এটা যেন মরে না যায়। এটা মরে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো আমরা নিজেরাই।
নেপালের ক্ষেত্রে আমরা যা দেখলাম তা হতাশ হওয়ার মত। আমাদের দেশে এই রকম কোন বিপর্যয় ঘটলে আমাদের দেশের সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সকল বাহিনী এবং সংস্থা যেভাবে এগিয়ে আসেন, তৎপরতা দেখান, ঝাঁপিয়ে পড়েন নেপালের ক্ষেত্রে কিন্তু তা আমরা দেখিনি। এটা নেপালের রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর চরম ব্যর্থতা বলে মনে করি।
এশিয়া মহাদেশের মধ্যে নেপাল একটি চমৎকার দেশ। এভারেস্টের দেশ নামে খ্যাত নেপাল। নেপালে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত কিছু মন্দির। ভারত, চীন এবং তিব্বতীয় অংশে নেপাল অবস্থিত। ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৮১ বর্গকিলোমিটারের এই ছোট দেশে প্রায় পৌনে তিন কোটি মানুষ বসবাস করেন। এদেশের প্রধান লোকসংখ্যা বাংলাদেশের মত গ্রাম্য। রাজধানী কাঠমান্ডুতে প্রায় দশ লাখের মত মানুষ বাস করেন। নেপাল জাতিসংঘ এবং সার্কভুক্ত দেশ। দীর্ঘ এক দশক সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধ নেপালকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছে।
সেদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পার্টির (Maoist) মধ্যে সংঘটিত গৃহযুদ্ধে প্রায় ১৬ হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানিসহ হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। পরে ২০০৬ সালের নভেম্বরে ইউনিফাইড কমিউনিস্ট পাটিসহ সাতটি রাজনৈতিক দল ‘কম্প্রিহেনসিভ পীস অ্যাকর্ড’-এ স্বাক্ষর করলে আপাতত যুদ্ধ থেমে যায়। ২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ৬০১ আসন বিশিষ্ট একটি সংবিধান সভা গঠন করা হয়। দ্বিতীয় সংবিধান সভা নির্বাচন ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর সফলভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এর হাত ধরে ৬০১ আসন বিশিষ্ট নতুন সংবিধানসভা এবং একটি নতুন সরকার গঠিত হয়। বর্তমান সরকার টেকনোক্র্যাট পদ্ধতিতে গঠিত। দেশটি এখনও পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে সব উলটপালট করে দিল ভূমিকম্প বিপর্যয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলা হানাহানি এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেশটির অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেছে। নিম্ন উৎপাদন ও বিনিয়োগের জন্য দেশটির রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি, দরিদ্র অবকাঠামোই দায়ী।
এরপরও নেপাল উন্নয়ন সম্ভাবনাময় একটি দেশ। কারণ নেপালের আছে একটি বড় শ্রমশক্তি, কাঁচামালের প্রাচুর্য, ভারত এবং চীনা বাজারে ব্যাপক চাহিদা এবং সমৃদ্ধ পর্যটন খাত। জাতীয় আয়ের বিশাল একটি অংশ আসে পর্যটন খাত থেকে।
নেপালের রপ্তানিযোগ্য পণ্যগুলোর মধ্যে কার্পেট, বস্ত্র, চামড়াজাতদ্রব্য, পাটজাতদ্রব্য, শস্য উল্লেখযোগ্য। প্রধান শিল্পগুলোর মধ্যে পর্যটন, টেক্সটাইল, কার্পেট, হস্তশিল্প, চাল, পাট, চিনি, সরিষা, তামাক, সিমেন্ট এবং ইট উৎপাদন উল্লেখযোগ্য। নেপালের সাথে প্রধানত বাংলাদেশ, ভারত, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সম্পর্ক আছে।
ভূমিকম্পের মত আগ্রাসী প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলো কোন ইশ্বরের অভিশাপ নয়, এগুলো মানব সৃষ্ট দুর্যোগ। ভূমিকম্প কেবল নেপালে হয়েছে তা নয়, এ পর্যন্ত পৃথিবীর অনেক দেশ ভূমিকম্পের শিকার হয়েছে। যে কোন সময় যে কোন দেশে ভূমিকম্প হতে পারে। নেপাল ট্র্যাজেড়ি থেকে আমাদেরও শিক্ষা নিতে হবে। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে আমাদের।
বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলেই অবস্থিত। বাংলাদেশের ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, বাংলাদেশ ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। এরকম কিছু হলে পরে ঢাকা শহরের প্রায় এক লাখ দালানকোঠা বিধ্বস্ত হবার আশংকা আছে। আমাদের দেশে ভূমিকম্প ছাড়াও ভবন ধসে পড়ার অনেক নজির আছে। সেই জায়গায় যদি বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা যদি সত্যি হয় তাহলে নেপালের চেয়ে বেশি কান্না, দুর্ভোগ, হাহাকার অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। প্রার্থনা করি একাগ্র মনে এই আশঙ্কা যেন সত্যি না হয়। ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয়, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমাতে আমাদের করণীয় কর্ম থেকে বিচ্যুত হবার কোন সুযোগ নেই। বিল্ডিং কোড মেনে যাতে বিল্ডিং নির্মাণ করা হয় এই বিষয়ে একদিকে যেমন সরকারি কড়া তদারকি দরকার, তেমনি দরকার জনসচেতনতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বর্গফুটে মাত্র দশ টাকা বেশি খরচ করে বিল্ডিং কোড মেনে ভূমিকম্প সহনশীল বিল্ডিং নির্মাণ করা সম্ভব। আমাদের নিজেদের খামখেয়ালিপনা এবং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে দেশ এবং দেশের মানুষ কত বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছেন তা আমাদের নাগরিক মাত্রেই গুরুত্ব দিতে হবে। কেবল ঢাকা নয়, দেশ জুড়ে একই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে দালান ব্যবসায়ীদের দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে আরো দায়িত্বশীল হতে হবে।
নেপালের এই ঘোর দুর্দিনে জাতপাত এবং ধর্মের মাপকাঠিতে বিচার করার সময় এখন নয়, মানবতার বিচারে আমাদের জিততেই হবে সেটাই বিচার্য।
বাংলাদেশ সময়: ১১১৮ ঘণ্টা, মে ১২, ২০১৫
জেডএম